মেঘনাদ সাহা
তাপ-আনয়ন তত্ত্ব ও মেঘনাদ সাহা
ছায়াবীথি শ্যামলিমাপ্রকাশিত : অক্টোবর ০৬, ২০২৪
যার ভেতর জানার আগ্রহ যত বেশি, মানুষ হিসেবে সে তত মহৎ। কিন্তু আজকের দিনে এরকম মহৎ মানুষ আতশি কাচ দিয়ে খুঁজলেও ভাগ্যে দু’একজন পাওয়া যেতে পারে। এই যে মহাবিশ্ব, কত কত গ্রহ-নক্ষত্র, এসব কি? আমরা কোথায় আছি? পৃথিবীর অবস্থান কোথায়? এসব প্রশ্ন যার ভেতর জাগে না, তার সঙ্গে হাঁস-মুরগির খুব বেশি তফাৎ আমরা করতে পারি না। জগৎ ও জীবনকে জানতে হলে বিজ্ঞান পড়ার বিকল্প নেই। যে মানুষ মনোযোগ দিয়ে বিজ্ঞান পড়ে, সে-ই জানে, জগৎ সম্বন্ধে নতুন নতুন তথ্য জানাতে কী আনন্দ।
সত্যি বলতে কি, বিজ্ঞানের চেয়ে মজার জিনিস আর কিছুই হতে পারে না। সময়ের প্রসারণ, দৈর্ঘ সংকোচন আর ভর বৃদ্ধির বিষয়গুলো আমরা ধারণা, রূপকথার মায়াপুরির জগৎ থেকেও রহস্যময়। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ জাতির, এ দেশে বিজ্ঞানীদের গল্প তেমন নেই। যাদের নাম আমরা গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারি তেমন দুজন হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার সাবেক অধ্যাপক সত্যেন বোস। অন্যজন মেঘনাদ সাহা। মেঘনাদ সাহা জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের জন্য মহামূল্যবান একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। তাপ-আনয়ন সূত্র।
আমাদের এই বিশ্ববহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে আছে কোটি কোটি নক্ষত্র। কী কী উপাদানে তৈরি সেইসব নক্ষত্র? বিজ্ঞানীদের হাজার বছরের প্রশ্ন। অনেক বিজ্ঞানীই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নানা উপায়ে। এগুলোর মধ্যে কিছু ছিল যৌক্তিক আবার কিছু ছিল দুর্বল। মোটকথা একটা নক্ষত্রের আভ্যন্তরীণ উপাদানের যুৎসই হিসাব মেলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন বিজ্ঞানীরা। এ সমম্যা সমাধানে এগিয়ে এগিয়ে এলেন আমাদের বাংলাদেশের ছেলে মেঘনাদ সাহা। ১৯২০ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তার তাপ-আনয়ন তত্ত্ব। রাতারাতি বিখ্যাত বনে যান তিনি।
১৯২৭ সালে আরেক বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ আলফ্রেড ফাওলারের সুপারিশে মেঘনাদ লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। কী বলেছিলেন সাহা তাপ-আনয়ন তত্ত্বে? এটা বুঝতে হলে আমাদের আগে বুঝতে হবে আয়ন কী? আমরা জানি, ইলেকট্রন, প্রোটনের ও নিউট্রনের সমন্বয়ে পরমাণু তৈরি হয়। আর কোনো পরমাণু থেকে একটা-দুটো ইলেকট্রন কিংবা প্রোটন সরিয়ে নিলে সেই পরমাণুর প্রকৃতি বা ধর্ম বদলে যায়। সরানোর এই কাজটা করা হয় তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে।
পরমাণুর স্বাভাবিক অবস্থায় তাতে সমান সমান ইলেকট্রন ও প্রোটন থাকায় সে চার্জ নিরেপক্ষ থাকে। যখনই সেখান থেকে একটা ইলেক্ট্রন সরিয়ে নেয়া হলো, তখন সেই নিরপেক্ষ অবস্থা আর থাকে না। একটা নেগেটিভ চার্জ কম পড়ে যায়। অর্থাৎ একটা পজেটিভ চার্জ বেশি হয়ে যায়। তাই পরমাণুটিও পজেটিভ চার্জে চার্জিত কণার মতো আচরণ শুরু করে। তেমনি কোনো পরমাণু থেকে একটা পজেটিভ চার্জ সরিয়ে নিলে পরমাণুটি নেগেটিভ চার্জে চার্জিত কণার মতো আচরণ করে। পরমাণুর এই চার্জিত অবস্থাকে আয়নিত অবস্থা বলে। চার্জিত পরমাণুকে বলে আয়ন আর চার্জিত হওয়ার প্রক্রিয়কে বলে আনয়ন।
১৯১৩ সালে বিজ্ঞানী নীলস বোর পরমাণুর গঠন প্রক্রিয়ার ওপর প্লাঙ্কের কোয়ন্টাম তত্ত্ব প্রয়োগ করে দেখেন, উচ্চ তাপমাত্রায় পরমাণুর অভ্যন্তরীণ কাঠানো ভেঙে পড়ে এবং পরমাণু আয়নিত হয়। তিনি এই পরীক্ষার সাহায্যে পরমাণুর ভেতর খবর পর্যন্ত জানতে সক্ষম হন। তিনি হিসাব কষে পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনের বিভিন্ন কক্ষপথের শক্তি নির্ণয় করতে সক্ষম হন। কতটুকু তাপ প্রয়োগ করলে একটা ইলেকট্রনকে পরমাণুর ভেতর থেকে সরিয়ে নেয় যাবে, ইলেকট্রনকে এক শক্তিস্তর থেকে আরেক শক্তিস্তরে যেতে গেলে কতটুকু তাপ বা শক্তি প্রয়োজন হবে, সেটাও তিনি অঙ্ক কষে দেখান।
শুধু তাই নয়, তার কাছ থেকেই আমার প্রথম জানি, ইলেট্রন উচ্চশক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে যাওয়ার সময় করে শক্তির উৎপাদন করে আর সেই শক্তি আমরা দেখতে পাই আলোক বর্ণালি হিসেবে। মেঘনাদ সাহা বুঝেছিলেন, নক্ষত্রের ভেতরে উপাদান ধারণা পাওয়ার একটাই উপায়। নক্ষত্র থেকে বিকিরিত আলোক রশ্মির প্রকৃতি জানতে হবে। সেই সাথে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। নীলস বোরের তত্ত্ব ব্যবহার করলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। সাহা কোমর বেঁধে হিসেব করতে শুর করলেন। তিনি নক্ষত্র থেকে বিকিরিত বর্ণালিতে বোর তত্ত্ব প্রয়োগ করে দেখেন, নক্ষত্রের ভেতরের উচ্চতাপমাত্রায় নক্ষত্রের গ্যাস পরমাণুগুলো আয়নিত হয়ে পড়ে। নক্ষত্রের উচ্চ তাপমাত্রার কারণে গ্যাস পরমাণু থেকে ইলেকট্রন খসে পড়ে, পরমাণু আয়নিত হয়ে যায়। তখন সেই আয়নিত পরমাণুর ভেতর থেকেই আলোক বর্ণালি নিঃসৃত হয়। আমরা সেই বর্ণালিকে দেখি নক্ষত্রের আলো হিসেবে।
মেঘনাদ সাহা এই তাপ-আনয়ন তত্ত্ব প্রয়োগ করে সূর্যের বর্ণমণ্ডলের আয়নন ও নিঃসৃত বর্ণালির ব্যাখ্যা দেন। এটাই হলো তার তাপ-আনয়ন সূত্র। সাহার এই তত্ত্ব পরবর্তী কালে ব্ল্যাক হোল থিয়োরিতে সফলতার সাথে ব্যবহৃত হয়। সাহার এই তাপ-আনয়ন সূত্র বিজ্ঞান জগতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে। জ্যোতির্বিদ আর্থার এই তত্ত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘সাহার আয়নন তত্ত্ব গ্যালিলিওর দূরবীন জ্যোতির্বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ দশটি আবিষ্কারের অন্যতম বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।’ জোতির্বিজ্ঞানে নবযুগ সৃষ্টিকারী মেঘনাদ সাহার জন্ম ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকার শেওড়াতলী গ্রামে। শেওড়াতলী এক অজ পাড়া গাঁ। গ্রামে একটা স্কুল পর্যন্ত ছিল না। সাহা প্রতিদিন দশ কিলোমিটার হেঁটে শিমুলিয়া গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে যেতেন। অভাবের তাড়নায় এত পরিশ্রমে অর্জিত বিদ্যালাভের সুযোগটাও হোঁচট খেয়েছে বারবার। অনন্ত কুমার দাস নামের এক ভদ্রলোকের দয়ায় লেখাপড়াটা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন তিনি।
শিমুলিয়া স্কুল থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পাশ করার পর ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। এই স্কুলে অধ্যায়ন কালে বিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন সাহা। তাতে তার শিক্ষাজীবনে কোনো প্রভাব পড়েনি। এর একদিন পরেই ভর্তি হন কিশোরীলাল জুবলি স্কুলে। সেখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পূর্ববঙ্গের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করেন। ঢাকা কলেজ আইএসসি তে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান লাভ করেন। এরপর ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে বিএসসিতে গণিতে অনার্সসহ তৃতীয় এবং এমএসসিতে মিশ্র গণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। দুটি পরীক্ষাতেই প্রথম স্থান লাভ করেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বোস।
ভারতবর্ষে সবচেয় বড় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র কলকাতা বিদ্যালয়ের সাহা ইনিস্টিটিউটের নামকরণ তার নামে। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রয়ারি মহান এই জোর্তিবিদের জীবনাবসান হয়।