তানিকাওয়া শুনতারো
তানিকাওয়া শুনতারোর কবিতা
অনুবাদ: ফিরোজ এহতেশামপ্রকাশিত : মার্চ ১৫, ২০২৩
তানিকাওয়া শুনতারোর জন্ম ১৯৩১ সালে, জাপানের টোকিওতে। বিখ্যাত দার্শনিকের সন্তান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তার ছিল এক ধরনের অবজ্ঞা। বরং লিখালেখিতেই তিনি মনোযোগ দেন পুরোপুরি। ১৯ বছর বয়সেই তানিকাওয়া শুনতারো রীতিমতো বিখ্যাত কবি। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতার বই `সলিচুউড অব টু বিলিয়ন লাইট ইয়ারস`। যখন তিনি লেখালেখি আরম্ভ করেন তখন জাপানি কবিতাকে শাসন করতো Waste Land Group, জাপান-যুদ্ধের ধ্বংলীলার ওপরেই আবর্তিত যাদের চিন্তা-ভাবনা। যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের একজন তরুণ হিসেবে তানিকাওয়া উপলব্ধি করেছিলেন, ‘যুদ্ধে পরাজয়ের পর ধ্বংস হয়ে গেছে সমস্ত জাপানি মুল্যবোধ।’ ফলে তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন ও সেদিকেই নজর ফেরান। তিনি এমন কিছু সন্ধান করছিলেন যাকে তিনি বলতেন ‘বিশ্বজনীন চেতনা’, অর্থাৎ অতীত ও ভবিষ্যতের ঊর্ধ্বে, সাংস্কৃতিক ব্যবধানের বাইরে, সবরকম কাব্যিক ঘরানার বাইরের একটা চিন্তা-চেতনা। এটাকে স্থূল উক্তির মতো শোনালেও মনে রাখতে হবে যে, তানিকাওয়া জোর দিয়ে বলেন, ‘আমার নিজের কাজে আমি একরকম অপছন্দ করি বিয়োগান্ত, বেদনাবিধুর এবং অতিরঞ্জিত বিষয়গুলোকে, যে-জিনিসগুলো তরুণ লেখকদের খুবই পছন্দের। এমনকি যখন আমি অতিরঞ্জিত কোনো জিনিস লিখি সেখানেও ইচ্ছা করি বজায় রাখতে, খানিকটা কৌতুকি উপায়ে, বিষয়গততার বোধ।’ তিনি শিশুদের জন্য লিখেছেন প্রচুর। কাজ করেছেন বেতারে, চলচ্চিত্রে ও টেলিভিশনে। কবিতা ছাড়াও তিনি রচনা করেছেন নাটক, চিত্রনাটক; করেছেন কমিক্সের অনুবাদ। তিনি কবিতায় প্রবেশ করেছেন প্রথমত ছন্দের লালিত্যের মধ্য দিয়ে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন নিরীক্ষার মাধ্যমে এসে ভিড়েছেন ঋজু ও টানটান গদ্যরীতিতে। The penguin book of JAPANESE VERSE গ্রন্থ থেকে তার কবিতাগুলো ভাষান্তরিত করেছেন ফিরোজ এহতেশাম।
যখন বাতাস বইছে প্রবল বেগে
যখন বাতাস বইছে প্রবল বেগে
কারো ঘুড়ি বলে মনে হয় পৃথিবীকে।
কিন্তু যখন মধ্য-দুপুরবেলা,
মানুষেরা দেখে রীতিমতো কোনো রাত এসে খেলা করে।
বাতাস করে না কোনো ভাষা ব্যবহার,
ঘুরপাক খায় কেবল যখন অস্থির হয়ে পড়ে।
অন্য অনেক তারাদের বায়ুপ্রবাহের কথা ভাবি,
বাতাসেরা হতে পারে কি-না দেখি পরস্পরের সখা।
পৃথিবীতে আছে দিবস রয়েছে রাতও।
তারারা কী করে রাত ও দিনের মাঝে?
নিশ্চুপ আর বিস্তারমান তারা,
কেমন উপায়ে টিকে আছে তারা আজও?
দিনের আলোয় দেখি নীলাকাশ মিথ্যা ভাষণ করে।
যখন রাত্রি ধীরে ধীরে করে সত্য উদ্ভাসন,
আমরা তখন থাকি ঘুমে অচেতন।
এবং সকলে সকালে উঠেই স্বপ্ন দেখেছি বলি।
দুইশত কোটি আলোকবর্ষের ব্যবধান
মানুষেরা তার ছোট্ট বলের ওপরে,
ঘুম যায়, জেগে ওঠে আর কাজ করে,
পেতে চায় সঙ্গ মাঝে মাঝে মঙ্গলের।
মঙ্গলের অধিবাসী অধিবাসিনীরা
তাহাদের ছোট্ট বলের ওপরে—
কী করে, জানি না আমি।
হতে পারে ঘুম যায়, জেগে ওঠে আর
কাজ করে থাকে তারা।
তবে তারাও প্রায়শই করে পৃথিবীর সাহিত্য কামনা—
এটা তো নিশ্চিত।
মহাকর্ষ
অবিচ্ছিন্ন করে রাখে সব ব্যবধান।
মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়,
আর একত্রিত করি আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে।
ফুলেফেঁপে ওঠে মহাবিশ্ব
আর আমরা অস্বস্তি বোধ করি সকলেই।
দুইশত কোটি আলোকবর্ষের ব্যবধান
অনিচ্ছুক হাঁচি দিতে প্ররোচিত করে আমাদের।
বেড়ে ওঠা
তিন, আর
আমার জন্য কোনোই অতীত নাই।
পাঁচ,
আমার অতীত গতকাল ছুঁয়ে যায়।
সাত,
আমার অতীত পৌঁছে আমার চূঁড়া করে বাঁধা চুলে।
একাদশ, আর
উপনীত হয় আমার অতীত ডাইনোসরের কালে।
চৌদ্দ,
পাঠ্যবইয়েরা বলছে যেসব আমার অতীত তা-ই।
ষোল, আর
ভয়ে ভয়ে আমি তাকিয়ে রয়েছি অনন্তে অতীতের।
আঠারো, এবং
সময় বিষয়ে এর বেশি জানা নাই।
পরিবার
দিদি,
কারা আসে গির্জার মিলনায়তনে?
আসছি আমরাই।
দিদি,
এটা কী উঠছে সিঁড়ির ওপরে ফ`লে?
আমরাই ফ`লে উঠছি তরুণ ভ্রাতা:
তুমি আর আমি, জননী এবং পিতা।
কার্যকলাপ করছি বাহিরে, অনাবৃষ্টির মাঝে।
আহার করছে কারা টেবিলের
ওপরের রুটিগুলো?
করছি আহার আমরাই ছিঁড়ে ছিঁড়ে,
আমাদের এই নখের তীক্ষ্ণতায়।
তবে, কে তোমার রক্ত করছে পান,
ও আমার দিদিমণি?
উঁচুদেহী আর সুমধুর কণ্ঠের,
সে হয় একটি মানুষ জানো না তাকে।
দিদি, দিদি, তুমি কী-বা করছিলে
ভেতরে, শস্যাগারে?
সে এবং আমি একটি মন্ত্র করেছি উচ্চারণ,
যদি সকলেই মরে যাই এই ভয়ে।
আর তাই?
আর তাই পরিপূর্ণ আমার স্তন
কেননা এবার আমাদের মাঝে আসবে আরেক জন।
কে সে?
সে তো তুমি আর আমি আর
আমাদের জনক ও জননী।
কে আসবে, সেই আমরা যখন
রাত্রিকালীন এবাদতে নিয়োজিত?
কেউ নয়
দিক নির্দেশক হাওয়াযন্ত্রের ওপরে
কেউ নয়
ঐ দূরে রাস্তার ধুলোর ওপাশে
কেউ নয়
কূপের আড়ালে সন্ধ্যায়
আমরা এখানে সকলেই।