তানজিনা ফেরদৌস
তানজিনা ফেরদৌসের গল্প ‘উৎসে ফেরা’
প্রকাশিত : মে ১২, ২০২৪
শুভর সাথে আমার এতদিনের মধুর সম্পর্কের আজকে এমন পরিনতি কেন, ভাবতে পারছি না আমি! শুভকে কথায় কথায় অনেক দোষ দিই। অবশ্য আমার মনে হয়, সব দোষ ওর। আমি তো শুভর সাথে প্রেম করতেও চাইনি। সেই তো কতভাবে আমাকে কনভিন্স করে ওর প্রতি আমার আগ্রহ বাড়িয়েছিল। প্রথমদিকে আমি ভাবতেই পারিনি, ওর সাথে প্রেমের একটা সম্পর্কে আমি জড়িয়ে যাব। কিন্তু আমার প্রতি তার মাত্রাতিরিক্ত ভালো লাগা, মুগ্ধতা, ভালোবাসা— সব কিছু প্রেমে মোড় নেয়।
এ সম্পর্কে বাড়ির সকলের অমত ছিল। পরবর্তীতে কত কষ্টে নাছোড়বান্দা হয়ে বাবা-মাকে রাজি করিয়ে শুভর সাথে আমার বিয়ে। ওই দিনের রাতের কথা খুব মনে পড়ে। বাবা শুভর সাথে বিয়েতে বাবা রাজি ছিল না। অন্য আরেকজনের সাথে আমার বিয়ে দেখেছে। সেই পাত্রপক্ষ আমাকে দেখেও গিয়েছে। কথা অনেক দূর এগিয়েছে। আমার বাবা-মা ডেট জানালেই এনগেজমেন্ট হবে। শুভ সব জানতে পারলো আর কান্নাকাটি শুরু করলো। আমি ওইদিন রাতে বাবার পায়ের কাছে বসে কাঁদছিলাম। মাঝরাত অবধি কেঁদেছি।
বাবা আমাকে বোঝায়। আমি বাবাকে বোঝাই, বাবা, শুভ ভালো ছেলে। ও জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছে। আমি যদি আরেকজনকে বিয়ে করি শুভর জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাবে। আমিও অন্য কোথাও সুখি হবো না।
বাবার একমাত্র মেয়ে বলেই হয়তো বাবা আমার চাওয়াটা ফেলতে পারেনি। তবে মন থেকেও এ বিয়েতে বাবা-মা রাজি ছিলেন না। আমার আর শুভর অনুরোধে বাধ্য হয়েই সবাই রাজি হয়।
একা একা শুয়ে অতীত আর বর্তমানে শুভ সাথে সম্পর্ক আর মনোমালিন্য নিয়ে ভাবছে রিতু। শুভকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। তার নিজের জীবনের চেয়েও প্রিয় শুভ। কিন্তু শুভর সাথে বিয়ের পর থেকে সম্পর্কটা কেমন ভঙ্গুর হতে চলেছে। টুকটাকি বিষয় নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়াঝাটি মান অভিমান দুজনকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। রিতু আজকাল মনে বড্ড বেশি কথা পুষে রাখে। মনে মান-অভিমান জমতে জমতে একটা পাহাড় জমেছে। অথচ রিতু কী চায় শুভর কাছে, সেই প্রশ্ন করছে নিজেকে।
এতকিছু ভেবে রিতুর মনে হলো, সে আসলে শুভর মনোযোগ চায় ঠিক আগের মতো। যখন প্রেমিকা ছিল, রিতুর প্রতি শুভর মুগ্ধতা রিতুকে খুব খুশি করতো। অনিচ্ছা থাকতে সেই মুগ্ধতার জন্যই শুভর প্রতি ভালো লাগা আর ভালো লাগা থেকে ভালোবাসার জন্ম নিয়েছিল। রিতু ভাবছে, আজ থেকে তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর সাথে মান-অভিমান নয়, ভালোবাসা দিয়ে দিন শুরু করবে। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেল রাতে।
শুভর সরকারি চাকরি। সে সরকারের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। চাকরির সুবাদে শুভকে ঢাকার বাইরে থাকতে হয়। ছুটির দিনগুলোতে শুভ যেখানেই থাকুক বৌয়ের কাছে ছুটে আসে। সকালে ঘুম ভাঙতেই রিতু শুভকে মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠালো, আসসালামু আলাইকুম আমার পাখি। শুভ সকাল। এরপর লিখতে বসলো কবিতা...
দুজনে মিলেমিশে যদি ষড়ঋতু হই
এমন কোনো তপ্ত দুপুরবেলা
রোদ হয়ে শুকিয়ে দিও
আমার মাথার এলোকেশ।
এমন কোনো হেমন্ত মুখর ক্ষণে
শিউলি ছাতিম দেবকাঞ্চনের পূজায়
উড়িয়ে দিও মনের ক্লেশ।
এমন কোনো হেমন্তের ভোরে
কুয়াশায় আগমনী বার্তা হয়ে
হৃদয়ে পৌঁছে দিও শীতের রেশ।
এমন কোনো হেমন্তের একাকী বিকেলে
শরৎ আকাশ বিদায় জানিয়েছে বলে
আমার ওপর মুখ ভার করে
তুমি হইয়ো না নিরুদ্দেশ।
দুজন মিলে আবার যাব
শরৎ বাড়ির উঠোন
দুজন মিলে আবার ছোঁবো
নদীর তীরের কাশবন।
দুজনেই মিলেমিশে যদি
ষড়ঋতু হই
ভালোবাসা, অভিমান ছোঁবে
এমন সাহস কই?
শুভ দেখলো, সকাল সকাল তার বউয়ের অসাধারণ বার্তা আর তাকে লেখা সুন্দর একটি কবিতা। সেও বার্তার উত্তর পাঠালো, ওয়ালাইকুম আসসালাম পক্ষি। শুভ সকাল। কখন উঠেছো? খেয়েছো?
রিতু লিখল, না। বিছানা ছাড়িনি এখনও। ঘুম ভেঙেই তোমাকে কবিতা লিখছিলাম।
শুভ: আচ্ছা ওঠো। ফ্রেশ হয়ে আগে কিছু খাও। আমি কাজ করি অফিসে।
রিতু: আচ্ছা ঠিক আছে।
উফ, প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে আমার। এত সুন্দর একটা কবিতা লিখলাম সারাটা সকাল ধরে। একটিবার বললোও না, কেমন হয়েছে। এমন বেরসিক শুভ বিয়ের আগে ছিল না।
উঠি, আজ তো বুধবার। কাল বৃহস্পতিবার। কাল অফিস করে শুভ ঢাকা আসবে। আমি সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করি বৃহস্পতিবারের জন্য। আমার সবচেয়ে বিরক্তিকর বার হচ্ছে রোববার। রোববার এলে আমার মনে হয়, উফ, কী দরকার সাতদিনে এক সপ্তাহ হওয়ার। বৃহস্পতি, শুক্র, শনি তারপর আবার বৃহস্পতিবার আসবে। অযথা সাতদিনে এক সপ্তাহ। কোনোমতে রোববার সোমবার আমি শুভকে ছাড়া বিরহ নিয়ে থাকতে পারি। তারপর মঙ্গল আর বুধ কী যে ভীষণ কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়ে দিন রাত কাটে, সেটা তো শুভ বোঝে না। সে যদি আমার এই কষ্ট বুঝতো তবে তো হতোই। আমি তাকে নিয়ে না বরং সেই আমাকে নিয়ে কবিতা লিখতো।
আজ তো বুধবার। আজ আর কাল শুভর সব পছন্দের খাবার রান্না করে রেখে দেব। আগামীকাল শুভ এলে ওকে ছাড়া কিচেনে বেশিক্ষণ নষ্ট করবো না। এবার ও এলে আমরা অনেক মধুর সময় কাটাব। গল্প খুনসুটি আর শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াবো ওর সাথে। এসব ভাবতে ভাবতেই রিতু কিচেনে ঢুকলো। কোনোমতে নাস্তা সেরে রান্নাবান্না করতে থাকলো শুভর জন্য। পরদিন বৃহস্পতিবার রিতু ঠিক করলো, আজ শুভ এলে ওর পছন্দের গরম গরম ভুনা খিচুড়ি, গরুর মাংস কষা আর স্পেশাল আলুকুচি দিয়ে ডিম ভাজি করবে।
শুভ বৃহস্পতিবার বরাবরই ভীষণ বিজি থাকে। অফিসে আজও তাই। কিন্তু আজ কখন কয়টায় শুভ রওনা হবে ঢাকার উদ্দেশে, তা তো কিছুই বললো না। রিতু আবার ভাবতে থাকলো, আমার পাগল বর হয়তো কোন সারপ্রাইজ দেবে আমাকে। দুপুর বারোটার পর এখন সন্ধ্যা ছয়টা। আজ এখনও ফোন করেনি শুভ। রিতু দু`বার ফোন দিল, শুভ কেটে দিল। রিতু দুঃচিন্তা করছে ভীষণ। ফোন করলো শুভর পিয়ন মাসুদের কাছে।
হ্যালো আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম মাসুদ। আপনার স্যার কোথায়? ফোন তুলছে না যে। দুঃচিন্তা হচ্ছে আমার।
ম্যাডাম স্যার তো মনে হয় জার্নিতে এখনও। বাসে উঠছেন দুপুর তিনটায়।
ও আচ্ছা বুঝছি। এতক্ষণে মনে হয় নামার সময়ও হইছে।
মাসুদের সাথে কথা বলতে বলতেই শুভর ফোন ঢুকলো। রিতু মাসুদের ফোন কেটে শুভর ফোন রিসিভ করলো, তুমি কই গো। বাসে উঠেছো, রওনা দিয়েছো, আমাকে জানাবে নাহ! এদিকে আমার ফোনও তুলছো না। আমার দুঃচিন্তা হয় তা তো তুমি বোঝো না।
শুভ বলল, ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম রিতু। আর কখন ফোনটা সাইলেন্ট হয়েছে, বুঝতে পারিনি। আমি মাত্র বাস থেকে নেমেছি। মুন্না ভাইয়া আগে থেকেই আমাকে রিসিভ করতে এসেছে। এখন মুন্না ভাইয়ার বাসায় যাচ্ছি রিকশায়।
মানে কী? তুমি কই? তুমি ঢাকা না এসে মুন্না ভাইয়ার বাসায় কেন? মাও তো ওখানে নেই। তুমি মায়ের কাছে গেলেও বুঝতাম যে মায়ের জন্য খারাপ লাগছিল বলে ছুটে গিয়েছো। ছুটির দিনে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আর তুমি গিয়েছো কাজিনের বাসায় বেড়াতে। আমাকে বলে যেতে পারতে!
শুভ বলল, তোমাকে এত কিছু বলার কী আছে? আমার মন চেয়েছে আমি এসেছি। ফোন রাখছি পরে কথা বলবো।
রিতু রান্না খিচুড়ি চুলায় দিয়ে ফোনে কথা বলছিল। ফোন রাখতেই নাকে খিচুড়ি পুড়ে যাওয়ার গন্ধ। কিচেনে গিয়ে দেখে, খিচুড়ি পুড়ে কয়লা। চুলাটা বন্ধ করে রিতু রুমে এসে বিছানায় শুয়ে ভাবছে, শুভ অকারণে আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে কেন? ও এই সপ্তাহে ঢাকা আসবে না ঠিক আছে। কিন্তু সে তো আমাকে একটু বলে যেতে পারতো। শুভ তো জানে, আমি সারা সপ্তাহ ওর জন্য অপেক্ষা করে থাকি। আপনমনে এসব ভাবতে ভাবতে রিতু কাঁদছে। শুভ বলেছিল, পরে ফোন করবে। সেই পরে বলতে রাত যখন সাড়ে বারোটা তখন শুভ কল করলো।
জিজ্ঞেস করলো, ঘুমিয়েছো?
রিতুর সরল জবাব, না।
ঘুমাওনি কেন?
এমনিতেই, ঘুম এলে ঘুমাবো। তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? ভাইয়ার বাসায় আসতে তোমার এতক্ষণ লাগলো?
এত প্রশ্ন করো কেন রিতু? আমরা সবাই বাইরে ডিনার করতে গিয়েছিলাম। বাসায় আসার পর সুমা ভাবি বললো, এদিকেই একটা নতুন রেস্টুরেন্ট ওপেন হয়েছে। ওখানে তাদেরকে খাওয়াতে হবে। তাই সবাই মিলে আজকে বাইরে ডিনার করলাম।
রিতু বলল, ওহ। কে কে গেলে ডিনারে?
আমি,ভাই,ভাবি আর ওদের দুই ছেলে। আর ভাবির দুজন বান্ধবি।
ও আচ্ছা। আচ্ছা শুভ, তুমি বলতে পারো আমি কোনোদিন তোমার কাছে এভাবে কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার বায়না করেছি কিনা? আমার বন্ধুদেরকে ট্রিট দিতে বলেছি কিনা?
শুভ বলল, এটাই হচ্ছে তোমার সমস্যা। তুমি যেতে চাইলে কী আমি তোমাকে নিতাম না?
কী সমস্যা বলো তো? আমি বলি না অন্য কথা ভেবে। মাস শেষ না হতেই তুমি বলো, বেতনের টাকা শেষ। আমি ভাবি, রেস্টুরেন্টে খেয়ে টাকা নষ্ট করে কী লাভ? তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে করলে আমি বাসায় রান্না করি। রেস্টুরেন্টে একবেলা খেয়ে যে খরচ তা দিয়ে বাসায় দুইদিন ভরপুর খাওয়া যাবে এটলিস্ট।
এসব কথায় মনে হলো শুভ কোনো পাত্তাই দিলো না। শুধু বলল, রিতু ঘুমাও ফোন রাখছি।
এমন আচরণ যে নতুন, তেমন নয়। রিতু ফোন রাখলো। সারা রাত মন খারাপ করে থেকে ভোরবেলা ঘুমালো। পরদিন সকালে শুভর বার্তা, শুভ সকাল প্রিয়তমা। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে নিও। আমি বাইরে।
রিতু বার্তা দেখে কোনো ফিরতি বার্তা পাঠালো না। কিন্তু রিতুর মন পুড়ছে শুভকে দেখার জন্য। খুব ইচ্ছে করছে শুভর কাছে ছুটে যেতে। শুভ কিভাবে এতদিন আমাকে না দেখে আছে, ভাবতেই আবারও চোখে জল এলো রিতুর।
রিতু বিছানা থেকে উঠলো না। নাস্তাও করলো না। শুয়ে রইল সারা দিন। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল তিনটা বাজে। শুভর ফোন এলো। রিতুও ফোনের দিকে অভিমান নিয়ে সারা দিন তাকিয়ে আছে, কখন সে ফোন করবে।
শুভ: হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। কী অবস্থা? খেয়েছো?
রিতু: ওয়ালাইকুম আসসালাম। না খেয়েও উত্তর দিল, হ্যাঁ খেয়েছি। তুমি কী খেলে?
শুভ: আহ্ কী যে মজা করে খেলাম। ভাবি এত্ত মজার মজার খাবার রান্না করেছে! আমার প্রিয় ভুনা খিচুড়ি, গরুর মাংস ভূনা, ইলিশ মাছ। আর ভোলা থেকে দই আনিয়েছি। ভাবি বললো ভোলার দই খাব, তাই আনিয়েছি। ভাবি তো খুব খুশি।
রিতু: ওহ আচ্ছা। আমার কখনও মাথায় আসেনি তো এমন কিছু। যে কোনো জায়গার কোন খাবারটা মজা বা পছন্দ করি খেতে সেটা তোমার কাছে খেতে আবদার করতে।
শুভ: আহ্ রিতু, এজন্যই তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।
রিতু: বলতে ইচ্ছে না করলে তো বলো না। আর এখনই বা কেন বললে আমি তো তোমার সুন্দর সময় নষ্ট করতে তোমাকে ফোন করিনি। আমিও দুদিন থেকে তোমার পছন্দের সব খাবার রান্না করে ফ্রিজে তুলে রেখেছি। যাই হোক, রাখছি... বলে ফোন রাখলো রিতু।
রিতু ফোন রেখে অপেক্ষা করছে শুভ আবার কলব্যাক করবে। যেমনটা করে আসছে সবসময়। কিন্তু কলব্যাক করলো না। রিতুও অভিমান করে বসে রইলো। রাত তখন একটা। শুভর ফোন এলো। রিতু রিসিভ করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, বলো।
শুভ: কী করছো? ঘুমাওনি?
রিতু: না। তুমি ঘুমাওনি কেন এখনও? কণ্ঠটা এমন মনে হচ্ছে কেন? শরীর খারাপ?
শুভ: প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সর্দি কাশি। সন্ধ্যা থেকে ভাবি একাধিকবার চা করে দিয়েছে। গরম পানি করে দিয়েছে গড়গড় করেছি। মুন্না ভাইয়া মাত্র বাসায় ফিরলো, ডিনার করছে।
রিতু: ভাইয়া এতরাত পর্যন্ত কোথায় ছিল?
শুভ: ভাইয়া প্রতিদিন রাত করেই বাসায় ফেরে। ভাবি তাই বললো, ভাইয়া নাকি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। সুখি মানুষ বুঝলে, বাসার পাশেই অফিস। আবার ইচ্ছে মতো চলে। এতরাত পর্যন্ত আড্ডা দিলেও ভাবি কিছু বলে না। ভাবি অসম্ভব সংসারী। এই তো রাত সাড়ে বারোটায় ভাবি ভাইয়াকে ফোন করে কী সুন্দর করে বলল, স্যার আপনার বাসায় ফেরার সময় কী এখনও হয়নি? যদি হয় তাহলে বাসায় আসুন অপেক্ষা করছি। ভাবি কোনো রাগটাগ করে না ভাইয়ার ওপর।
রিতু: ও আচ্ছা। তোমার ভাবির হয়তো জামাই দূরে থাকলেই ভালো লাগে। কিন্তু আমার জামাই আমার কাছে থাকলেই ভালো লাগে।
শুভ: উফ রিতু, তোমার সবসময় ত্যাড়া কথা।
রিতু: ঘুমাও, শুভ রাত্রি। রিতু ফোন রেখে ভাবতে লাগলো, শুভ তার ওপর অকারণে এত রেগে যাচ্ছে কেন? তাহলে কী রিতুর কোনো আচরণ ঠিক হচ্ছে না? ঘুরেফিরে সে জবাব পেল, তার প্রতি শুভর আর সেই ভালোলাগা মুগ্ধতা নেই। মনে মনে ঠিক করলো, কাল সারা দিন শুভকে এমন কোনো কথা বলবে না যার জন্য শুভ তার ওপর রাগ করে। সারা দিন স্বাভাবিক কথাবার্তা হলো দুজনের।
শুভ অফিসের উদ্দেশে রওনা হলো শনিবারেই। শনিবার সারা দিন রিতু ঠিক করলো, বরকে সুন্দর করে একটা চিঠি লিখবে। অন্তত চিঠিটা পড়লে শুভ রিতুর অনুভূতিগুলো কিছুটা হলেও বুঝবে।
রোববার ঘুম থেকে খুব ভোরে উঠলো রিতু। তারপর বরকে লিখতে শুরু করলো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি আর ভালোবাসি বলেই রাগ করি, অভিমান করি। আর তুমি বলো, আমি পাগলামো করি। তো আমি যদি ভালোবেসে একটু পাগলামি করি তাতে ক্ষতি কী বলো। শুভ, তুমিও আগের মতোই আমার জন্য পাগল হয়ে যাও। তোমার মনে পড়ে একটা সময় আমি তোমার ফোন না ধরলে তোমার বিদঘুটে সকাল হতো। আমার কণ্ঠ না শুনে তোমার দিন শুরু হলে তোমার সারাটা দিন বিষাদময় কাটতো। আমি তোমার ফোন না ধরলে তোমার সাথে কথা না বললে তুমি লিখতে,
রিতু
রিতু
ওও রিতু
কথা কইবা না।
কথা কও নাহ!
তুমি কথা না বললে আমার কিছু ভালো লাগে না।
পাখি
ও পাখি
পক্ষী আমার কথা কও।
ফোন রিসিভ করো।
আমি যতক্ষণ না তোমার সাথে কথা বলতাম, তুমি অস্থির থাকতে। তোমার সাথে প্রেম হওয়াটা কখনও সম্ভব ছিল না আমার। কিন্তু আমার প্রতি তোমার মুগ্ধতা ভালো লাগা ভালোবাসা সবকিছু প্রেমে মোড় নিয়েছিল। আমার সামনে হাজারও অপশন থাকার পরও আমি তোমাকে ছাড়তে পারিনি। আমার প্রতি তোমার এই মুগ্ধতা স্বচ্ছ মনে হতো, আমার প্রতি তোমার তীব্র ভালোলাগা ভালোবাসায় আমি তোমাকে ফেরাতে পারিনি। একটা সময় আমিও তোমার প্রেমে পড়ি তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করি।
মোহাম্মাদপুর তাজমহলের রোডে আমার পিছু পিছু ঘোরা সেই ৩৬ বছর ৩ মাস বয়সী ছেলের আবোলতাবোল কথাগুলো আমার মন ভালো করে দিতো। বারবার বিদায় জানানোর পরও আবার ফিরে এসে বলা রিতু কাল আবার দেখা হবে। বারবার নিষেধ করা স্বত্ত্বেও প্রতিদিন বাসার নিচে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই অবুঝ ছেলের মতো আচরণ আমার ভালো লাগতো। আমি তার ওপর প্রচণ্ড ভরসা আর আস্থাশীল হয়ে পড়ি। আমি সেই ছেলেটিকে প্রচণ্ড ভালোবাসি শুভ। তোমার সেসব পাগলামি আমার ভালো লাগতো, এখন সেসব পাগলামি কোথায় হারিয়েছে?
আমার প্রতি তোমার সব ভালোবাসা আর মুগ্ধতাগুলো কোথায় উবে গিয়েছে? এগুলো উবে যেতে দিও না। জানো তো, সব ভালো লাগা নিঃশেষ হতে দিতে নেই। কিছু ভালো লাগা জিইয়ে রাখতে হয়। যখন দুজনের মধ্যে দৌরাত্ম ভর করে তখন সেই জিইয়ে রাখা ভালো লাগাগুলো অক্সিজেনের মতো কাজে আসে। শুভ, আমি খুউব আবেগি আর আমি আবেগি বলেই তোমার সাথে প্রেম আর আজকে আমি তোমার বউ। আমাদের বিয়ে সবকিছুই সম্ভব হয়েছে আমার এই আবেগের জন্য। আজকে যখন তুমি বাস্তবতা নিয়ে বলো, আমাকে আঘাত করো আমিও কেমন যেন আবেগ ছেড়ে বাস্তবতা বুঝে যাই। তখনই তোমার আমার মাঝে শুরু হয় ঝগড়াঝাটি। কিন্তু আমি এত বাস্তবতা বুঝতে চাই না শুভ।
তোমার কেন এতকিছু বুঝতে হবে, জানতে হবে। চলো না আমরা ভুল করি, একে অপরকে দোষারোপ করি, মান-অভিমান করি, ঝগড়াঝাটি করি, আবার দুজন দুজনকে পাগলের মতো মিস করি, সবসময় দুজন দুজনকে চোখে হারাই। তোমার মনে আছে, বিয়ের আগে আমি যখন গ্রামের বাড়িতে যেতাম তুমি অফিস শেষ করে রোজ মোহাম্মদপুর আসতে আমার ঢাকার বাসার সামনের ঐ রোডে, বাসার গেইটের সামনে তোমার ছবি তুলে পাঠাতে আর লিখতে রিতু তোমাকে আমি অসম্ভব মিস করি তাড়াতাড়ি ঢাকা এসো প্লিজ। মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডের অলিগলিতে কতদিন তোমার হাতটি ধরে আমি হাঁটি না।
এখনও যেমন রোজ রাতে তুমি আমাকে রেখে পাশ ফিরিয়ে ঘুমিয়েছো বলে আমি মুখ ফুলিয়ে থাকি। তুমি আমাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে মান ভাঙাও। এমন থাকো শুভ। বদলে যেও না। এগুলো আমাদের সম্পর্কের ভালোলাগা এই ভালোলাগাটুকুন আমরা রেখে দেব আমৃত্যু। আমরা যখন বুড়ো বুড়ি হবো তোমার চাচী যেমন চাচাকে পান ছেঁচে খেতে দেন। আমিও ওভাবে ঠকঠক করে পান ছেঁচে দেব তোমাকে। তুমি খেও। আমাদের মান অভিমান ঝগড়া খুনসুটি আর ভালোবাসা নিয়ে বুড়ো হতে হবে যে...
এই শুভ শোনো নাহ! আমি বুড়ি হয়েও মেকআপ করে সাজতে চাই। তুমি এখন যেমন আমার মেকআপ পুরানো হলে লিপস্টিক পুরানো হলে বলো— রিতু মেকআপ নেওয়ার সাথে সাথে তোমাকে যতটা না সুন্দর লাগে তোমার মুখে মেকআপ পুরানো হলে আরও অনেক অনেক বেশি সুন্দর লাগে। আমি বুড়ি হয়ে যখন সাজবো তখনও কিন্তু বলতে হবে। নয়তো এই যে এতো পটিয়ে প্রেমে ফেলেছো এগুলো তোমার নাতি নাতনিদের সাথে গল্প করবো আর বলবো তুমি কেমন মেয়ে পটানোতে উস্তাদ ছিলে। আমাদের ঝগড়ার বয়স বাড়ুক শুভ সাথে আমাদের ভালোবাসারও বয়স বাড়ুক।
ঝগড়া চলছে যেমন
তেমনই চলুক
আরও একশো বছর
ঝগড়ার বয়স বাড়ুক।
একশো দিনে ভাব হোক না একদিন
শুধু ভালোবাসা টা থাক প্রতিদিন।
তোমার সাথে রোজ না হয় দাঙ্গা হোক
তবু নেয়েছি কী না খেয়েছি কী না
নিও খোঁজ।
তোমার সাথে দিনকে দিন থাক না আড়ি
আমার বিহনে শুধু হোক তোমার মনটা ভারী।
অনেক দূরে সরে যাওয়া হোক
তবু থাক চোখে চোখ
কথা হোক চোখের চাহনিতে
এভাবেই কেটে যাক শতবছর ঝগড়াঝাঁটিতে।
বুঝলেন মশাই আপনার সাথে আমার মান অভিমান আর ঝগড়া গুলো অম্লমধুর চাটনি হয়ে যাক। ভালোবাসি গো তোমায় আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি।
ইতি তোমার
অভিমানী বউ।
শুভ বউয়ের লম্বা চিঠি পেয়ে পড়তে থাকলো আর ফিরে গেল অতীতে। পড়তে পড়তে কখন চোখের জল পড়ে শার্ট পর্যন্ত নোনা জল গড়িয়ে পড়েছে, বুঝতে পারেনি। নিজের স্ত্রীর প্রতি অবহেলাটা যে তার অন্যায় মুহূর্তেই বুঝতে পারে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, উৎসে ফেরার। প্রেমের রঙিন দিনগুলোকে আরও রঙিন করে আগামী দিনগুলো চলার প্রত্যয় জাগে বুকে। আপাতত স্ত্রীকে কিছু বুঝতে না দিয়ে একটু মজা করে লিখলো, ঠিক আছে। আমার বয়স কিন্তু ৩৬ বছর ৫ মাস এখন। আমাকে তুমি আর বুড়ো বলবে না।
ভালোবাসি পক্ষী।
রিতু বলল, হায় হায় দুই বছরে তোমার বয়স দুই মাস বাড়লো মোটে! তুমি আবার বয়স লুকাও। আচ্ছা যাও আর ঝগড়া না। আমিও খুব ভালোবাসি পাখি।