মহসিন মাখমালবাফ
তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই
পর্ব ৫
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ২৯, ২০২১
প্রথমেই বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পরেও আফগানিস্তানের মূল সমস্যা ছিল খণ্ড খণ্ড গোত্রগুলির শাসন, যা আফগানিস্তানকে একটি পতাকার নিচে কখনো এক হতে দেয়নি। ইসলামের নবি মুহাম্মদের (স.) সময় আরবে সেইরকম সঙ্কটই ছিল। ফলে ইসলামের নবি সেই সঙ্কট দূর করবার জন্য নতুন যে ধর্ম প্রচার করেছিলেন, সেটা ছিল একেশ্বরবাদের ধারণা। বহু দেবতার পূজার জায়গায় এক স্রষ্টার ধারণা তিনি প্রবর্তন করলেন। সকলকে বোঝালেন, স্রষ্টা যখন এক, মানুষে মানুষে এত বিভেদ থাকবার কারণ নেই। গোত্র-প্রধান সমাজকে তিনি এভাবে একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত করেছিলেন, ফলে তারপর বহু বছর একটার পর একটা যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল আরব বেদুইনরা। কিন্তু আফগানিস্তানে তা হয়নি। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ তাদের গোত্রসংটের সমাধান দেয়নি। দুই হাজার সালের দিকে ষাট লাখ জনসমষ্টি নিয়ে পশতুনরা আফগানিস্তানের বৃহত্তম গোত্র ছিল। এরপর তাজিকরা, যাদের লোকসংখ্যা ছিল চল্লিশ লাখ। তৃতীয় ও চতুর্থ হচ্ছে হাজেরা ও উজবেক, যাদের মিলিত জনসংখ্যা ছিল চল্লিশ লাখ। বাকি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র রয়েছে, যেমন: ইমাঘ, ফার্স, বালুচ, তুর্কমান ও কিজিলবেশ।
বিভিন্ন গোত্রগুলি পরস্পরের সঙ্গে মিশবে না বরং নানারকম সংঘাতে লিপ্ত থাকবে। মাখমালবাফ লিখেছেন, ‘কান্দাহার ছবি তৈরির সময় যখন আমি ইরান ও আফগানিস্তান সীমান্তের শরণার্থী শিবিরগুলিতে ছিলাম, আমি বুঝেছি যে, আফগান শরণার্থীরা শিবিরে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে। সেখানেও তারা তাদের আফগান জাতীয় পরিচয় গ্রহণ করেনি। তাজিক, হাজেরা বা পশতুন হওয়াতে সেখানেও তাদের মধ্যে সংঘাত ঘটেছে।’ আফগানদের মধ্যে ভিন্ন গোত্রে বিয়ে হয় না, হয় না কোনো ব্যবসায়িক লেনদেন। সামান্য বিরোধের সূত্র ধরে ব্যাপক রক্তপাতের উপক্রম ঘটে। রুটির লাইনে ঢুকে পড়ার অপরাধে এক গোত্রসদস্যকে খুন হতে দেখেছেন মাখমালবাফ ভিন্ন গোত্রের আরেকজনের হাতে। পশতুন আর হাজেরা শিশুদের একসাথে খেলাধুলা করা সহজ না, তা কখনো কখনো পারস্পরিক হানাহানিতে রূপ নেয়। কেউ এমনকি অন্য গোত্রের মসজিদে নামাজ পড়তেও আগ্রহী নয়। যখন শরণার্থী শিবিরে চিকিৎসা দেয়া হতো, সেখানে একটা দিন ঠিক করা হতো হাজেরা রোগীদের জন্য, আর একটা দিন পশতুনদের জন্য। সেইরকম একটা সমাজে তালেবানদের প্রথম সাফল্য ছিল, আফগানিস্তানের গোত্র-প্রাধান্য ভেঙে একটা জাতীয় চরিত্র দিতে পারা। খুব স্বাভাবিকভাবেই তালেবানদের এই কাজটি বাইরের দখলদার শক্তির কাছে খুব ইতিবাচক ছিল না। না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।
কৃষিপ্রধান দরিদ্র আফগানিস্তান রাশিয়ান আক্রমণে আরো দরিদ্র হয়েছে। আগে প্রচুর পশু ছিল আফগানদের, যুদ্ধের পর তাও নেই। মাত্র সাত শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করা যায়, খরার কারণে আবার সেটা নাও হতে পারে। বিদেশি দখলদার শক্তি আফগানিস্তানের শত্রু বটে, কিন্তু আরেক শত্রু ঘরের ভিতরের প্রকৃতি। রুক্ষ আর শুষ্ক দেশের পক্ষে এর জনগণকে সাহায্যের জন্য পপীবীজের চাষই একমাত্র স্বাভাবিক পন্থা। যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে এবং রুটির দাম না বাড়ে, তো এই সমস্ত পপী সম্পদ থেকে প্রত্যেক আফগানের ভাগ্যে জোটে একটুকরা রুটি। এখন গোড়ার যে প্রশ্নটা আসে সেটা হলো, আফগান জনগণ কী করে বাঁচে? কর্মহীনতার ফলে মৃত্যু এড়াতে আফগানরা দেশ ছাড়ে। তারা অনেকে ইরানে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে। সত্যি বলতে, আফগানদের প্রতিদিনের রুজি নির্ভর করে অন্যান্য দেশে কাজ করার উপর। মানুষ প্রধানত ইরান আর পাকিস্তানে যায় এজন্য। প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর একজন আফগানকে কয়েকটা বিষয় বিবেচনা করতে হয়। প্রথমত: তার পশুর পালকে রক্ষা করা, যা নির্ভর করে প্রকৃতির নানা ঘটনার উপর। দ্বিতীয়ত: দল বা উপদলের হয়ে যুদ্ধ করা। সাধারণত কাজের অভাবেই সে সেনাবাহিনীতে ঢোকে, নিজের পরিবারকে জীবন ধারণের জন্য কিছু অর্থ সাহায্য করা দরকার। সমস্ত কিছুতে ব্যর্থ হলে সে ঢুকে পড়ে মাদক ব্যবসায়। এই শেষ পন্থাটির বিস্তার সীমিত, এভাবে আফগানিস্তানের জনগণকে আফিম চোরাচালানি হিসাবে সাব্যস্ত করা ভুল; খুব সীমিত সংখ্যার ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য।
মাখমালবাফ জানাচ্ছেন, ‘প্রায় বিশ হাজার নারী পুরুষ ও শিশুকে আমি হেরাত শহরের এখানে সেখানে মরতে দেখেছি ক্ষুধায়। হাঁটার সামর্থহীন তারা মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবধারিত মৃত্যুর অপেক্ষা করছিল। তাজাকিস্তানের দুশানবে এক দৃশ্য দেখেছিলাম, যেখানে একলক্ষ আফগান দক্ষিণ থেকে উত্তরে দৌড়াচ্ছে। মনে হচ্ছিল, যেন হাশরের দিন। যুদ্ধপীড়িত ও ক্ষুধার্ত শিশুরা খালি পায়ে দৌড়াচ্ছে মাইলের পর মাইল, বিশ্ব গণমাধ্যমে যা দেখানো হয়নি কখনো। আফগানিস্তান আর তাজাকিস্তানের মধ্যবর্তী নো-ম্যান্স ল্যান্ডে তারা মরলো হাজারে হাজারে। বাঁচার স্বপ্ন নিয়েই তারা মারা যাচ্ছিল এভাবে, কারণ দারিদ্র আর যুদ্ধ। বারবার অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের উপরে। নিশ্চয়ই আফগানিস্তানের দারিদ্রের একটা কারণ তাদের নিজস্ব উদাসীনতা। কিন্তু সেটাই সব নয়। জাবলের কাছে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে একবার মাখমালবাফ দেখেছিলেন, সেখানে এক সপ্তাহ মানুষ না খেয়ে আছে। তাদের খাওয়ার জন্য ছিল কেবলমাত্র পানি। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, এত লোকের খাবার দেবার সামর্থ তাদের নেই। সরকারের উচ্চমহল তাদের খাবার দিতে রাজি ছিল না। কারণ তারা অবৈধ অভিবাসী বা অনুপ্রবেশকারী। যুদ্ধে আর ক্ষুধায় মানুষগুলির অনুপ্রবেশ করা ছাড়া আর কি করার ছিল?
এসব মানুষদের নিয়ে কখনো ভদ্রলোকরা ভাবেনি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী রাষ্ট্র এদের খাবার জোগায়নি। মাখমালবাফ সামর্থ অনুযায়ী কিছু খাবার দিতে পেরেছিলেন সেদিন শুধু আশি বছরের বৃদ্ধ আর শিশুদেরকে। যারা দূরে বসে আমরা আফগানিস্তান নিয়ে তর্কে নেমেছি, তারা কি আফগানিস্তানকে চিনি? মাখমালবাফের যুদ্ধ নিয়ে ছবি করার সুযোগ বা অনুমতি ছিল না। তিনি ছবি করেছিলেন তাই মানবিক জায়গা থেকে, তিনি আফগানদের সঙ্গে কিছুটা পথ হেঁটেছিলেন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে।
মনে রাখতে হবে, একদা আফগানিস্তানের সিল্করোড ছিল বিখ্যাত, বিরাট আয়ের উৎস ছিল তা প্রাচীন আর মধ্যযুগে। পাহাড়-ঘেরা আফগানিস্তান একদা তাকে নিরাপত্তা দিয়েছিল বাইরের শত্রুর হাত থেকে। অতীতে কাফেলাগুলোর জন্য আফগানিস্তান ছিল করিডোর। সিল্করোড ধরে বলখ্ হয়ে চীনে যাওয়া যেত এবং কান্দাহার হয়ে ভারত। এই পথেই ভারত গিয়েছেন আলেকজান্ডার, তৈমুর, মাহমুদ শাহ গজনভি আর নাদির শাহ। গত শতকের জলপথ আর আকাশ পথ আবিষ্কারের পর আফগানিস্তানের এই প্রাচীন বাণিজ্য্যপথের আর গুরুত্ব নেই, পথ এখন কানাগলিতে পরিণত হয়েছে। সিল্করোডে পাহাড়ি রাস্তা ছাড়া ছিল কাঠের সেকালে সেতু; বাইরের দখলদার শক্তির বিভিন্ন যুদ্ধ সেগুলিকে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করেছে। দুই দশকের বহিঃআক্রমণ এবং গৃহযুদ্ধের পর জনগণ চাইছিল একটা শক্তিশালী দল যারা বিজয়ী হবে এবং আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক নিয়তির যা হোক একটা নির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা দেবে। যদি আফগানিস্তান এত উঁচু নিচু পাহাড়ের দেশ না হতো, রাশিয়ানরা সহজেই দখল করতে পারতো। রাশিয়ানরা চলে যাবার পর আফগানিস্তান নতুন রকম চিন্তা করতে আরম্ভ করে। রাশিয়ান আক্রমণের এটাই ছিল ইতিবাচক দিক, আফগানদের নতুন কিছু ভাবাতে পেরেছিল। নিজেদের মধ্যে তারপর থেকে একটা ঐক্য খুঁজে বেড়ায় আফগানরা। প্রাথমিকভাবে তালেবানরা সেই ঐক্য তৈরি করে দিয়েছিল। চলবে