তারেক মাহমুদের ছোটগল্প ‘পরভাত’
প্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০২০
তখনো পাশের বাঁশঝাড় থেকে শব্দটি আসতেই থাকছে। হঠাৎ শব্দটি শুনলে যে কেউ আঁতকে উঠতে পারে। কিন্তু খিদিরপুরের বাসিন্দারা এসব শব্দ নিয়ে মোটেই ভাবে না। পুকুরের ওপারে একটা বাঁশঝাড়, তারপর ধু-ধু বিল। বর্ষার মৌসুমে যে বিল পরিণত হয় শুষ্ক মৌসুমে। এই বিলের আবাদি জমি থেকে যে ফসল উৎপাদিত হয় সেই ফসলের দৌলতেই খিদিরপুরের বাসিন্দারা দুবেলা দুমুঠো খেতে পায়। সেই ক্ষেতি জমিই তাদের ভরণপোষণের একমাত্র ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেই ফসল দিয়েই পালিত হয় সুন্নতে খাৎনার উৎসব, বিয়ের উৎসব, চল্লিশা পালন, জিয়ারত, মিলাদ মাহফিলসহ সবকিছু। এই জমিই তাদের অভিভাবক। জমি তাদের আশা পূর্ণ করলে তারা জমির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। আবার জমি তাদের আশা পূর্ণ না করলে, অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টির কারণে অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জমি তাদের ঠিকমতো ফসল না দিলে পিতার অবাধ্য সন্তানের মতো সেই জমির প্রতি তারা মরিয়া হয়ে ওঠে ঘৃণায়, বিরক্তিতে। তবুও সুখে-দুখে বাসিন্দাদের কেউ হয়ত শহরে যায়, পিয়ন, কেরানি, পুলিশ হয়। কেউবা গঞ্জে যায়, এটা ওটার দোকান পাট খোলে, কেউবা গরুর দালালি করে, কেউবা থানায় যায় কোর্টে যায়। তবুও শেষ পর্যন্ত তারা এই খিদিরপুর গ্রামেই ফিরে আসে।
ফিরে আসে বাধ্য সন্তানের মতো। ফিরে আসতে হয় তাদের। এই গ্রাম, গ্রামের পুকুরে, পুকুরের ঘাটে, আমবাগান, কাঁচা সড়ক, এই বিল, এই জমির টানে তারা ফিরে আসে কেউ বিফল হয়ে, কেউ সফল হয়ে। তাদের ফিরে আসতে হয় উৎসব-পার্বণে, মৃত্যুর খবরে, জন্মের খবরে। রাতের এই শেষভাগে বাঁশঝাড় থেকে শব্দটি আসছে কার্তিকের এই ধু-ধু বিলের বাতাস বাঁশঝাড়ের গায়ে এসে লাগছে। একটির সঙ্গে অন্য বাঁশের ঘর্ষণ আর বাঁশপাতার শব্দ মিলে এক অদ্ভুত গা ছমছম শব্দ ভেসে আসছে। কিন্তু তাতে কী এসে যায়? এই মধ্যরাতে জমে উঠেছে পাড়া, শুধুপাড়া নয় সমস্ত গ্রাম। শুধু গ্রাম নয় হয়ত সমস্ত দেশ। গ্রামের মানুষের কল্পনায় যে শহর আছে সে শহরও হয়তো জেগে উঠেছে। কিশোরের দল কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছে জেগে উঠবার গান। সমস্ত গ্রাম জেগে উঠেছে সেই কণ্ঠের প্রতিধ্বনিতে। নিশুতি রাত। বিদ্যুতের আলোর মুখ এখনো দেখেনি এই গ্রামবাসীরা। সোলার বেড়্য়া আড়াল করা চুলা জ্বলছে দাউদাউ করে। সেই চুলায় বসেছে হাঁড়ি, সেই হাঁড়িতে চড়েছে সেই বিলের ফসলের লাল লাল আমন ধানের চাল। চাল ফুটছে। এই চাল ফুটে কেবলই ভাত হচ্ছে না, হচ্ছে পবিত্র খাবার। সুখের ঘুম ছেড়ে মাঝবয়সী রোমেছার মা চুলায় বসিয়েছে খাদ্যসামগ্রী। তৈরী হচ্ছে পবিত্রখাদ্য।
রমজানের এই মধ্যরাতের আহার নির্মাণে তাদের ব্যস্ততার প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় হচ্ছে পবিত্র উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। কেউ ডাকে না, রোমেছার মা এটিই যেন তার নাম। গ্রামের মধ্যে যারা নাম ধরে ডাকবার যোগ্য তারা সবাই তাকে এই নামেই ডাকে। রোমেছার মা বড় বউ, মেঝ বউ আকলি। দুই জায়ে পাশাপাশি বসে রান্না করছে। দুজনের বড় মিল। খাওয়াদাওয়া, রান্নাবান্না সব আলাদা, একই বাড়িতে এই বিভাজন গ্রামাঞ্চলে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। যৌথ পরিবার বলে যে গল্প রয়েছে তা একালে প্রায় দুষ্প্রাপ্য। সেই গ্রাম এখন আর নেই। গ্রামের সেই প্রাচুর্যতা ৫০ বছর আগেই শেষ হয়েছে। যৌথ পরিবার বড়জোর এখন যৌথ বসবাসের মধ্যে আবদ্ধ। মেঝ বউ একটু উচ্ছ্বল। এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে প্রায় আট থেকে দশ বছর হবে। এই দশ বছরে তিন সন্তানের মা হয়েছে। ছোট দেবর বিয়ে করে শহরে বাস করে। রিকশা চালায়, বউ কাজ করে গার্মেন্টসে। বড় বউ রোমেছা সেদ্ধ মিষ্টি কুমড়োর তরকারিটুকু তেলে ছেড়ে দেয়। ঝন করে ওঠে। তুষের আগুন আরো একটু উসকে দিয়ে মেঝো বউ অর্থাৎ আকলি বলে ওঠে, ও বুবু ছোট মিয়া এইবার ঈদে আসপি না? রহস্যময় মুখ করে উত্তর দেয় রোমেছর মা, ক্যান? ছোট মিয়া না আসলি কি এ গাঁয়ে ঈদ হবিনে?
আকলি কৃত্রিম রাগ ঠোঁটে এনে বলে, বুবুজান যে কী কয় আমি কী সে কতা কচ্ছি, ছোট মিয়া আসলি ভালোই হতি, ওর বউডারে দেহি না কতদিন।
কড়াইয়ের মধ্যকার মিষ্টি কুমড়ার শরীর চামুচ দিয়ে উল্টে দিয়ে রোমেছার মা বলে, ছোট মিয়ার বউরে দেখতি মন চায় নাকি ছোট মিয়ারে দেখতে মন চায়? একথা বলে রোমেছার মা হেসে ওঠে। আকলিও এক মুহূর্ত কৃত্রিম মন খারাপ করে হেসে ওঠে। রোমেছার মা আবার বলে, ছোট মিয়ার জন্যি তোর মন পোড়ে নারে আকলি?
ও কতা কও ক্যা বুবু, তোমার পোড়ে না? এ বাড়ি আইসি সেই ছোট্ট পাইছিলেম। নিজের হাতে বড় করলাম, ইচ্ছে ছিল নিজের পছন্দমতো বিয়া দিবো, তো তা কি আর হইলি বুবু, শহরে যাইয়ে নিজেই বিয়ে করল। একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না।
ছোট মিয়া অর্থাৎ জমিরুদ্দিন মোল্লার ছোট ছেলে। জমিরুদ্দিনের তিন ছেলে তালিপ মোল্লা, জহির মোল্লা আর ছোট ময়েনউদ্দিন। আকলি যখন বউ হয়ে আসে এ বাড়িতে, তখন ময়েন কেবলি কিশোর। আড্ডাবাজ, সারা দিন টো টো করে ঘোরে গ্রামময়। সংসারের কোনো কাজে তার মন বসে না। এ পাড়া ও পাড়া করে সারা দিন সময় কাটে। গ্রামের যাত্রাগান, পালাগান, শহরের সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া— এসব করে করে অল্প বয়সেই সে পেকে গিয়েছিল। বড় ভাই, মেঝ ভাইয়ের প্রতিদিনের শাসন শারীরিক নির্যাতন এগুলো কোনও কিছুই ময়েনকে আয়ত্ব করতে পারেনি। কিন্তু মেঝবউ বাড়িতে আসবার মাস ছয়েকের মধ্যেই ময়েনের জীবনে আকাশ পাতাল ব্যবধান ঘটে গেল। মেঝভাবির আদর আর শাসনে সে তার অতীতের সমস্ত কর্মকাণ্ড ভুলে সুবোধ বালক হয়ে গেল। মেঝভাবি ছাড়া যেন তার চলেই না। মেঝভাবি ছাড়া খাওয়া হয় না, ঘুম হয় না, কিছুই হয় না। আর যে মেঝবউ ছোটমিয়ার উপর দুর্বলতা অর্থাৎ আকলির দয়ামায়া এক ধরনের প্রেমও বলা যায়— একটু বেশি।
কলাপাতা দিয়ে ঘেরা দেউরির ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে বৃদ্ধা মজিরনের মা। সমাজ সংসারের প্রতি এক উদাসীন মানুষ, এই মজিরনের মা। স্বামী গত হয়েছে প্রায় বছর দশেক। একটামাত্র ছেলে আর একটামাত্র মেয়ে। মেয়ে মজিরনের বিয়ে হয়েছে বহুদূরের গ্রামে। বছরে দুই একবার আসে। মাকে দেখতে। আর মা একবার যায় মেয়েকে দেখতে। নিজের বউমার দুর্নাম করতে এই বৃদ্ধার কোন জুড়ি নেই। বউটা খুব ভাল। তবুও শাশুড়ির নেক নজর পেল না কোনোদিন। এ বাড়ির বউগুলো অর্থাৎ রোমেছার মা এবং আকলি দুজনেই তাকে ভালোবাসে, চাচি বলে ডাকে। একহাতে লাঠিতে ভর দিয়ে সে রোমেছার মায়ের পাশে এসে বসে। আকলি নিজের বসবার পিরিটি এগিয়ে দেয় বৃদ্ধাকে। বসতে বসতে বলে, কি গো রোমেছার মা পরভাতে কি তরহারি রানতিচিস? উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বলে, আমারে মাগিডা কি রাঁদে, একটা দিনও পরভাতে যুত করে খাবির পারলাম না।
আকলি বলে, ক্যান চাচি, তোমার বউয়ের সুনাম তো সারা পাড়ায়, তোমারে ঠিকমত খাবির দেয় না।
আর কইস নাগো, মাগির দেমাগ ভারী, বাপ মা মন্দ হইলি কি আর ছাওলপাল ভাল হয়।
রোমেছার মা একটু তরকারি বাটিতে করে এগিয়ে দেয় বৃদ্ধার সামনে। লেওগো চাচি একটু খাইয়া দেহো কেমন লাগে। আশা মিটিয়ে ছেলের বউয়ের দুর্নাম করে তারপর বৃদ্ধা ওঠে। রান্নাবান্না শেষ হয় তাদের শাশুড়ি বাটায় পান বাটছে, কুট কুট, ঠুক ঠুক শব্দ রাতের অন্ধকারে যেন আরও বেশিগুণ হয়ে চারদিকে জোরালো করে তুলছে। জমির মোল্লা ওঠে এঘর থেকে ওঘর থেকে তালেব মোল্লা, সে ঘর থেকে ওঠে জহির মোল্লা, বাড়ির বিভিন্ন বয়সের পুরুষরা জেগে ওঠে। ছেলেমেয়েগুলো তখনও ঘুমিয়ে, যেন তারা জাগতে না পারে সে চেষ্টা সকলের। বড় বউয়ের বড় মেয়ে রোমেছা গেছে হামচিয়া পুরে। আর সবাই ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। অঘোর ঘুমে বিভোর তারা। দুই বউ রান্না বান্না নিয়ে যায় যে যার ঘরে। যে যার কর্তার সঙ্গে রমজানের এই গভীর রাতে পবিত্র খাওয়া দাওয়া শুরু করে। দুই বউ দুইভাবে শশুর শাশুড়ির জন্য আলাদা করে খাবার গুছিয়ে দিয়ে আসে। সারাপাড়ায় মাটির কুপি জ্বালিয়ে খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত। কারো টিনের ঘর, কারো ছনের, কারো ঘরের বারান্দা আছে কারো নেই। কারো আধাপাকা ঘর, তবে সবার বাড়িতে একটা বিশেষ মিল আছে সেটা হলো, সব বাড়িতেই কিছু কিছু গাছপালা রয়েছে। বিভিন্ন রকম গাছ প্রত্যেকের বাড়িতেই। দু’পাশে বাড়িঘর মাঝখান দিয়ে কাচা সড়ক চলে গেছে বহুদুর।
গ্রামের মধ্যে দুটো মসজিদ একটা মাদ্রাসা একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ও রয়েছে। প্রার্থনা আর শিক্ষা গ্রহণের জন্য আপাতত অবলম্বন এই অদ্ভুত চারদিক। দিনের পৃথিবীর সঙ্গে এই পৃথিবীর মিল নেই। যেন কোন চারিদিক শান্ত কাঁচা সড়কটিতে আঁকা ছবির মত স্থির মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই সড়ক দিয়ে কোনোদিন কেউ যায়নি। এ সড়ক চিত্রময়। কোন মহৎ শিল্পীর আঁকা এই কাঁচাসড়ক। এই বাঁশবাগান, এই পুকুর ঘাট, এই বিশাল আকাশ, এই বৃক্ষ শোভিত গ্রাম, এই বাতাস, এই বিভিন্ন আকৃতির ঘর। এই রূপালি রাত। এ সবকিছু যেন একই ক্যানভাসে এঁকেছে সেই মহান শিল্পী একটি যেন সেই ছবি। একটি ছবিই যেন এঁকেছেন সেই মহৎ শিল্পী। সারা গ্রাম মেতেছে একই উৎসবে এই এক মিলন মেলায়। যা কী কোনও জাগতিক নেতার আদেশে সম্ভব? পরভাতের খাওয়া শেষ হয়, জমির মোল্লা বউয়ের কাছ থেকে একটি পান নিয়ে মুখে দেয়। এ ঘর ওঘরে বাতি নিভে যায়। জমির মোল্লা মেছওয়াক করতে করতে পুকুরঘাটে যায়। আযানের শব্দে সারা গ্রামে যেন শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
জমির মোল্লা পুকুরের ঘাটে বসে ওযু করে, আলো আঁধারের এই নির্ভেজাল পরিবেশ বেহেস্তের স্বাদ এনে দেয়। এই নিস্তব্ধ পুকুর যেন এক অসীম শক্তির প্রতিক এই মুহূর্তে। ওযু করা শেষ হলে টুপির বুকে একটা ফুঁ দিয়ে মাথায় পরে জমির মোল্লা মসজিদের দিকে হাঁটা দেয়।
সেহরিকে আমাদের পাবনার মানুষেরা ‘পরভাত’ বলে। এখন এই শব্দটির প্রচলন কম