তানভীর রাতুলের দর্শনগদ্য ‘আগাপে’
প্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০২২
আগাপে মানুষের জন্য ঈশ্বরের এবং ঈশ্বরের জন্য মানুষের ভালবাসাকে বোঝায়। আর সমস্ত মানবতার জন্য সেই একই ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ভালবাসা প্রসারিত করার কথাও এটা বলে। আগাপে অর্থযোগ্যভাবে ইরোস ও ফিলিয়া উভয়ের উপাদানগুলির সংমিশ্রণে আঁকা এক নিখুঁত প্রেম সন্ধানের প্রচেষ্টা, যা একইসাথে স্নেহ, নির্দিষ্ট দোষ-গুণাবলি ও পারস্পরিক ক্রিয়াহীন একটি আবেগ।
অ্যাগাপে এসেছে প্রাথমিকভাবে খ্রিস্টান ধর্মের ঐতিহ্য ধরে। এর অর্থ হলো, মানুষের প্রতি ঈশ্বরের ভালবাসার যে ধরনটা, সেইসাথে ঈশ্বরের প্রতি মানুষের যে ভালবাসা এবং, সেইসূত্রে মানুষের একে অপরের ভালবাসা— এক ধরনের সর্বজনীন ভ্রাতৃপ্রেম। সকলের জন্য। ঈশ্বরের ভালবাসার দৃষ্টান্তের ক্ষেত্রে আগাপে হলো স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বার্থহীন। যা মানুষ সেই ভালবাসার যোগ্য কিনা তার ওপর নির্ভর করে না। কারণ ঈশ্বরের প্রকৃতি বা কাজই হলো ভালবাসা। তারমানে ব্যক্তি বা লক্ষ্যবস্তুর নিজস্ব গুণাগুণ বা মূল্যের বিচার করার পরিবর্তে, সেই ভালোবাসার লক্ষ্যবস্তুকে নিজের থেকেই মান বা মূল্য দেওয়া এবং একই সাথে ঈশ্বরের সাথে মানুষের সাহচর্য স্থাপনের পন্থা তৈরি করা।
ঈশ্বরকে ভালবাসার ধারণাটি জুডাইক-খ্রিস্টান ঐতিহ্যে পাওয়া যায় এভাবে: সমস্ত হৃদয় দিয়ে, সমস্ত প্রাণ দিয়ে, এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে ভালবাসবে। ভালবাসা নিজের মতো প্রতিবেশী। ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসার জন্য পরম ভক্তি প্রয়োজন যা প্লেটোর সৌন্দর্যের প্রেমের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যার মধ্যে একটি কামোত্তেজক আবেগ, বিস্ময় ও আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। যা পার্থিব যত্ন বা প্রচেষ্টা এবং বাধাকে অতিক্রম করে। অন্যদিকে, যদিও অ্যারিস্টটলীয় বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার তত্ত্বগুলিকে ঈশ্বরকে সবচেয়ে যুক্তিবাদী সত্তা হিসাবে ঘোষণা করে, আর তাই, একজনের ভালবাসা, সম্মান এবং বিবেচনার সবচেয়ে যোগ্য বা সর্বোচ্চ দাবিদার।
নিজের প্রতিবেশীকে নিজের মতো করে ভালোবাসার সর্বজনীন আদেশটি একজনের চারপাশে থাকা ব্যক্তিদেকে বোঝায়। সেসব মানুষের প্রয়োজন হলে একজনের তাদেরকে একতরফাভাবে ভালোবাসতে হবে। মানে, এখানে এই ধারণা যেমন নিয়োজিত যে, আশপাশের মানুষগুলোর সাথে একজনের পারস্পরিক আদান-প্রদান বা ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া বিদ্যমান, তেমনি একটি অ্যারিস্টোটেলিয়ান ভিত্তিতে ইঙ্গিত দেয় যে, একজনের নিজেকেই বিষয়বস্তু ধরে কিছু উপযুক্ত উপায়ে নিজেকে ভালবাসতে হবে। কারণ একজন যদি নিজেকে বিশেষভাবে অনুপযুক্ত বা বিকৃতভাবে ভালোবাসে তবে ফলাফলটা হবে বিশ্রী বা বেমানান।
অ্যারিস্টটলীয় ধারণানুসারে, কোনো ধরনের আন্তঃব্যক্তিক প্রেমের জন্য আত্মপ্রেম প্রয়োজন। দার্শনিকরা এর মধ্যে নিহিত আত্মপ্রেমের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন— যে, একজনের অন্যজনের জন্য ভালোবাসা থাকার ভিত্তিই হলো অহংবোধ এবং জীর্ণ পারম্পারিকতার উদাহরণ। যা থেকে গর্ব ও আত্মগৌরব সৃষ্টি হয়। অ্যারিস্টটলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে, আগাপের সর্বজনীনতার জন্য কারো কাছ থেকে প্রাথমিক আবাহন বা আমন্ত্রণ প্রয়োজন। সেইন্ট অগাস্টিন বিতর্ক পরিহার করে দাবি করেন যে, একজনের নিজেকে ভালোবাসতে কোনো আদেশের প্রয়োজন নেই। এটা প্রচলিত ‘গ্রহণ করার চেয়ে প্রদান করা ভালো’ যুক্তির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
এটা অ্যারিস্টটলীয় অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। তার মতে, মানুষের দায়িত্ব অন্যদের প্রতি ভালবাসা প্রসারিত করার নৈতিকভাবে উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছানো। তা সত্ত্বেও, আদেশটি একটি সমতাবাদী প্রেমকেও অন্তর্ভুক্ত করে— তাই দেখা যায়, নিজের শত্রুদেরকেও ভালোবাসো ধরনের প্রেমাদেশ। এধরনের প্রেম যে কোনো পরিপূর্ণতাবাদী বা আভিজাত্যপূর্ণ ধারণা, যেমন কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে বেশি ভালোবাসার যোগ্য বা প্রেমময় হতে পারে বা হওয়া উচিত, সেটাকেও অতিক্রম করে যায়। আগাপে কান্টের নীতিশাস্ত্রেও প্রতিধ্বনিত হতে দেখা যায়, যেখানে বিমূর্তভাবে অন্য একজন মানুষকে নিরপেক্ষ সম্মান বা ভালবাসা দেওয়ার নৈতিক গুরুত্বের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
যাই হোক, প্রতিবেশীকে বা অন্যজনকে নিরপেক্ষভাবে ভালোবাসার ধারণাটা গুরুতর উদ্বেগজনক নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করে। বিশেষ করে যদি প্রতিবেশী বা অন্যজন স্পষ্টতই প্রেমের ‘সমন’ না জানায় বা হৃদয়বৃত্তিতে নাড়া না দেয়। এই বিতর্কের শুরুতেই আসে প্রতিবেশীর আচরণের কোন উপাদানগুলিকে আগাপেতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত এবং কোনটি বাদ দেওয়া উচিত। প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসা ছিল যে, নীতিটি কেবল খ্রিস্টধর্মের অনুসারীদের জন্য প্রযোজ্য নাকি সকলের জন্য। নিরপেক্ষতাবাদীরা এই বিতর্কে জয়লাভ করে এই যুক্তিতে যে, প্রতিবেশীর বা কারো মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকা অর্থেই তার মানবতা ভালোবাসার প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করে। তবুও তার মানবিক বা অমানবিক ক্রিয়াকলাপের ওপর নির্ভর করে সমালোচনামূলক ভালোবাসার আরেকটা ক্রমানুসার প্রয়োজনে বানানো যেতে পারে। কারণ ভ্রাতৃপ্রেমের যুক্তিটা এটাই বোঝায় যে, সেটা ভ্রাতৃপ্রতিম ঘৃণার থেকে কেবলমাত্র নৈতিকভাবে উন্নততর বা উচ্চস্তরের।
আধিভৌতিক দ্বৈতবাদীদের কাছে, প্রতিবেশীর দেহ বা কর্মের পরিবর্তে আত্মাকে ভালোবাসাটা একটি কার্যকর অব্যাহতির দফা বা পালানোর সমর্থক উপাদানবাক্য হিসেবে ধরা দেয়। অথবা প্রদান করে পাপ ও নৈতিক লঙ্ঘনের জন্য অন্যের দেহকে শাস্তি দেওয়ার ন্যায্যতা। প্রেমের সঠিক বস্তু-আত্মাকে এর ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়ার সময়। যন্ত্রণা খ্রিস্টধর্মের শান্তিবাদীদের জন্য, আগ্রাসন ও সহিংসতার দিকে ‘অন্য গাল ঘুরিয়ে দেওয়া’ এই আশাকেই বোঝায় যে আগ্রাসী অবশেষে শান্তি, ক্ষমাশীলতা ও মানবতার প্রতি ভালবাসার মতো উচ্চ মূল্যবোধগুলো বুঝতে শিখবে।
আগাপের সর্বজনীনতা অ্যারিস্টটলের পক্ষপাতবাদের বিপরীত দিকে প্রবাহিত এবং বিভিন্ন ধরনের নৈতিক অন্তর্নিহিততা বা প্রভাব ফেলে। যাদের সাথে মানুষ সম্পর্কযুক্ত তাদেরকে ভালোবাসায় একধরনের পক্ষপাতিত্ব স্বীকার করে নেয়াই যায়। আর সাথে সাথে আর সকল মানুষের প্রতি একধরনের দাতব্য মনোভাবও বজায় রাখা যায়। যদিও অনেকেই নিরপেক্ষতার ওপর জোর দিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক উল্লেখে দেখা গেছে যে, কারো প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট প্রেম থাকার মানেই নিরপেক্ষতার নীতিকে অস্বীকার করা বা অস্বীকৃতি জানানো নয়। কারণ কেউ হয়তো একজনের কাছের অন্যজনদের ভালোবাসাকেই একটি নিরপেক্ষ নীতি হিসাবে অনুধাবন করতে পারে।
অ্যারিস্টটলের আত্মপ্রেমের ধারণাটা এখানে কাজে লাগানো যায়। পুনরাবৃত্তি করে যে অন্যজনকে ভালোবাসার জন্য এমন এক প্রকার ঘনিষ্ঠতা প্রয়োজন যা শুধুমাত্র পক্ষপাতী মনোভাব ও অন্তরঙ্গতার মাধ্যমেই অর্জন করা যেতে পারে। অন্যরা দাবি করে যে, সর্বজনীন বা বিশ্বজনীন প্রেমের ধারণায় সকলকে সমানভাবে ভালোবাসাটা শুধু অব্যবহার্য বা অসাধ্যই নয়, যুক্তিযুক্তভাবেও অসার, বৃথাচেষ্টা। উদাহরণ স্বরূপ, অ্যারিস্টটলের যুক্তিটা এমন: নিখুঁত-বন্ধুত্ব থাকার অর্থে একজনের অনেক বন্ধু হতে পারে না। যেমন একজন একই সময়ে অন্য অনেকের সাথে প্রেম হয় না। কেননা প্রেম হলো এক ধরণের অনুভূতির আধিক্য। এবং এটার প্রকৃতি এমনই যা কেবলমাত্র একজনের প্রতি অনুভব করা যায়।
ইরোসকে কারণ-নির্ভর প্রেম হিসাবে ধারণা করার উদ্দেশ্যই হলো আগাপের সাথে একটি তীক্ষ্ণ বৈপরীত্য প্রকাশ করা। আগাপে এমন এক ধরনের প্রেম যা তার বস্তুর মূল্যের প্রতি সাড়া দেয় না। ফলশ্রুতিতে, আগাপেকে ইরোসের বিপরীতধর্মী ভালোবাসা ভাবা যায়। যেখানে ব্যক্তিকে মৌলিক বৈশিষ্ট্যের থেকে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসাবেই সেই বিশেষ ভালোবাসার লক্ষ্যবস্তু হিসাবে চিহ্নিত। তাই এটা কোনো যুক্তির ওপর নির্ভর করে না। বরং যুক্তিযুক্তভাবে অবোধগম্য, হয়তো এর সর্বোচ্চ কার্যকারণের ব্যাখ্যা যেটা হতে পারে তা হলো ঐতিহাসিকভাবে মানুষের অভ্যাসবশত আচরণ।
লেখক: ড. এস. তানভীর রাতুল; এফআরএসএ, এফআরএসএল
অধ্যাপক, স্কুল অব হিস্টোরি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার (ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি)
পরিচালক, সেন্টার ফর নিউ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়