তাত্ত্বিক হান্টিংটনের হাত ধরে বলে দেয়া যায়, সময়টা এখন মার্কেট-মিড

কল্লোল কর্মকার

প্রকাশিত : জুন ১৬, ২০১৬

তাত্ত্বিক হান্টিংটনের হাত ধরে বলে দেয়া যায়, সময়টা এখন মার্কেট-মিডিয়া এবং মিলিটারির। কাঠামোগত এই তিনটি উপাদানের সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপত্রের আড়ালে ক্ষমতার চর্চা অব্যাহত রয়েছে। এই ক্ষমতার চর্চায় পুঁজির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকারী দেশগুলোর প্রতিনিধি হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সন্দেহাতীতভাবেই নিয়ন্ত্রন করছে বিশ্বের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র। কিন্তু ক্ষমতার ভরকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চীফ অব স্টাফ জোসেফ ডানফোর্ড গত ১৭ আগস্ট চীন সফরকালে যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়ার সম্ভাব্য যুদ্ধপরিস্থিতিকে কেন ’ভীতিকর’ বলে অভিহিত করলেন তা বিবেচনার দাবি রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে মার্কিন পলিসি নতুন করে ভেবে দেখার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় বসার পর তা তিনি পূরণ করেননি। উল্টো ট্রাম্পের নীতি নির্ধারণী কর্মকর্তারা তাদের পূর্বোক্ত কর্মকর্তাদের পদক্ষেপ অনুসরণ করছেন। পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যাবে, গত ৭০ বছর ধরে মার্কিন প্রশাসন উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যত যত পদক্ষেপ নিয়েছে তার সবই কূটনৈতিক অর্থনৈতিক পর্যায়ের, যা মূলত হুমকি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কখনও এই হুমকি দেয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবরোধকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে, আবার কখনো চীনের হাত হয়ে উত্তর কোরিয়াকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
সাবেক মার্কিন ওবামা প্রশাসন উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে কৌশলগত দুটি পদক্ষেপ গ্রহন করেছিল কাগজে কলমে, এক আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, দুই হামলা চালানো। কিন্তু ওবামার আমলে এই দুটির একটিও পুরোপুরি হয়নি বলেই ট্রাম্পের আমলেও সেই একই হুমকি হুমকি খেলা চালাতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। উপরন্তু, দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল এইচ আর ম্যাকমাস্টার উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ যুদ্ধের’ কথা বলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন তা ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই প্রত্যক্ষ যুদ্ধ এড়িয়ে উত্তর কোরিয়ার শাসক পরিবর্তনের চিন্তা করছিল। বিল ক্লিনটন থেকে শুরু করে সিনিয়র বুশ সকলেই চেয়েছিলেন যে, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা না করে কোনোভাবে দেশটির শাসক পরিবর্তন করা গেলে তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকতো। কিন্তু নির্মম বাস্তব্তা হলো, উত্তর কোরিয়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনটা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক হুমকি মোকাবেলা করতে যাওয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে হচ্ছে। যেমনটা সত্তরের দশকে চীনের ক্ষেত্রে হয়েছিল।
স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৯৪ সালে পিয়ংইয়ংয়ে বোমা হামলা প্রস্তুতির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের উত্তর কোরিয়া সফরের কথা। সেসময় একমাত্র মুখোমুখি আলোচনার মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়ার কিম পরিবার পরমাণু কার্যক্রম স্থগিত রাখার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল।

ক্ষমতা পরিবর্তনের বিপদ: কিউবার ছিল একদল বিপদগামী ধনী শ্রেণি। ইরাকের ছিল বিদ্রোহী শিয়া এবং কুর্দি গোষ্ঠি। লিবিয়া আরব বসন্তের কারণে বহুধা বিভক্ত। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার এসব কিছুই নেই। অন্যান্য দেশের ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য অভ্যন্তরীণ যে উপাদানগুলোকে কাজে লাগিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর কোরিয়ার তা অনুপস্থিত। দেশটিতে নেই কোনো বিরোধী দল যারা যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ করবে। পাশাপাশি দেশটির নাগরিক সমাজের মধ্যে এমন কোনো গোষ্ঠি নেই যারা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলবে। এমনকি রাশিয়ার পরমাণু বিজ্ঞানী আন্দ্রেই শাখারভ অথবা চেক প্রজাতন্ত্রের ভ্যালকভ হাভেলের মতো কোনো ব্যক্তি উত্তর কোরিয়ায় নেই যারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজেদের মতামত তুলে ধরবেন।
এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার সরকারের বিপরীতে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাড়িয়ে আছে দেশটির বিশাল সামরিক বাহিনী, যা ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একমাত্র সামরিক বাহিনীই হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার। কিন্তু কিম পরিবারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যে সম্পর্ক ও ক্ষমতা বিন্যাসে সেনাবাহিনীর মধ্যে কিম পরিবারের যে অবস্থান তাতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তাদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি কার্যকর করা সম্ভব হবে না। উল্টো যদি যুদ্ধ বেধেই যায় তবে কলামিস্ট ব্রেট স্টিফেন্সের সুরেই বলা যায়, ‘ফল হবে চূড়ান্ত ভয়াবহ’। এধরনের ক্ষমতা পরিবর্তনের চেষ্টা যদি উত্তর কোরিয়ায় করা হয় তাহলে উত্তর কোরিয়ার জনগণের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ঘোরতর জাতীয়তাবাদের জন্ম দেবে। দেশটির জনগণ হয়তো কিম পরিবারের শাসনকে ভালো চোখে দেখছে না, কিন্তু যুগ যুগ ধরে চলা জাতীয়তাবাদী শিক্ষা এবং প্রোপাগাণ্ডা দেশটির জনগণকে নিজেদের স্বাধীনতার অধিকার এবং জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রশ্নে সত্যিকারের বিশ্বাসী করে তুলেছে। মনে রাখতেই হবে, উত্তর কোরিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সামরিকভাবে প্রশিক্ষিত।
অন্যান্য পরমাণু শক্তিধর দেশের মতো উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কমপ্লেক্স নির্দিষ্ট নয়। বহু ভাগে বিভক্ত দেশটির পরমাণু কার্যক্রম। মোবাইল মিসাইল লাঞ্চার থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থানে গোপনে অনেক পারমাণবিক স্থাপনা বসানো আছে, যার সঠিক পরিসংখ্যান এখনও জানা যায় না। উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত থেকে সিউলের দূরত্ব মাত্র ৩৫ মাইল, যেখানে মোট ২৫ মিলিয়ন মানুষের বসবাস। যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রতিরোধ যুদ্ধে নামে তবে স্বাভাবিকভাবেই চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষাবলম্বন করবে। আর এর ফলে সুপারপাওয়ার দেশগুলোর মধ্যকার যুদ্ধে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটবে তা অচিন্তনীয়।

সমাধান কোন পথে: সত্তুরের দশকের চীন বর্তমান উত্তর কোরিয়ার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। সেসময় কয়েক হাজার চীনা উত্তর কোরিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিল আভ্যন্তরীন গোলযোগ থেকে বাঁচতে। তৎকালীন সময়ে চীনে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছিল মূলত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে। সেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবে মাও সে তুং কার্যত পরাস্ত হলেও চীনের জনগণের মনে যে গভীর জাতীয়তাবাদ প্রোথিত হয়েছিল তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ‘ম্যাডম্যান থিওরি’র ফলে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব সফল হতে পারেনি সত্যি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কল্যাণেই চীনে সেসময় পুঁজিবাদ জায়গা করে নিতে পেরেছিল, যার ফলে চীন আজ বিশ্ব বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে পুঁজির দ্বারা।
ঠিক তেমনি, আজ উত্তর কোরিয়ার যে অবস্থান তা মূলত যুক্তরাষ্ট্রেরই অবদান। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার যে চুক্তি হয়েছিল তা এক দশক না যেতেই ভঙ্গ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর এর ফলে, ১৯৯৫ সালেও পিয়ংইয়ংয়ে পুঁজি যতটা বিকাশ লাভ করতে পারেনি, চুক্তি ভঙ্গ করার ফলে মাত্র পনেরো বছরের মধ্যেই উত্তর কোরিয়ায় ব্যাপক পুঁজির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এশিয়ার বেশকিছু দেশের বাজারে ইতোমধ্যেই উত্তর কোরিয়া নিজেদের পণ্যের শরীরে চীনের ব্র্যান্ড লাগিয়ে বাণিজ্য করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, চীনের স্বার্থ রক্ষা করে বাজারে বেশ শক্তিশালী অবস্থানও রয়েছে দেশটির।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রশাসনের কর্মকর্তা টম মালিনোস্কি পলিটিকো ম্যাগাজিনে বলেছিলেন, “পরিবার, বন্ধু এবং সীমান্ত নেটওয়ার্ক ও সনাক্তকরণ এড়ানোর কৌশল অর্জনে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে উত্তর কোরিয়ার জনগণ। পাশাপাশি নিজেদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রশ্নে নতুন দক্ষতাও তাদের তৈরি হয়েছে।” তাই এমতাবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসন যদি মুখোমুখি আলাপ বা আলোচনার মধ্যে দিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে পারে তবেই যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বের মানুষের কল্যাণ হবে বলে মনে করছেন অনেক ভূরাজনীতি বিশ্লেষক।