তানভীর রাতুলের প্রবন্ধ ‘প্রেমের প্রকৃতি’
প্রকাশিত : মে ১১, ২০২২
যদি ধরে নেওয়া হয় প্রেমের একটি প্রকৃতি আছে, তবে তা কিছুটা হলেও ভাষার ধারণার মধ্যে বর্ণনাযোগ্য হওয়া উচিত। কিন্তু বর্ণনার উপযুক্ত ভাষা বলতে যা বোঝায় সেটাও হয়তো প্রেমের মতোই দার্শনিকভাবে বিভ্রান্তিকর হতে পারে। এই ধরনের বিবেচনাগুলি ভাষার দর্শন এবং অর্থের প্রাসঙ্গিকতা ও উপযুক্ততা ইত্যাদি প্রসঙ্গকে টেনে আনে। তবে তারা প্রেমের প্রথম নীতিগুলি নিয়ে গঠিত একটা বিশ্লেষণও প্রদান করে। প্রেম কি বিদ্যমান? আর যদি তা হয় তবে এটা কি জ্ঞাত, বোধগম্য ও বর্ণনাযোগ্য? ভালোবাসা অন্যদের কাছে হয়তো বোধগম্য হতে পারে ‘আমি তোমার প্রেমে পড়েছি’, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’... ইত্যাদি বাক্যাংশের মাধ্যমে, তবে এই বাক্যগুলিতে ভালোবাসার অর্থ কী সেটার ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ করা যায় না। অর্থাৎ, ভালোবাসার ধারণাটি অপরিবর্তনীয়, সরলীকরণ করা যায় না এমন— একটি সর্বজনবিদিত, স্বতঃসিদ্ধ বা স্ব-প্রকাশ্য এমন অবস্থা যা আর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক অনুপ্রবেশের নিশ্চয়তা দেয় না।
প্রেমের জ্ঞানতত্ত্ব জিজ্ঞাসা করে, মানুষ কীভাবে প্রেমকে জানতে বা চিনতে পারে, কীভাবে মানুষ প্রেমকে বুঝতে পারে, অন্যদের বা নিজেদের প্রেমে পড়া সম্পর্কে বিবৃতি দেওয়া সম্ভব বা যুক্তিযুক্ত কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন। যেসব প্রশ্ন ব্যক্তিগত জ্ঞানের বনামে জনসাধারণের সামানে বা প্রকাশ্য আচরণের দার্শনিক বিষয়কে ছুঁয়ে যায়। আবার, প্রেমের জ্ঞানতত্ত্ব ভাষার দর্শন ও আবেগের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। যদি প্রেম কেবলমাত্র একটি মানসিক অবস্থাই হয়, তবে যুক্তিযুক্তভাবেই যায় যে, এটি একটি ব্যক্তিগত ঘটনা যা অন্যদের দ্বারা উপলব্ধি ও অভিগমন করা যায় না। শুধু ভাষার একটি অভিব্যক্তি দিয়েই প্রেমসংক্রান্ত মানসিক অবস্থা বোঝানো সম্ভব, আর শ্রোতা, বক্তা, একজনের বলা আর অন্যজনের শোনা, সবকিছুর জন্যই সেই ভাষাটা প্রকৃত মানসিক অবস্থার দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ সূচক বা নির্দেশক হতে পারে। ইমোটিভিস্ট বা ভাবক্রিয়াবাদীরা মনে করে, আমি প্রেমে পড়েছির মতো একটি বিবৃতি আদতেই অপরিবর্তনীয়।
এটা অন্যান্য বিবরণ বাক্যের সাথে মিলিয়ে সরলীকরণযোগ্য করার অযোগ্য। কারণ এটি একটি অপ্রস্তুত উচ্চারণ বা প্রস্তাবনাহীন বাচন। তাই এবাক্যের সত্যতা ও সত্যনিষ্ঠতা তদন্তের ঊর্ধ্বে। ফেনোমেনোলজিস্ট বা প্রপঞ্চবাদীরা একইভাবে প্রেমকে একটি অজ্ঞায়ী বা অজ্ঞানমূলক ঘটনা হিসাবে উপস্থাপন করতে পারে। প্লেটোর জ্ঞানীয় বা জ্ঞানভিত্তিক আদর্শ প্রেমকে ঘুরিয়ে বললে বলা যায়, ভালোবাসা নিজেই... একজনের অন্তর থেকে চির-উন্নত মূল্যবোধের ক্রমাগত উত্থান ঘটায়— ঠিক যেন এটি নিজস্ব ইচ্ছা-স্বভাবেই সেই ব্যক্তির ভেতর থেকে প্রবাহিত হচ্ছে, প্রেমিক বা প্রেমিকার পক্ষ থেকে কোন প্রকার পরিশ্রম আর ইচ্ছা ছাড়াই। তখন একজনের সামনে অন্যজন নিষ্ক্রিয়।
ভালোবাসা জিনিসটা পরীক্ষা করা যায় না বলার বিপরীতে, ভালোবাসা পরীক্ষা করা উচিত নয়, এইবক্তব্যটি জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবেই আলাদা— মানে, ভালোবাসার দুর্দান্ত ঐশ্বরিক-আবেগপ্রবণ প্রকৃতি এবং রহস্যময়তার প্রতি কর্তব্যপরায়ণ সম্মান দেখিয়ে এটাকে চিন্তাভাবনা বা মনের নাগালের বাইরে রেখে দেওয়া উচিত। কিন্তু যদি সম্মত হওয়া যায় যে, ধারণাগতভাবে বলতে গেলে ভালোবাসার মতো আরো একটি জিনিস আছে, যখন লোকেরা প্রেম সম্পর্কিত বিবৃতি উপস্থাপন করে, বা আরও বেশি ভালবাসার মতো তুলনা উপস্থাপন করে, তাহলে হয়তো এটাকে দার্শনিক পরীক্ষার উপযুক্ত মনে করে প্রশ্ন আসতে পারে: ভালোবাসা কি নির্দিষ্ট কোন নিদর্শনের বা আচরণের সমার্থক? কার্যকলাপ, কণ্ঠস্বর বা ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার পদ্ধতিতে ব্যতিক্রমিতার নামই কি প্রেম? নাকি কোন নির্দিষ্ট মূল্যবোধকে আপাত অনুসরণ এবং সুরক্ষার নাম এটা?
যদি প্রেমের কোনো একটা প্রকৃতি থেকেই থাকে যা কিছু উপায়— যেমন, ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি, আচরণের একটি সুস্পষ্ট ধরন বা ছাঁচ, বা অন্যান্য কার্যকলাপ, ইত্যাদি দিয়ে সনাক্তও করা যায়; তারপরও যে জিজ্ঞাসাটা করা যেতেই পারে তাহলো, সেই প্রকৃতিটা আদতেই মানুষের গুণাবলি বা মানবতা দিয়ে সঠিকভাবে বুঝতে পারা যায় কিনা। প্রেমের হয়তো একটি প্রকৃতি বা ধরণ থাকতেই পারে, আর তারপরও হয়তো মনুষ্যপ্রজাতি প্রেমের সেই প্রকৃতির প্রকৃতরূপ অনুযায়ী বোঝার জন্য উপযুক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার অধিকারী নাও হতে পারে। সক্রেটিস যেমন সিম্পোজিয়ামে যুক্তি দিয়েছেন— মানুষ সম্ভবত তেমনি বড়জোর প্রেমের সারাংশের আভাস পেতে পারে, কিন্তু এর আসল প্রকৃতি চিরকালই মানবতার বুদ্ধিবৃত্তিক উপলব্ধির বাইরে। তদনুসারে, দ্বান্দ্বিক ও বিশ্লেষণাত্মক বা বৈশ্লেষিক ব্যাখ্যা প্রদর্শন করে প্রেম ধারণাটির ইঙ্গিত বা বড়জোর আংশিকভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে, কিন্তু স্বতই ভালোবাসা নিজের ভেতরে কি জিনিস, তা কখনই বোঝা যায় না।
তাই প্রেম এক অভূতপূর্ব ঘটনা-ছাড়ানো সত্তা হয়ে উঠতে পারে, যা প্রেমে পড়া মানুষের ক্রিয়াকর্ম থেকে উদ্ভূত, কিন্তু যা কখনই মন অথবা ভাষা, কোনটাতেই ধরা পড়ে না। প্রেমকে প্লেটোনিক-রূপ হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে, যা অতীন্দ্রিয় ধারণামণ্ডলের উচ্চতর অঞ্চলের অন্তর্গত যেটার বিশুদ্ধতা নশ্বররা কল্পনাও করতে পারে না, সেটার খুবই অল্প একটু আকার-আকৃতির ধারণাগত ছায়ার আভাস পায় শুধু, অল্প ততটুকুই যতটুকু কেবল যুক্তি এবং তর্ক দিয়ে উন্মোচন বা প্রকাশ করা যায়।
আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি যেটাও কিনা প্লেটোনিক দর্শন থেকে উদ্ভূত, প্রেমকে শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানুষের বোধগম্য বিষয় বলে মনে করে, যেন এটা আর কারো বুঝতে পারার কথা নয়। এ ধরনের আদর্শগত দর্শন অনুক্রমিক জ্ঞানতত্ত্বকে আবাহন বা আমন্ত্রণ জানায়, যেন শুধুমাত্র অভিষিক্ত, অভিজ্ঞ, বিজ্ঞ, দার্শনিক, বা কাব্যিক বা সুশ্রাব্য সুরেলা, এমন উচ্চস্তরের মানুষরাই প্রেমের প্রকৃতি সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী। একটা স্তরে এটা স্বীকার করে যে শুধুমাত্র অভিজ্ঞরাই প্রেমের প্রকৃতি জানতে পারে, যা যে কোনো অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেই সত্য বলে পরিগণিত, তবে আরেকটা স্তরে এটা সামাজিক বিভাজনের ইঙ্গিতও প্রতীয়মান করতে পারে— যে শুধুমাত্র দার্শনিক বা রাজারাই সত্যিকারের প্রেম সম্পর্কে জ্ঞান ধারণ করে। প্রথম নিহিতার্থ, যারা প্রেম অনুভব করে না বা প্রেমের অভিজ্ঞতা নেই তারা ভালোবাসার প্রকৃতি বুঝতে অক্ষম, যদি না আচার-ব্যবহার, দ্বান্দ্বিক দর্শন, শৈল্পিক প্রক্রিয়া ইত্যাদির মাধ্যমেই কেবল অর্জন করা হয়। পক্ষান্তরে, দ্বিতীয় অন্তর্নিহিত ইঙ্গিত, যদিও এটি যৌক্তিকভাবে প্রয়োজনীয় অনুমিতি বা অনুমান নয়, এটাই পরামর্শ দেয় যে, অ-দীক্ষিত, বা যারা বুঝতে অক্ষম, তারা শুধুমাত্র শারীরিক ইচ্ছা অনুভব করে, প্রেম নয়। ফলে, ভালোবাসা হয় চিন্তাজগতের সবচেয়ে উচ্চতর অনুষদের অন্তর্গত, যা বোঝার জন্য কোনোভাবে বা আকারে শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। অথবা এটি অগ্রগামী সমাজের সবচেয়ে উচ্চতর সম্প্রদায়— রাজন্য, যাজক, দার্শনিক, শৈল্পিক, কাব্যিক, প্রভৃতি শ্রেণির অধিকারভুক্ত। অশিক্ষিত, অক্ষম, বা অল্পবয়সী এবং অনভিজ্ঞ — যারা প্রেমের উপযোগী নয় — তারা কেবল শারীরিক আকাঙ্ক্ষাই অনুভব করার মতই ধ্বংসমুখী। প্রেম থেকে শারীরিক আকাঙ্ক্ষার এই বিচ্ছেদ ঘটানো রোমান্টিক বা আবেগময় প্রেমের প্রকৃতি সম্পর্কে তদতিরিক্ত প্রভাব ফেলে।
ভাব বা আবেগপ্রবণ প্রেমকে শুধুমাত্র যৌন বা শারীরিক আকর্ষণের চেয়ে উচ্চস্তরের অধিবিদ্যক বা আধিভৌতিক এবং নৈতিক মর্যাদায় গণ্য করা হয়। ভাবাবেগসমৃদ্ধ প্রেমের ধারণাটি প্লেটোনিক ঐতিহ্য প্রাথমিকভাবে অনুযায়ী মনে করে যে, প্রেম হল সৌন্দর্যের আকাঙ্ক্ষা — যার `মূল্য` শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে তোয়াক্কা করে না। প্লেটোর মতে, সৌন্দর্যের প্রেম চূড়ান্ত পরিণতি পায় চিন্তা বা দর্শনের প্রেম হয়ে — যেখানে প্রেমিকপ্রেমিকাদের কাজ ভাবনাজগতের সর্বোচ্চ ক্ষমতাটা অন্বেষণ করা। রোমিও-জুলিয়েট এবং অন্যান্য মধ্যযুগীয় প্রেমকাহিনীগুলো মূলত প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল-এর বর্ণিত আদর্শিক-প্রেমের দার্শনিক প্রতিধ্বনি, আর আক্ষরিক অর্থেই রোমান কবি ওভিড-এর `আরস অ্যামাটোরিয়া` কাব্যের অনুকরণে অমৌলিকভাবে সৃষ্ট। ভাবাবেগী-প্রেম তাত্ত্বিকভাবে পরিপূর্ণ বা সুসম্পূর্ণ হতে পারে না, কারণ এই ধরনের প্রেম নারীদের প্রতি অতীন্দ্রিয়ভাবে গভীর শ্রদ্ধা থেকে অনুপ্রাণিত; যাইহোক, কবি ওভিডের অবিরাম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কামুক সাধনা বা বশীকরণের বিপরীতে — `প্রেম` নিয়ে চিন্তাভাবনা না করে বরং বীরত্বপূর্ণ ক্রিয়াকাণ্ড বা কাজে সক্রিয়ভাবে `প্রেম`কে অনুসরণ করাই উচিত!
আধুনিক আবেগী রোমান্টিক-প্রেম অ্যারিস্টটলের বিশেষ ভালোবাসার বিশেষ সংস্করণের ধারণায় নিয়ে আসে যেখানে দুটি মানুষ একে অপরের গুণাবলির মধ্যে খুঁজে পায়— যেমন তিনি কাব্যিকভাবে বলেছেন, `দুটি দেহে একটি আত্মা`, যেটাকে আচরণবাদী বা ভৌতবাদীদের দেয়া প্রেমের বর্ণনার চেয়ে নৈতিকভাবে, নান্দনিকভাবে এবং এমনকি আধ্যাত্মিকভাবেও উচ্চ মর্যাদার বলে মনে করা হয়।
কেউ কেউ মনে করতে পারে যে প্রেম শারীরিক, অর্থাৎ, সেই ভালোবাসা অন্যের প্রতি একজনের শারীরিক প্রতিক্রিয়া ছাড়া্ আর কিছুই না। একজন অন্যের প্রতি যে প্রেম ধারণ সেটা দৈহিকভাবে আকৃষ্ট বোধ করারই আরেক নাম। সেইসূত্রমতে, আচরণবাদীরা প্রস্তাবনা করে যে, ভালোবাসার ক্রিয়াকলাপ যত্ন নেওয়া, কথাশোনা, মনোযোগ দেওয়া, অনুরক্ততা প্রকাশ করা ইত্যাদি সহ মানবআচরণের বিস্তৃত পরিসরকে পরিবেষ্টন বা অন্তর্ভুক্ত করে। অন্যরা, যেমন ভৌতবিজ্ঞানী ও জিনতত্ত্ববিদ, প্রেমের সমস্ত পরীক্ষাকেই শুধুমাত্র যৌন আবেগের শারীরিক অনুপ্রেরণা বা প্রনোদনা হিসাবে গ্রহণ করে — প্রেমকে মনে করে সহজাত যৌনপ্রবৃত্তি যা সমস্ত জটিল-জৈবিক জীবের মধ্যেই বিদ্যমান, যদিও এই যৌনপ্রবৃত্তিটা হয়তো মানুষের বেলায় সম্ভাব্য সঙ্গী বা যৌন পরিতৃপ্তির লক্ষ্যবস্তুর দিকে সচেতনভাবে, উপ-সচেতনভাবে বা প্রাক-যুক্তিগত বা অযৌক্তিকভাবে পরিচালিত হতে পারে।
শারীরিক-সংকল্পবাদী বা নির্ধারকবাদীরা, যারা বিশ্বকে সম্পূর্ণরূপে শারীরিক বা পার্থিব অস্তি্ত্বের বলে বিশ্বাস করে, যাদের ধারণামতে, প্রতিটি ঘটনার পূর্ববর্তী প্রাকৃত বা ভৌত কারণ রয়েছে, তারা প্রেমকে মানব প্রাণীর দৈহিক জৈব-রাসায়নিক উপাদানগুলিরই সম্প্রসারণ বা প্রসারিত আচরণ এবং জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া বা প্রণালী অনুসারেই ব্যাখ্যাযোগ্য বলে মনে করে। জিনতত্ত্ববিদরা এমন তত্ত্ব আহ্বান জানাতে পারেন যে, মানুষের রক্তে-শিরায়, জিনগুলি বা একজন ব্যক্তির ডিএনএ-ই যে কোনও যৌনআকর্ষণ বা মানুষের কাছে পরিগণিত দৈহিক গুণাবলিকে পছন্দ করা, বিশেষত একজনের অন্যজনকে সঙ্গী হিসেবে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নির্ধারক মানদণ্ড তৈরি করে। যাইহোক, যারা দাবি করেন যে, হ্রাসযোগ্যভাবে প্রেম থেকে অন্য আবেগ বাদ দিয়ে এটাকে কেবল সম্ভাব্য সঙ্গীর প্রতি শারীরিক আকর্ষণ আর পরিবার এবং আত্মীয়দের রক্তের বন্ধনমূলক-`ফিলিয়া`সুলভ ভালোবাসা তৈরি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা যায়, তাদের জন্য একটি প্রধান সমস্যা হল যে, সেইসব মানুষের স্নেহ বা মমতাকে ধারণ করতে না পারা যারা প্রজনন বা সন্তান জন্মদানে অনিচ্ছুক ও অক্ষম — অর্থাৎ, শারীরিকতাবাদ বা সংকল্পবাদ ভাবাবেগী, আদর্শিক প্রেমের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে — এটা দিয়ে শুধু `ইরোস`কেই ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু `ফিলিয়া` বা `আগাপে`কে করা যায় না।
মনের বা মানসিকতার তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত আচরণবাদ, কার্টিসিয়ান দ্বৈতবাদে উল্লেখিত মন এবং দেহের সমন্বয়কে প্রত্যাখ্যান করে, ফলস্বরূপ এই বোঝায় যে, প্রেম হল ক্রিয়া এবং পছন্দগুলির ধারাবাহিকতা বা ধারাবাহিক আচরণ যা একজনের নিজের এবং অন্যদের দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণযোগ্য। আচরণবাদীতত্ত্ব প্রেমকে শুধু পর্যবেক্ষণযোগ্য বলেই ক্ষ্যান্ত হয় না, প্রেমের কাজগুলির সাথে সম্পর্কিত স্বীকৃত আচরণগত সীমাবদ্ধতা অনুসারে এই পরামর্শও দেয় যে, প্রেম তাত্ত্বিকভাবে পরিমাপযোগ্য। যেমন ধরা যাক, একজন ব্যক্তি `ক` যার ক্রিয়া বা আচারব্যবহার যথা `অ`,`আ`, `ই`, ``ঈ`, ইত্যাদি কর্মকান্ড অন্য ব্যক্তি `খ`-এর সামনে বা উপস্থিতিতে এমন একটি নির্দিষ্ট উপায়ে করে যেটা কিনা ব্যক্তি `গ`-এর সামনে করা একই ক্রিয়া থেকে ভিন্নতর বা `বেশি`, যা কিনা এই উপলব্ধি দেয় যে, একজন `অ`, অন্যজনদের মধ্যে ব্যক্তি `গ`-এর চেয়ে ব্যক্তি `খ`-কে বেশি "ভালবাসে"। সমালোচনার খাতিরে বলা যায় যে, প্রেমের আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা হলো যে এটি সকল আচরণকেই সংবেদনশীলতা বা অনুভূতিপ্রবণতা থেকে উদ্ভূত মনে করে। বাস্তবে একজন ব্যক্তির কোনো ক্রিয়া সম্পাদন বা কোন আচরণ প্রকাশ করার জন্য নিজস্ব অভ্যন্তরীণ অবস্থা বা আবেগ প্রয়োজন নাও হতে পারে — যেমন, এখন ধরা যাক, একজন ব্যক্তি `ক` খুবই ভাল অভিনয়কারী।
আচরণবাদের কট্টর সমর্থক হয়তো দাবি করতে পারে যে পর্যবেক্ষণযোগ্য বা অবলোকনযোগ্য এবং পর্যবেক্ষণযোগ্য নয়, এমন আচরণ যথা মানসিক অবস্থা বা `মূল্যবোধ`গুলি আচরণবাদী গঠনতন্ত্র বা কাঠামো দিয়ে `শর্তমূলক সূত্রের` পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা করা যেতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, `প্রেমে পড়া` বিষয়টা কোনো নৈমিত্তিক বা উদ্দেশ্যহীন পর্যবেক্ষকের কাছে অচেনা হতে পারে, কিন্তু প্রেমে পড়ার কাজটি প্রারম্ভের বা শুরুর কোন ঘটনা বা অবস্থার থেকে এই `প্রেমে পড়া` পর্যন্ত এসেছে বলে প্রেমে পড়া `একজন` বিশ্বাস বা মনে করে, সেটা দ্বারা পরীক্ষা করা যেতে পারে: এখানে এই তত্ত্বটিও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে প্রেম হলো অন্যের আচরণ বা উপস্থিতিতে অত্যন্ত ইতিবাচক অবস্থার গুচ্ছ বা আনুষঙ্গিক অংশসমূহের সমষ্টির প্রতি স্পষ্ট ও শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া।
অভিব্যক্তিবাদী তত্ত্ব প্রেমকে আচরণবাদের অনুরূপই ব্যাখ্যা করে এই অর্থে যে, প্রেমকে একজন-এর তার নিজস্ব প্রিয় অন্যজন-এর প্রতি একটি বিশেষ আয়োজন বা অবস্থার অভিব্যক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যা ভাষা যেমন শব্দ, কথা, কবিতা, সঙ্গীত ইত্যাদি বা আচরণ যেমন, ফুল দেয়া, নিজের কিডনি বা বৃক্ক দান করে দেয়া, বা কথার কথা `আগুনে ঝাপ দেয়া` ইত্যাদির মাধ্যমে জ্ঞাপন বা নিবেদন করা যেতে পারে; কিন্তু এসবকিছুই মস্তিষ্কনিসৃত উদ্দীপনার শারীরিক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের পরিবর্তে একপ্রকার অভ্যন্তরীণ-মানসিক অবস্থার প্রতিফলন আসলে। এই ধারার অন্য তাত্ত্বিকরা প্রেমকে আধ্যাত্মিক প্রতিক্রিয়া বলে দাবি করতে পারে, এমন একটি অপার্থিব আত্মার স্বীকৃতি যা নিজস্ব স্বত্বাকেই সম্পূর্ণ করে বা পরিপূরক হয়ে বৃদ্ধি করে। প্রেমের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রেমের রহস্যময় এবং সেইসাথে ঐতিহ্যগত ভাবাবেগের ধারণাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, কিন্তু আচরণবাদী বা শারীরিক ব্যাখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে।
যারা প্রেমকে একটি নান্দনিক প্রতিক্রিয়া বলে মনে করেন তারা মনে করেন যে, প্রেম উস্কানিমূলক বা অণুপ্রেরণা থেকে সৃষ্ট আবেগপ্রবণ এবং সচেতন অনুভূতির মাধ্যমেই জ্ঞেয় বা জানা যায়; তবুও তা সম্ভবত যুক্তিসঙ্গত বা বর্ণনামূলক ভাষায় ধারণ করা যায় না: এর পরিবর্তে, এটাকে, যতদূর সম্ভব, ধারণ করা উচিত, রূপক বা সঙ্গীত ও কবিতায়।
লেখক: ড. এস. তানভীর রাতুল; এফআরএসএ, এফআরএসএল
অধ্যাপক, স্কুল অব হিস্টোরি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার (ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি)
পরিচালক, সেন্টার ফর নিউ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়