তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ২

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ২৬, ২০২১

ইউরোপের যে জাতীয়তাবাদ তা গড়ে উঠেছিল ভাষার ভিত্তিতে। রেনেসাঁর পর ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গঠিত হয় ইউরোপে, ধর্মভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র নয়। সেখানে উনিশ-বিশ শতকের ভারতের জাতীয়তাবাদের চরিত্র কী? খুব স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, মোটেই তা ভাষাভিত্তিক নয়, ধর্মভিত্তিক। ভারতবর্ষের প্রথম ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র হলো ‘বাংলাদেশ’। বিশ শতকের ভারতবর্ষে যদি সঠিক পথে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আগাতে পারতো, তাহলে ধর্মভিত্তিক এক ভারত গঠিত না হয়ে, ভাষাভিত্তিক অনেকগুলি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হতো। ভারতের সবগুলি ভাষা নিয়ে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্র্রের দেখা মিলতো তখন। বঙ্কিমচন্দ্র তার আনন্দমঠ গ্রন্থে সরাসরি মুসলমানদের নিধন করে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ গঠনের কথা বলেন। মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণের কথা বলেন। ইংরেজি শিক্ষিত বাবুরা কেউ তার প্রতিবাদ করেননি বরং সে গ্রন্থ থেকে ‘বন্দেমাতরম’ গানটি বাছাই করেন তাদের জাতীয়তাবাদের মন্ত্র হিসেবে। প্রথম দিকের হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের আর এক দিকপাল বিবেকানন্দ আর রাজনারায়ণ বসু। বিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রাজনারায়ণ বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বারীণ ঘোষ আর অরবিন্দ ঘোষ জাতীয়তাবাদী কথাবার্তা বলা শুরু করেন। সেখানে আরো যুক্ত ছিলেন বিপিন পাল, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়; পরে আরো অনেকে যোগ দেন। বঙ্গভঙ্গের সময় ভারতে যে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে গুপ্তদল গড়ে ওঠে সেখানে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার ছিল না। কালীর মূর্তি আর ভগবত গীতার সামনে শপথ নিতে হতো। ভারত স্বাধীন করার লক্ষ্য ছিল সনাতন ভারত বা হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। গান্ধীও স্বাধীনতা লাভের কারণ বলতেন ‘রামরাজত্ব’ প্রতিষ্ঠা। বর্তমানে আফগানিস্তানের দিকে তাকিয়ে কি মনে হয় না, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম লড়াইটা আরম্ভ হয় ধর্মকে ঘিরেই। ভারতে তাই হয়েছিল আর সে-ধারা এখনো বন্ধ হয়নি। বর্তমান আফগানিস্তান তার উদাহরণ মাত্র।

বর্তমানে আফগানিস্তানে যে নয়া সরকার গঠিত হয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র আর ভারত কোণঠাসা বলে মনে হচ্ছে। ফলে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণ নিয়ে পাশ্চাত্য আর ভারতের অনেক মাথাব্যথা আরম্ভ হয়েছে। ভারত মার্কিন ইন্ধনে প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি ডলার আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করতে আরম্ভ করেছিল। সেটা কি আফগানিস্তানের ভাগ্য পাল্টাবার জন্য, নাকি নিজের মুনাফা লাভের জন্য? ভারতে ইংরেজেদের ক্ষমতা হস্তান্তর বা ভারত ভাগের সময় বহু রক্তপাত ঘটেছিল। বহু মানুষ রাতারাতি ছুটেছিল পাকিস্তান থেকে ভারতের দিকে, আবার বহু মানুষ ছুটেছিল ভারত থেকে পাকিস্তানের দিকে। দাঙ্গার নামে বহু ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়েছিল। ট্রেন বোঝাই লাশ এসেছিল দুদিক থেকেই। দাঙ্গার আসল কারণ কিন্তু হিন্দু-মুসলমান নয়, ব্রিটিশদের পলিসি। ইচ্ছা করেই তারা এমনটা ঘটাবার রাস্তা তৈরি করে রেখেছিল। ভারত স্বাধীন হয়েছিল যুদ্ধ করে নয়, চুক্তির ভিত্তিতে; পাতানো খেলার মাধ্যমে। বহুজন জানেই না, ভারতকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দেয়া হয়নি তখন; দেয়া হয়েছিল ‘ডোমেনিয়ন’-এর মর্যাদা। শাসকরা তাতেই খুশি ছিল, কারণ তারা হাতে ক্ষমতা পেয়েছে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। যখন ব্রিটিশ শাসকরা ভারত ছাড়ে এমন একটা কাণ্ড করে গিয়েছিল, যেন তারা প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয়াবহ দাঙ্গা লাগে। কারণ তারা সারাবিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিল, ভারতীয়রা কতটা বর্বর। ব্রিটিশ শাসকরা সকলকে দেখাতে চেয়েছে ভারতীয়রা ব্রিটিশ শাসনেই যা একটু সভ্য হয়েছে, না হলে নিজেদের মধ্যে এমন রক্তপাত ঘটাতে পারে। ব্রিটিশরা তার সেই পলিসি বাস্তবায়নে সফল হয়েছিল। গান্ধী যখন বুঝতে পারলেন ব্রিটিরা কেমন বোকা বানিয়েছে তাদের; গান্ধী তখন উপান্তর না দেখে, জিন্নাহর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। তিনি বললেন, জিন্নাহ আর আমি একসঙ্গে দাঁড়াবো ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। জিন্নাহকে তখন তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু মনে হয়েছিল। কিন্তু পছন্দ করলেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেল। গান্ধীকে ভয় দেখালেন প্যাটেল, নেহরু আর আজাদের সামনেই গান্ধীকে অপমান করলেন। উৎপল দত্তের রচনা আর আজাদের ‘ভারত স্বাধীন হলো’ বই পাঠ করলেই এসব সত্য জানা যাবে। গান্ধী যেদিন জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পায়ে হেঁটে পাকিস্তান যাত্রা করবেন তার আগের দিন নিহত হন।

ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বহুদিন ধরে যে ভারত-পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় হত্যাকাণ্ড এবং দাঙ্গা ঘটেছে। ভারতে তখন যে পরিমাণ রক্তপাত ঘটেছে, যত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে; তার কিছুই হয়নি আফগানিস্তানে। ব্রিটিশ শাসকরা বিশেষ করে মাউন্ট ব্যাটেন ক্ষমতা ছেড়ে যাবার রাগে চেয়েছিল ভয়াবহ একটা রক্তপাত আর বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছিল ভারত কত খারাপ আর অসভ্য একটা জাতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই খেলা খেলেছে, আকস্মিকভাবে বহুজনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেছে। বিমানবন্দরে একটা ন্যাক্যারজনক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। বিমানবন্দরে যা ঘটেছে তা দেখেই তো মার্কিন শাসনের নমুনা বোঝা যায়। বিমানবন্দরে যারা বাঁচার জন্য পাগলের মতো আচরণ করেছে, যদি সেটা সত্যি হয়; মনে রাখতে হবে তারা শিক্ষিত আফগান আর মার্কিনের দালাল। নাহলে ঐভাবে পালাতে চাইবে কেন? সাধারণ আফগানরা সেখানে ছিল না, কারণ তারা গ্রামের বাসিন্দা। বিমানবন্দর দূরের কথা তারা বেশিরভাগ শহরই দেখেনি। ভারত যখন স্বাধীন হয়, সাম্যবাদীরা সেটা গ্রহণ করেনি পাতানো খেলা বলে। কারণ তারা জানতো কংগ্রেস সরকার জনগণের বন্ধু নয়। বহু মানুষের সঙ্গে সেজন্য সাম্যবাদীরাও বলেছিল, ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’।

শিশির ভাদুরী ভারতের স্বাধীনতার দিন পনেরোই আগস্ট সন্ধ্যায় কলকাতায় নাটক আরম্ভ করার আগে অনেক দুঃখের কথা বলার পর তার দর্শকদের বলেছিলেন, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়। কিন্তু সেজন্য তারা কেউ বিদেশি শাসন টিকিয়ে রাখতে চাননি। কংগ্রেস তাদের কাছে ব্রিটিশদের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু ফেসবুকের পণ্ডিতদের লেখা পড়ে মনে হয়, তারা তালেবানদের বিপরীতে মার্কিন শাসন টিকিয়ে রাখতে চাইছে আফগানিস্তানে। বহু মার্কসবাদীরাও দেখা গেছে তালেবান বিরোধী লেখা লিখেছে। কথা হলো, কংগ্রেস ভারতের জনগণের বন্ধু ছিল না, ছিল জমিদার, সামন্ত আর ব্যবসায়ী ধনীকদের বন্ধু। সেকারণে কংগ্রেস ক্ষমতা গ্রহণের পরে অনেক প্রদেশে বামপন্থী শাসন এসেছিল। যদি তালেবানরা জনগণের আকাঙক্ষা পূরণ করতে না পারে, নতুন সরকার আসবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হঠাৎ এত বাহ্বা দেয়ার কী আছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আসলেই আফগানিস্তান দখল করে থাকার অধিকারটা কী?

যারা মাঠের আন্দোলনে থাকে ক্ষমতা তারাই লাভ করে। তালেবানরা বহুদিন ধরে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মাঠের সংগ্রামে লিপ্ত, কখনো যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে, কখনো বা অন্যের সহযোগিতা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এটাই তো লড়াইয়ের রণকৌশল। কিন্তু তালেবানরা সকল সময়েই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। কখনো তাদের পক্ষে ছিল না। সুভাষ বসু ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য ঘৃণ্য হিটলারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। হিটলারের পক্ষের শক্তি জাপান, সেই জাপানের সাহায্য নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন হিটলারের বিরুদ্ধে কাজ করছেন ভারতে প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘকে সহযোগিতা করে, সুভাষ তখন হিটলারের সহযোগিতা চাইছেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য। সুভাষ কি সে কারণে খলনায়ক হয়ে গেছেন? মানুষ বিবেচনা করেছে তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। সে-কারণে আজকেও তিনি ভারতবর্ষে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন। ক্ষুদিরাম প্রাণ দিয়েছেন ধর্মীয় সংগঠনের পক্ষে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত থেকে। সে কারণে কি কেউ তাকে ঘৃণা করছে? না, করছে না। কারণ তার মূল লড়াইটা ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। কংগ্রেস এবং গান্ধী বা মুসলিম লীগ যখন ইংরেজদের সঙ্গে আপোষ করে করে ক্ষমতার ভাগ পেতে চাইছেন, ভগৎ সিং তখন লড়াই করেছেন সত্যিকারের জনগণের স্বাধীনতার জন্য। দুপক্ষই ইংরেজকে সরাতে চাইছে, কিন্তু ভিন্ন পন্থায়। ক্ষমতার ভাগ পেয়েছে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ। তখন কেউ কি বলেছে, কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের শাসনের চেয়ে ব্রিটিশ শাসন ভালো? সেকথা বলতে পারে একমাত্র সাম্রাজ্যবাদের দালালরা।

সকলের অধিকার আছে তালেবানদের সমর্থন করা বা না করার। কিন্তু  বহুজনের তালেবান সম্পর্কে মন্তব্যগুলি ভুল তথ্যে ভরা। কারণ তারা আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বা বিশ্ব সন্ত্রাসের মোড়ল ইঙ্গ-মার্কিন আর ভারতীয় প্রচারণা দ্বারা প্রভাবিত। ইঙ্গ-মার্কিন আর ভারতীয়দের প্রচার মানেই ‘মুসলমান মাত্রই জঙ্গি বা মৌলবাদী সন্ত্রাসী’। ভিন্ন কোনো পরিচয় নেই মুসলমানদের। যখন আফগানিস্তানের শতকরা নিরানব্বইজন মুসলমান, তখন তারা সন্ত্রাসী না হয়ে যায় না। এইসব মানুষদের বিচারে, আফগানিস্তানের বামিয়ানে বুদ্ধের মূর্তি রক্ষা করা মানেই ঐতিহ্য রক্ষা করা। হিন্দুধর্মের বহু কিছুকে রক্ষা করা মানেই ঐতিহ্য রক্ষা করা। কিন্তু ইসলামের ঐতিহ্যকে রক্ষা করা মানেই হলো সে কট্টর মুসলমান। যদি দেড়শো বছর আগের একটি পুরান মন্দির রক্ষা করা হয় তাহলে সেটা তাদের বিচারে ঐতিহ্য রক্ষা, আর মুসলমানদের পাঁচশো বছর আগের মসজিদ রক্ষা মানে ‘ধর্মপালন’; সেটা আর ঐতিহ্য নয়। যারা মন্দিরের ঐতিহ্য রক্ষার কথা বলেন, যারা বামিয়ানে বুদ্ধের মূর্তি রক্ষার কথা বলেন ঐতিহ্যের নামে, তারা কিন্তু বাবরি মসজিদ রক্ষার কথা বলেন না। যখন একটি রাষ্ট্রে আইন করে বাবরি মসজিদের ভুখণ্ড বা জমি মন্দিরকে দিয়ে দেয়া হলো, তখন এদের অনেকেই নীরব।

ধান ভানতে শিবের গাওয়ার মতো, অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে বলতে সময় চলে গেল। আগামী দিনের রচনায় তালেবানদের উৎপত্তির ইতিহাস, আফগানদের জীবন আর বিশ্ব-রাজনীতি, মাদক-চাষ আর তার ব্যবহার, আর অন্যান্য মর্মস্পর্শী বিষয় নিয়ে মাখমালবাফ সহ আরো অনান্য কয়েকজনের রচনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু আগে তালেবান এক দূতের দেয়া বক্তব্য উপস্থাপন করা হবে সেই সঙ্গে। বর্তমান তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণ নিয়ে কিছু বলার আগে কিছু ভাবনাচিন্তা করার আগে সকলের আফগানিস্তানকে ভালো করে চেনা দরকার। সৈয়দ মুজতবা আলীর আফগানিস্তান নিয়ে লেখা অবশ্যই পাঠ্য, তবে তার বাইরে আফগানিন্তানের সমাজ-রাজনীতির আরো বিশাল চিত্র রয়ে গেছে যা একান্তই বর্তমানকালের ঘটনা। চলবে