তানভীর রাতুলের গদ্য ‘প্রেম সম্পর্কিত দার্শনিক আলোচনা‘

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৮, ২০২২

মানুষ ব্যক্তিগত প্রেম বা বিশেষ ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা কিভাবে আরোপ বা প্রকাশ করে? ব্যক্তিগত প্রেম বোঝার দার্শনিক কাজের প্রথম ধাপটা হলো বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত প্রেমকে আলাদা করা। উদাহরণ স্বরূপ, একজন যেভাবে স্ত্রীকে ভালবাসে সেটা মা, সন্তান ও বন্ধুকে যেভাবে ভালবাসে তার থেকে আপাতদৃষ্টিতে খুব আলাদা। আর এই কাজটা সাধারণত করা হয় এই ধরনের ব্যক্তিগত প্রেমগুলোর দার্শনিক বিশ্লেষণের হাত ধরে। এমন বিশ্লেষণ যা আংশিকভাবে প্রেম সম্পর্কে বিভিন্ন ধাঁধার উত্তর দেয়। ভালোবাসা কি ন্যায্য? তাই যদি হয়, কিভাবে? ব্যক্তিগত ভালোবাসার মূল্য কী? প্রেমিক ও প্রেয়সী উভয়ের স্বায়ত্তশাসন বা ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর প্রেম কি প্রভাব ফেলে?

দার্শনিকেদের জন্য, ‘ভালবাসা কি’ এই প্রশ্নটা অনেকগুলি সমস্যা তৈরি করে। প্রেম হলো একটি বিমূর্ত বিশেষ্য যার অর্থ কারো জন্য এটি এমন একটি শব্দ যা বাস্তব বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কিছুর সাথে সংযুক্ত নয়। এটিই সব, অন্যদের জন্য, এটি এমন একটি মাধ্যম যার মাধ্যমে মানুষের সত্তা— ‘একজনের’ আত্ম এবং তার জগৎ— অপ্রতিরোধ্যভাবে প্রভাবিত হয় একবার যখন একজন ‘ভালোবাসার ছোঁয়া’ পায়। কেউ কেউ এটিকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। কেউ কেউ মনে করেছেন এটা অবর্ণনীয়। তবুও এটা অনস্বীকার্য যে, প্রেম মানুষের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এক বিশাল ও অনিবার্য ভূমিকা পালন করে। এটিকে গান, চলচ্চিত্র, শিল্প, সাহিত্যে উল্লেখ ও আলোচিত হতে দেখা যায়— হাস্যকরভাবে বা গুরুত্বসহকারে।

এটা জীবনের পরিপক্কতা প্রাপ্তির বা প্রাপ্তবয়ষ্কতার এক ধ্রুবক বা নিত্য বিষয়বস্তু, আর যৌবনের জন্য তো এটা এক প্রাণবন্ত বিষয়। দার্শনিকভাবে প্রাচীন গ্রীকদের সময় থেকেই, প্রেমের প্রকৃতি, দর্শনের প্রধান অবলম্বন হয়ে আছে, সেখান থেকে উদ্ভুত তত্ত্বগুলি প্রেমের বস্তুবাদী ধারণা থেকে শুরু ভালোবাসাকে সম্পূর্ণরূপে একটি শারীরিক ঘটনা বা সরাসরি ইন্দ্রিয়গোচর বস্তু বা ব্যাপার পর্যন্তু বিস্তৃত—  মানে, তত্ত্বগুলি প্রেমকে একটি এক বন্য জৈবিকতা বা জিনগত তাগিদ যা মানুষের আচরণকে নির্দেশনা দেয় বলা থেকে শুরু করে— নিবিড় আধ্যাত্মিক ব্যাপার যা সর্বোচ্চভাবে মানুষকে দেবত্ব বা অপার্থিব গুণাগুণ স্পর্শ করার ক্ষমতা দেয়, এই পর্যন্ত ব্যাপ্ত।

ঐতিহাসিকভাবে, পশ্চিমা ঐতিহ্যে, প্লেটোর সিম্পোজিয়াম সূচনামূলক প্রস্তাবটা উপস্থাপন করে। কারণ এটি প্রকাণ্ড প্রভাববিস্তারী এবং আকর্ষণীয় এক ধারণা প্রদান করে যে, প্রেম একটি উচ্চতার ক্রম বা স্তর, একপ্রকার পরম্পরার সারিবদ্ধতা, যেখানে পশুবাদী জৈবিক বাসনা বা প্রধান উপাদান লালসা আরো একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণার দিকে স্থানান্তরিত হয় আর আবার সেই প্রেম যা কিনা ইন্দ্রিয় আকর্ষণ এবং পারস্পরিকতাকে অতিক্রম করে ভালোবাসার একটি ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকেও নিয়ে যায়। তখন থেকেই প্লেটোনিক প্রেমের বিরোধিতাকারী এবং সমর্থকদের পাশাপাশি একদল বিকল্প তত্ত্বের প্রবক্তাও আছে— যাদের মধ্যে রয়েছে প্লেটোরই ছাত্র, অ্যারিস্টটল এবং তার সত্যিকারের প্রেমের আরো ধর্মনিরপেক্ষ তত্ত্ব, যেখানে প্রেম হলো, দুটি দেহ আর এক আত্মা।

প্রেমের বিষয়ে দার্শনিকদের হস্তক্ষেপ জ্ঞানতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, ধর্ম, মানব প্রকৃতি, সমাজবিদ্যা, রাজনীতি এবং নীতিশাস্ত্রসহ বিভিন্ন উপ-শাখায় বিস্তার করে। প্রায়শই প্রেম, এর প্রকৃতি এবং মানব জীবনে এর ভূমিকা সম্পর্কিত বিবৃতি বা তর্কগুলি উদাহরণস্বরূপ দর্শনের সমস্ত কেন্দ্রীয় তত্ত্বের সাথে না হলেও অন্তত একটার সাথে সংযোগ করেই, এবং প্রায়শই যৌনতা এবং লিঙ্গ তথা দেহের দর্শন ও ইচ্ছাকৃততার সাথে তুলনা বা অনুসন্ধান করা হয়। প্রেমের দর্শনের কাজ হলো মানব প্রকৃতি, আকাঙ্ক্ষা, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদির প্রাসঙ্গিক তত্ত্বগুলিকে ব্যাখ্যা করে উপযুক্ত বিষয়গুলিকে সহনশীলভাবে উপস্থাপন করা।

প্রাথমিক পার্থক্য
সাধারণত মানুষের কথোপকথনে পাওয়া যায়:
আমি চকলেট বা সিনেমা ভালোবাসি।
আমি বই পড়তে ভালোবাসি।
আমি আমার কুকুর বা বিড়ালটাকে ভালোবাসি।
আমি আমার স্ত্রীকে বা মা বা সন্তান বা বন্ধুকে ভালোবাসি।

যাই হোক, ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় তা এককে ক্ষেত্রে একেক রকম। এর সর্বোচ্চ অর্থ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এতটুকু হতে পারে যে, মানুষ কোনো বস্তু বা ব্যক্তি বা ক্রিয়া বা কার্যকলাপ খুব পছন্দ করে। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো এই যে, কেউ একটি নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত হতে পারে বা কোনো কিছু বা অন্যকেউ আত্মপরিচয়ের একটি অংশ হতে পারে, যার তার নিজস্ব সার্বিক ব্যক্তিপরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত এবং যা জীবনকে বেঁচে থাকার ‘যোগ্য করে’ তোলে। বাড়িয়ে বললে এতটুকুই বলা যায় যে, মানুষ ভালোবাসার প্রসঙ্গটাকে মূল্যায়ন করে।

এটা অনেকটা উদ্বেগজনক বিষয় যে, ভালোবাসা অন্য কিছু দিয়ে সঠিকভাবে আত্মীকরণ বা প্রকাশিত করা যায় না। তার মানে, মোটামুটিভাবে কারো একজনের নিজের স্বার্থেই অন্য একজন ব্যক্তি বা বস্তু সম্পর্কে যত্ন নেওয়ার বিষয়ে একাগ্রতাকেই প্রেম হিসাবে ধরা যায়। তদানুসারে, মানুষ সাধারণত কোনো ব্যক্তির জন্য ভালবাসা ধারণ বা সংরক্ষণের ঘাটতি দিয়েও বিষয়টাকে বোঝা যেতে পারে। প্রেমের দার্শনিক বিবরণগুলি প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত প্রেমের ধরনের বা প্রকারভেদের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে; সেইসব ব্যক্তিগত প্রেম নিয়েই এখানে বলা হচ্ছে।

প্রেম সম্পর্কিত দার্শনিক আলোচনা যৌক্তিকভাবে এর প্রকৃতি সম্পর্কিত প্রশ্নগুলি দিয়ে শুরু হয়। এর থেকে এক বোঝা যায় যে, প্রেমের একটি প্রকৃতি বা স্বভাব আছে, এটা আসলে এমন একটি প্রস্তাব যার বিরোধিতা করার যুক্তি হলো এই যে, ভালোবাসা বিষয়টা ধারণাগতভাবেই অযৌক্তিক, কারণ প্রেমকে যুক্তিযুক্ত বা অর্থপূর্ণ উপস্থাপনা দিয়ে বর্ণনা করা যায় না। এই ধরনের সমালোচকদের কাছে, যারা একধরনের আধিভৌতিক এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক যুক্তি উপস্থাপন করেন, প্রেম এমন আবেগের নির্গমন বা অভিব্যক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রাখে যা যৌক্তিক পরীক্ষাকে অস্বীকার করতে পারে; অন্যদিকে, কিছু ভাষা, যেমন পাপুয়ান ভাষা ‘ভালোবাসা’ ধারণাটিকে স্বীকারই করে না, যা একটি দার্শনিক পরীক্ষার সম্ভাবনাকেও অস্বীকার করে।

ইংরেজিতে ভালোবাসা শব্দটি যা সংস্কৃত লুভ (ইচ্ছা) যা অনেকটা বাংলায় লোভ, এর জার্মানিক রূপ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, শব্দটি ব্যাপকভাবে সংজ্ঞায়িত এবং তাই অশুদ্ধ, এসব সংজ্ঞা ও অর্থ কালানুক্রমিকতার সমস্যা তৈরি করে। আর এ সমস্যার কিছু পরিমাণ সমাধান করা হয় গ্রীক দর্শনের আদিপরিভাষায়। এমনকি ব্যক্তিগত ভালোবাসার মধ্যেই, প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা ঐতিহ্যগতভাবে তিনটি ধরণকে আলাদা করেছেন যেগুলিকে সঠিকভাবে প্রেম বলা যেতে পারে: ইরোস, আগাপে ও ফিলিয়া।

লেখক: কবি ও শিক্ষক