তালা ভাঙার পালা: সমাজ ও রাষ্ট্রের চুনকালি
পলিয়ার ওয়াহিদপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২০
‘তালা ভাঙার পালা’ প্রায় পড়া শেষ। দু’একটি গল্প বাকি। প্রীতির লেখার হাত সত্যিই শক্তিশালী। এবং একই সাথে সৌভাগ্যের। কারণ উত্তম পুরুষে সে যেভাবে গল্পের বয়ান তৈরি করে তা সত্যিই অসামান্য। তার লেখা হু হু করে ঢুকে পড়তে বাধ্য করে। বাক্যে বাড়তি মেদ নেই বললেই চলে। যা বলার তা খুব সরাসরি বলার একটা শৈল্পিক সুষমা লক্ষ্য করা যায়। সৎ ও সত্য বলার যে সাহস সে রপ্ত করেছে সেখানে সে সফল ও সুমগ্ন। কোথাও কোনো অস্পষ্টটা এবং জড়তা নেই। তার বেশির ভাগ চরিত্র ডেমকেয়ার। নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে তার সাহিত্য আলাপ যেমনি, মুগ্ধতার সন্ধান করে তেমনি লড়াইয়ের আভাসও দেয়। একজন পাঠককে প্রীতি শুধু ভালোলাগা উপহার দেয় না, সাথে সাথে রক্তে সাল্যাইনের মতো শক্তি জোগায়। সেখানেই মূলত প্রীতি আলাদা ও উন্মুক্ত।
তার ‘তালা ভাঙার পালা’ সিরিজের চারটি কেস স্টাডি সকলের পড়া উচিত। কীভাবে বাবা তার মেয়েকে দিনের পর দিন রাতের পর রাত ধর্ষণ করছে। কীভাবে মাদ্রাসার ছাত্রকে হুজুর বলাৎকার করে। কীভাবে শ্বশুর আব্বা ছেলের অনুস্থিতিতে বউমাকে ভোগ করে। কীভাবে স্যার ছাত্রীকে ভিডিও গেইমে ফেলে বছরের পর বছর ধরে শাস্তি দিচ্ছে। এসব জ্যান্ত গল্প প্রীতি তুলে এনেছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অসাধুতা ছেঁকে।
তার ‘আন্তর্জাতিক মানের দুঃখকষ্ট’ দারুণ একটা গল্প। দেশ-বিদেশ মিলে গল্পটি অন্যরকমের অভিজ্ঞতায় ভরপুর। গল্পটির প্রকৃত নায়ক (যার বর্ণনা খুব কম) শহীদ ভাইকে দেখার অজীবন তৃষ্ণা আমিও পুষে রাখলাম। প্রীতি উপমায় খুবই সমসাময়িক। তার ভাষা তীর্ষক ও বর্তমানে বাস করে। সাহিত্যের আলাদা মখমলময় ভাষাকে পরিহার করে মানুষের মুখের দৈনন্দিন ভাষাকে সে তুলে ধরে।
‘সিনেমা প্রিমিয়ার’ আমাদের চলচ্চিত্রের ছবির আড়ালের ছবি। এখানে নারী ও পুরুষের শারীরিক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সূচারুরূপে তুলে ধরা হয়েছে। এবং নিজে নারী হয়েও তার নারীর প্রতি মোটেও পক্ষপাতিত্ব নেই। তার লিটারেরি সততায় মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। ‘উপদেশের উপকথা’ গল্পটি ভেরি ইন্টারেস্টিং। সারসংক্ষেপ হলো, উপদেশ উপকারি নয়। তবে এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব নিদারুণ হাহাকার তৈরি করে।
‘আদর্শ ভাতের হোটেল’ সবচেয়ে আলোচিত এবং উপযোগিও। এখানে অবিবাহিত তরুণ তরুণীর লীলাময় দৈহিক চাহিদার রূপক নামটিই হলো আদর্শ ভাতের হোটেল। কারণ যৌনতাও নিয়মিত মৌলিক চাহিদার একটি। ফলে এটা নিয়ে রাখঢাকের তেমন প্রয়োজন নেই আর কি! ফলে বর্ণনা করা হয়েছে রসময় গুপ্তের স্টাইলে। রগরগে আর উজ্জলভাবেই সোনালি রূপালি সব দৃশ্যের অবতারণা করা হয়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো প্রীতি এই গল্প জুড়ে যতই শরীরিক ভঙ্গিমা ব্যবহার করুক না কেন, শেষে সততার জায়গায় নিয়ে নতজানু করে ফেলেন। এটাই প্রীতির সাহস ও সত্যের গল্প। আর এ কারণেই বোধহয় প্রীতিকে দূর থেকে কানাঘুষা না করে তার বই হাতে বসে যেতে হবে। তাহলেই তাকে ভালোভাবে বোঝা যাবে। তবে এখানে সংস্কৃতি ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর বিবাদ থাকলেও গল্পটি মোচড় দিয়ে যাবে পাঠককে।
শেষে ‘একটি ময়নাতদন্তের সুরতহাল’ যেন আমাদের ব্যর্থ রাষ্ট্রের হরহামেশায় ঘটে যাওয়া ঘটনা। কারণ আমাদের রিপোর্টগুলো সবসময়-ই রাজনৈতিক ও ভয়ংকরভাবে একচোখা। এখানে আমাদের কুমিল্লার তনু, দর্জির হাতে খুন হওয়া রিশা, বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা আবরারকে আমরা হাঁ করে থাকা কাতলা মাছের মতো শূন্য দৃষ্টিতে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই চরিত্রে গেঁথে দিয়েছে!
এইসব নানান কিসিমের উলঙ্গ আর অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়কে নির্বাচন করা প্রীতির জন্য যেমন বিপদজ্জনক তেমনি অনিরাপত্তার। তবু এই যে নির্যাতন, অবিচারের গান তিনি গাইছেন সেটা সত্যিই আমাদের জন্য যেমন আশা জাগানিয়া, তেমনি জাতির জন্য ভরসার। ব্যক্তি প্রীতির সঙ্গে সঙ্গে আমি আজ থেকে লেখক প্রীতিকেই সম্মান করব ও ভালোবাসবো।
গল্পের এই বইটি প্রকাশ করেছে পেন্ডুলাম পাবলিশার্স। প্রচ্ছদ এঁকেছেন রহমান আজাদ। দাম, ১৩৫। বইমেলার ২৭১ নম্বর স্টলে বইটি পাওয়া যাবে।