তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ৩

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ২৭, ২০২১

মাখমালবাফ `সাইক্লিস্ট` আর `কান্দাহার` ছবি দুটি করার জন্য বহু দিন ছিলেন আফগানিস্তানে। তিনি তেরো বছরের ব্যবধানে ছবি দুটি বানিয়েছিলেন। ফলে বিভিন্ন ভাবেই বিভিন্ন সময়ে আফগানিস্তানকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি এ সময়কালে প্রধানত যা দেখেছেন তা হলো, আফগানিস্তান দেশটির বা সেখানকার মানুষের চরম দারিদ্র। সে দারিদ্রের কারণ বিদেশি শক্তির দখলদারিত্ব। কখনো আফগানিস্তান খুব ধনী দেশ ছিল না। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশ আফগানিস্তান, এর আয়তন আড়াই লক্ষ বর্গমাইল। বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে অনেক বড় আবার লোক সংখ্যা অনেক কম। বিগত আশির দশকের শেষে আদমশুমারিতে লোকসংখ্যা ছিল এক কোটি পঞ্চান্ন লক্ষ। তিন দশক ধরে আফগান্তিানের সঠিক খতিয়ান নেই, তবুও ধারণা করা হয় বিগত নব্বইয়ের দশকের শুরুতে লোক সংখ্যা ছিল দুই কোটি। দুই হাজার এক সালে আন্দাজ অনুসারে লোকসংখ্যা ছিল দুই কোটি আটষট্টি লক্ষ। ঠিক এর আগের বিশ বছরে রুশ আগ্রাসনের কাল পর্যন্ত যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিকার হয়ে, সামরিক হামলায়, খাদ্যাভাবে এবং বিনাচিকিৎসায় মারা গেছে পঁচিশ লক্ষ আফগান। ঠিক একই সময়কালে তেশট্টি লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ইরান আর পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে।

বিশ্ব প্রচার মাধ্যমগুলি আফগানিস্তানের এই খবরগুলি প্রচার করে না। যারা আফগানিস্তান নামটা স্বীকার করে, নামের সঙ্গে জুড়ে দেয় মাদক চোরাচালান, পপীচাষ, তালিবান ইত্যাদি প্রসঙ্গ; মূল সত্যগুলি সেখানে চাপা পড়ে থাকে। ইঙ্গ-মার্কিন প্রচার মাধ্যমের সবচেয়ে বড় খবরটা হলো, নারীদেরকে বোরকার ভিতরে রেখে দেয় আফগানরা, খবরের ভাবখানা এমন যে, বোরকা খুলে নারীর মুখটা দেখা গেলেই আফগানিস্তানের মুক্তি ঘটবে। নারীরা নিগৃীত হচ্ছে সে খবরটাই খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে তারা। নারীকে যারা উলঙ্গ করে নিজেদের পণ্যের প্রচারণা চালায়, নারীমুক্তির কতবড় যোদ্ধা সেই পশ্চিম! নারীকে পণ্যে পরিণত করে নারীর মুক্তি খোঁজে তারা।

ইরানের অংশ ছিল একদা আফগানিস্তান। দুশো পঞ্চাশ বছর আগে এটা ইরানের একটা প্রদেশ বলে গণ্য হতো। আফগান-সন্তান বাবর ছিলেন ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং খুব সম্মানিত একজন ব্যক্তি। যিনি এগারো বছর বয়সে ক্ষুদ্র অঞ্চল ফারগানার ক্ষমতায় আরোহন করেন পিতার মৃত্যুর পর। বহুকাল ধরে সংগ্রাম করে কখনো ক্ষমতা লাভ, কখনো ক্ষমতা হারিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো বাবর, শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে ভারত জয় করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে নতুন এক ভারত সৃষ্টির দ্বার খুলে দেন। পরবর্তীকালে নাদিরশাহর আমলে আফগান ছিল বৃহত্তর খোরাসান প্রদেশের অংশ। বহু ইতিহাস পাঠকের মনে থাকতে পারে, আহমদশাহ অবদালীর কথ যিনি তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাশক্তিকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। মারাঠা তখন বর্গী নাম নিয়ে লুটতরাজ চালাচ্ছিল, বিশেষ করে বাংলায়। আহমদশাহ আবদালী তাদের দমন করেছিলেন। আহমদশাহ আবদালী প্রথম জীবনে চাকরি করতেন নাদিরশাহর অধীনে। এক মাঝরাতে নাদিরশাহ ভারত থেকে ফিরে এসে খুন হলে, নাদিরশাহর সৈন্য বাহিনীর আফগান সেনাপতি আহমদ শাহ আবদালী চার হাজার সৈন্যসহ পালিয়ে গেলেন। তিনি ইরানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। ঠিক এভাবেই আফগানিস্তান সৃষ্টি হলো।

দেশটা ছিল তখন কৃষি প্রধান আর পুরোপুরি গোত্রশাসিত। আহমদশাহ আবদালী ছিলেন পশতুন গোত্রের লোক, অন্যান্য গোত্র যেমন তাজিক, হাজেরা ও উজবেকদের কাছে তিনি স্বাভাবিকভাবেই একচ্ছত্র শাসক হিসেবে গৃহীত হননি। সুতরাং সিদ্ধান্ত হলো, প্রত্যেক গোত্র শাসন করবে তাদের গোত্রের নেতৃবৃন্দ। গোত্রপতিরা সবাই মিলে এক যুক্তগোত্রব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন যা ‘লয়া জিগরা’ হিসেবে পরিচিত। লয়া জিগরা ব্যবস্থায় কখনো কৃষিনির্ভর অস্তিত্ব থেকে আফগানদের আর উন্নতি ঘটেনি।

কথা হলো, আফগানিস্তানের জনগণ আহমদশাহ আবদালীর সময় থেকে গোত্রভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সন্তুষ্ট থেকেছে। কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আফগানিস্তান কখনো এমন জৌলুসপূর্ণ নগর তৈরি করতে পারেনি যা পর্যটক বা বিদেশিদের হাতছানি দেবে। মাখমালবাফের ভাষায়, ‘আফগানিস্তান কোনো সুন্দরী মেয়ে না যে তার হাজার প্রেমিকের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বৃদ্ধার সাথেই তার আজ সাদৃশ্য।’ বিরাট দেশ আফগানিস্তান যার পঁচাত্তর শতাংশ ভূখণ্ড পর্বতসঙ্কুল যার মধ্যে মাত্র সাত শতাংশ কৃষিকাজের উপযোগী। মানুষ থাকে উঁচু পাহাড়-ঘেরা আবছা উপত্যকায়। বালুকাময় উপত্যকায় পাওয়া যায় প্রচুর আখ আর তুলা এবং ইউরোপীয় ফলফলারি। শাকসবজি বিপুল পরিমাণে জন্মে ছয় থেকে সাত হাজার ফুট উঁচু মালভূমিগুলিতে। আফগানিস্তানের একজন কৃষকের কাছে তার উপত্যকাই তার দুনিয়া। ফলে অন্যের দেশ দখল করতে সে বের হয়নি কখনো। কারো দেশে সে আক্রমণ চালায়নি। কিন্তু তবুও নাকি সে সন্ত্রাসী! নিজের মতোই থাকার চেষ্টা করেছে আফগানিস্তানের গ্রামীণ মানুষগুলি। বিশ্ব অর্থনীতিতে সে কখনো অংশ নিতে পারেনি। দুনিয়াকে দেবার মতো আফগানিস্তানের পণ্য কেবল আফিম। সেটাও লুট করে নিয়ে যাচ্ছে অন্যরা অন্যায়ভাবে।

বিভিন্ন দেশ তার উপরে বারবার অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। কারণ তার কোনো শক্ত বন্ধুরাষ্ট্র ছিল না। কৃষিপ্রধান একটা দেশ, যার জৌলুস নেই, কে তার পাশে দাঁড়াবে? দরিদ্র মানুষের বন্ধু কে হতে চায়? কিন্তু দরিদ্রের কন্যাকে ভোগ করার সুযোগ পেলে কেউ ছাড়ে না। আফগানিস্তানের ভাগ্য প্রায় তেমনি। দুর্ভাগ্য নিয়েই যেন আধুনিক যুগে তার পুনর্জন্ম। বারবার বলা হচ্ছে, আফগানরা জঙ্গী এবং সন্ত্রাসী। কথা হলো, আফগানরা কি রুশ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখল করতে বের হয়েছিল কখনো? কখনো কি রুশ বা মার্কিন দেশে গিয়ে বোমা ফেলেছে? তা না হলে তাকে জঙ্গী বলা হচ্ছে কী কারণে? মুসলমান বলে? ইরাক জঙ্গী, লিবিয়া জঙ্গী, কাশ্মীর জঙ্গী, আফগানিস্তান জঙ্গী; কিন্তু কেন? কখনো কি তারা পশ্চিমের কোনো দেশ দখল করেছে নাকি সেই দেশ গিয়ে বোমা ফেলেছে? রুশ-মার্কিনরা বোমা ফেললো আফগানিস্তানে, মার্কিনরা বিনা কারণে দখল করে নিল ইরাক, বিনাবিচারে হত্যা করলো সাদ্দামকে, হত্যা করলো লিবিয়ার গাদ্দাফীকে; তবুও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী নয়। সন্ত্রাসী আফগানরা, সন্ত্রাসী পুরো মুসলিম বিশ্ব। কারা প্রচার করছে এসব আর কারা বিশ্বাস করছে? কাশ্মীর ছিল স্বাধীন রাজ্য, ঘটনাচক্রে কাশ্মীরের একটা অংশ যুক্ত হলো ভারতের সঙ্গে। শর্ত ছিল কাশ্মীরের আলাদা পতাকা থাকবে, আলাদা প্রধানমন্ত্রী থাকবে; মুখ্যমন্ত্রী নয়। কাশ্মীর যুক্ত হওয়ার সময় প্রথম কংগ্রেস সরকার তা মেনে নিয়েছিল কিন্তু সামান্য কদিন পরেই কংগ্রেস সরকার ষড়যন্ত্র করে একে একে কাশ্মীরের আলাদা সত্তা কেড়ে নিল, কেড়ে নিল কাশ্মীরের পতাকা আর প্রধানমন্ত্রীর পদ। পরে যারা কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিল আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইতো, সকলকে কারাগার আর নানাভাবে নাস্তানাবুদ করেছে ভারত সরকার। কাশ্মীরের মানুষ যখন সেসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, তারা হয়ে গেল সন্ত্রাসী। কিন্তু কংগ্রেসকে কেউ সন্ত্রাসী বললো না।

ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন ভারতবর্ষে সাড়ে পাঁচশোর বেশি দেশীয় রাজ্য ছিল। ব্রিটিশরা তাদের স্বাধীনভাবে থাকার স্বীকৃতি দিয়েছিল। কংগ্রেস এবং গান্ধী তাদের স্বাধীন থাকাটা মেনে নেয়নি। জিন্নাহ বলেছিলেন, সমস্ত রাজ্যই সার্বভৌম ফলে ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলিকে তাদের মতো স্বাধীন থাকতে দেয়া দরকার। কংগ্রেস সেটা মানতে রাজি ছিল না। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেলের ভয় দেখানো আর মাউন্ট ব্যাটেনের চালাকীর কারণে কাশ্মীর, জুনাগড় আর হায়দারাবাদ ছাড়া সাড়ে পাঁচশোর বেশি রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য হয়। ত্রিবাঙ্কুর, যোধপুর, ভোপাল এবং ইন্দোর স্বাধীন থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু কংগ্রেসের ভীতি প্রদর্শনে তা সম্ভব হয় না। স্বাধীনতার পর ন্যাক্কারজনকভাবে ভারত দখল করে নেয় হায়দারাবাদ আর জুনাগড়। পরিস্থিতির শিকার হয়ে কাশ্মীরের একটা অংশ ভারতে যোগ দেয় শর্তাধীনে। স্বাধীনতার পর ভারত তার নিজের রাজ্যগুলিতে বহুবার চালিয়েছে আক্রমণ, রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে কয়েকবার অন্যায়ভাবে উৎখাত করেছে। নিজ রাজ্যের জনগণের উপর বহু রকম দখলদারীর পরও ভাবখানা এমন যেন ভারত সরকার সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে না। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য মেঘালয়, গোর্খাল্যান্ড, আসাম, মণিপুর, তেলেঙ্গানা, কাশ্মীর এবং শিখ সম্প্রদায় কেন বাধ্য হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করতে? সবাইকে দমন করা হয়েছিল সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে ভয়াবহ অত্যাচার আর নানারকম হত্যাকাণ্ডের ভিতর দিয়ে। নকশালবাড়ির লড়াইটাই বা কী ছিল ভারত সরকারের বিরুদ্ধে? চলবে