তাজিনুর রহমানের প্রেমের গল্প ‘নিশির চিঠি’
প্রকাশিত : জুলাই ২৭, ২০২০
অনেক হয়েছে জাহিদ, আর না। একে একে বারো প্যাক গিললি। পুরো বোতলটাই তো খালি করে দিলি দেখছি। এভাবে মদ গিললে পাকস্থলি ফুঁটো হতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না। এই বলে মদের বোতলটি নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো তপু। এতক্ষণে আমার হাত থেকে ধারালো ব্লেডটিকেও ছাড়িয়ে নিলো সে। হাত দিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছে। ব্লেড দিয়ে আমার বাঁ হাতের পুরোটা অংশই আড়াআড়িভাবে কেটে ফেলেছি। সত্যি বলতে হাত কাটার সময় এতটুকু ব্যথাও আমি অনুভব করিনি। কারণ যার মনের ভেতরকার ব্যথার তীব্রতা আকাশসম, তার কাছে এমন হাত কাটা ব্যথার যন্ত্রণা কোনো ব্যাপার হলো!
এসব পাগলামি কেন করছিস জাহিদ? তপু আমাকে জিজ্ঞাসা করলো। আমি উত্তর দিলাম, এসব কেন করছি জানি না। তবে এগুলো করে আমি একটু স্বস্তি অনুভব করছি।
অন্যের জন্য কেউ নিজেকে এত কষ্ট দেয়? তপু জিজ্ঞাসা করলো। আমি বললাম, তুই অন্যের জন্য বলছিস কেন? ও তো আমার জীবনে অন্য হিসেবে ছিল না কখনো। ও ছিল আমার দেহের প্রতিটি হৃদস্পন্দনে। আমার প্রতিটি শিরা উপশিরার মধ্য দিয়ে সর্বদা ওর অস্তিত্ব প্রবাহিত হতো। এই অল্প কয়েকটি দিনের মধ্যেই যে আমি ওকে এক সাগর পরিমাণ ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এখনও আমি যখন বাতাসে কান পাতি, বুকের ভেতর থেকে ওর খিলখিল হাসির ধ্বনি শুনতে পাই। আবার যখন ওর শূন্যতা অনুভব করি তখন প্রাণ নিংড়ানো কান্নার আওয়াজ, চাপা চাপা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসতে থাকে। আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছাইভস্ম হয়ে গেল রে তপু। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয় মাঝেমাঝে। আমার সাজানো গোছানো ফুলের বাগানের মতো জীবনটাকে তছনছ করে ভেঙে দিয়ে গেলো ও।
তপু বললো, না, এখনও কিছুই হয়নি জাহিদ। তুই দেখে নিস. সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
এত সহজ না তপু। প্রেম করলে বুঝতে পারতিস মেয়েরা কতটা ছলনাময়ী হয়।
তপু এবারও বললো, না-না, আমার মন বলছে তোদের সবকিছুই আবার আগের মতো হয়ে যাবে। শুধু আগের মতোই না বরং আরও ভালো কিছু হবে, দেখে নিস। তাছাড়া সব মেয়েই ছলনাময়ী হয় না।
কি জানি, সবকিছু ঠিক হলেই ভালো। কিন্তু সবকিছু আর ঠিক হবে বলে মনে হয় না, তপু। কারণ ও একটা প্রতারক। বিয়ের কথা বলে আমাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গেল।
তপু আমাদের বিচ্ছেদটাকে আর দুচারটা সাধারণ প্রেমের বিচ্ছেদের মতোনই মনে করেছিল। যে কারণে সে বললো, প্রেমে মান-অভিমান, রাগ-ক্ষোভ, বিরহ-মিলন এগুলো হয়েই থাকে। এগুলো ছাড়া প্রেম তার পূর্ণতা পায় না। তোর বেলায়ও হয়তো তাই। তবে তোর বেলায় আমি অতিরিক্ত কনফিডেন্টের সাথে বলছি, দেখিস সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে খুব দ্রুতই।
স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আমার এই মুমূর্ষু অবস্থায় তপু সান্ত্বনা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সকলের জীবনেই এরকম দুচারটা বন্ধু থেকে থাকে। এদের কারণেই হয়ত আমাদের জীবনের বিপদগুলো খুব একটা বেশি সুবিধা করতে পারে না। বিপদ আসলেই এরা তাদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে আমাদেরকে উদ্ধার করে। তপুও আমার এমনই একজন বিপদেরই বন্ধু। সেই ছোটবেলা থেকেই আমার জীবনে বিপদ এসেছে আর ও পাশে থাকেনি এমন কোনো ঘটনা আমার স্মরণে আসে না। স্মৃতির পাতা হাতড়ে এমন ঘটনার নজির আমি কখনো খুঁজে পাই না। আমি বললাম, তাই নাকি! বাহ! তো তোর এত কনফিডেন্ট কোত্থেকে আসলো, শুনি?
তপু বললো, আমার মনে হচ্ছে, নিশি একদিন না একদিন তোর ভালোবাসা ঠিকই বুঝতে পারবে। তুই দেখে নিস, নিশি নিজ থেকেই তোর কাছে এসে ধরা দেবে।
তপুকে বললাম, নিশি ধরা তো দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু বিয়ের বাহানা দিয়ে দূরে সরে গেল যে।
এবার তপু একটু অবাক হলো। জিজ্ঞাসা করলো, বিয়ের বাহানা মানে? আমাকে খুলে বল তো জাহিদ।
আচ্ছা শোন তাহলে, তোকে সবকিছুই খুলে বলছি। গত সপ্তাহে নিশি আমাকে একটি চিঠি লিখে পাঠায়।
চিঠিতে কি লেখা ছিল?
আরে শালা, আমাকে বলতে তো দিবি। এত ব্যাস্ত হচ্ছিস কেন!
ঠিক আছে, বল।
চিঠি দেয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো, ও আমার সাথে আর সম্পর্ক রাখবে না। কিন্তু এমনিতেই তো আর প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে দেয়া যায় না। এর জন্য হাজারোটা কারণের দরকার হয়। তারই কারণ হিসেবে ও এখন আমাকে ওয়াজ-নসিয়ত করছে। ধর্মের বাণী শোনাচ্ছে। পাপ-পূণ্যের হিসেব কষছে। আচ্ছা তপু, তুই বল তো, একজন মানুষের মন ভেঙে দিয়ে তাকে ধর্মের বাণী শোনানো, এটা কোন ধরনের ধার্মিকতা? নিশির দেয়া চিঠিটা আমার প্যান্টের পেছনের পকেটেই ছিল। ওটা বের করে তপুর হাতে দিলাম আর বললাম আওয়াজ করে পড়তে। কারণ নেশার ঘোরে আমি আর কথা বলতে পারছি না। অগত্যা আর একটি সিগারেট ধরিয়ে গাছের সাথে হেলান দিয়ে একটু আরাম করে বসে পড়লাম। আমরা দুজনে উন্মুক্ত মাঠের একপ্রান্তে বড় একটা গাছের নিচে বসে আছি। সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে একটি শান্ত নদী। জোৎনা রাত, আমি মদ আর সিগারেট হাতে নিয়ে বসে আছি। তপু আমার বাঁ-পাশে বসে সান্ত্বনার বাণী শোনাচ্ছে। জোছনা রাতের এই সময়ে নিশির হাতটি ধরে পাশাপাশি বসে থাকার কথা ছিল আমার। অথচ সেই ছলনাময়ীর ছলনায় পর্যবসিত হয়ে আমার এমন করুণ দশা হলো যে, মদের বোতল আর সিগারেট হাতে নিয়ে বসে আছি এখন। মানুষের মন কত বিচিত্র! এই এখানে আছে তো আবার নেই। নানা রকম রঙ ধারণ করে সে। কোন মানুষের প্রকৃত রঙ খুঁজে বের করা বড়ই মুশকিলের কাজ। আরও যদি মানুষটি হয় মেয়েলোক তাহলে তার প্রকৃত রঙ খুঁজে বের করা সে এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমি সিগারেটে ধোঁয়া তুলতে লাগলাম আর তপু সে সময় আওয়াজ করে নিশির চিঠিটা পড়তে আরম্ভ করলো:
আসসালামু আলাইকুম
প্রিয় জাহিদ,
তোমাকে প্রিয় না বলে প্রিয়তম সম্বোধন করতে পারলে আমার অনেক বেশিই ভালো লাগতো। কিন্তু আপাতত সেটা পারছি না বলে বেশ দুঃখ প্রকাশ করছি। আশা করি তুমি ভালো আছ এবং আমিও ভালোই আছি বেশ। জাহিদ, তোমাকে দুইটা প্রশ্ন করবো। এক. আমি যদি বলি তুমি আর আমি যেনাকারী-যেনাকারিনী এবং প্রতিনিয়তই আমরা যেনা করে চলেছি তাহলে কি খুব বেশি অবাক হবে? নিশ্চয়ই খুব করে অবাক হবে তাই না। দুই. এবার যদি জিজ্ঞাসা করি আমরা কি প্রেমিক-প্রেমিকা? তাহলে হয়ত বলবে, হ্যাঁ এটা ঠিক আছে। তাই নয় কি? প্রেমিক-প্রেমিকা বললে অবাক হচ্ছ না অথচ যেনাকারী-যেনাকারিনী বললে খুব করে অবাক হচ্ছ। কী এক আজব ধারণার মধ্যে আমরা রয়েছি আমরা। কিন্তু এই দুইটা জিনিসই যে এক সেটা প্রমাণিত হয়েছে বিশ্বনবির কথার মধ্য দিয়ে। লক্ষ্য করো, বিশ্বনবি (স.) প্রেমিক-প্রেমিকাদের মাঝে যেসব দেখা সাক্ষাৎ এবং ঘোরাঘুরি সংঘটিত হয়ে থাকে সেগুলোকেও যিনা-ব্যভিচার হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। বিশ্বনবি (স.) বলেছেন, দুই চোখের যিনা হচ্ছে, দেখা। দুই কানের যিনা হচ্ছে, শোনা। জিহ্বার যিনা হচ্ছে, কথা। হাতের যিনা হচ্ছে, ধরা। পায়ের যিনা হচ্ছে, হাঁটা। অন্তর কামনা-বাসনা করে। আর যৌনাঙ্গ সেটাকে বাস্তবায়ন করে অথবা করে না। (সহিহ মুসলিম-২৬৫৭)
একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো কি, তুমি-আমি প্রতিনিয়তই দেখা করছি, দুজন দুজনার কথা শুনছি, দুজন কথা বলছি, একসাথে হাতটি ধরে বসছি, একসাথে হাঁটছিও। অথচ কোনোরূপ প্রয়োজন ছাড়াই। আবার অন্তরের টানে রাত জেগে মেসেজও করছি প্রতিনিয়তই। এগুলো শুধুমাত্র আমাদের মনের খায়েশ মেটানোর জন্য। লক্ষ্য করো, বিশ্বনবির (স.) ওই হাদিসের ষষ্ঠ পর্যায়ে আমরা অবস্থান করছি এখন। পর্যায় বোঝার সুবিধার্থে উপরের হাদিসটি তুমি আর একবার পড়ে নাও প্লিজ। ওখানে মোট সাতটি পর্যায় আছে, তার মধ্যে আমরা এখন ষষ্ঠ পর্যায় বা ষষ্ঠ স্তরে অবস্থান করছি। তাহলে এখন শুধুমাত্র যৌনকর্ম মানে সপ্তম এবং সর্বশেষ পর্যায়টা বাকি রয়েছে। এটা পূর্ণ হয়ে গেলেই বিশ্বনবির (স.) পবিত্র উক্তি অনুসারে আমরা দুজনে পূর্ণরূপে যেনাকারী-যেনাকারিনী হিসেব স্বীকৃতি পেয়ে যাব। তাই না? তাহলে বলো, আমাদের মধ্যাকার এমন অবস্থা যদি কন্টিনিউয়াসলি চলতে থাকে তাহলে হয়ত সপ্তম স্তরে পৌঁছাতেও খুব একটা বেশি সময় লাগবে না। তার মানে বিশ্বনবির (স.) উপরোক্ত উক্তির সাথে যদি আমাদের কর্মকাণ্ডকে মিলিয়ে দেখো তাহলে আমরা উভয়ই যেনাকারী-যেনাকারিনী হিসেবে মোটামুটিভাবে সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছি অলরেডি। স্পষ্ট করে বললে, তা প্রায় শতকরা নব্বইভাগ। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো জাহিদ? কেননা উক্ত সাতটি পর্যায়ের ছয়টি পর্যায় এরই মধ্যে আমরা অতিক্রম করে ফেলেছি। এই যে দেখো, স্বয়ং আল্লাহ তা`য়ালা কি বলেছেন, যেনার কাছেও যেও না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত ৩২)
এ আয়াতে আল্লাহ তা`য়ালা এ কথা বলেননি যে, যেনা করো না। বরং বলেছেন, যেনার কাছেও যেও না। অর্থাৎ যেসব কর্ম যেনার দিকে নিয়ে যায় সেগুলোতেও লিপ্ত হয়ো না। আমরা অলরেডি যেনার পথকে বাতলে দেয় এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে গিয়েছি কিনা? উত্তরটা তুমিই তোমার নিজেকে জানিয়ে দিও। এখন লক্ষ্য করো, আমরা আমাদের এহেন অবস্থান যদি ধরে রাখি তাহলে সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে কি শাস্তি দিবেন, বাস্তবিক জীবনে এই সম্পর্কের প্রভাবই বা কি আর তাছাড়া এমতাবস্থায় আমাদেরই বা করণীয় কি তিনটি অংশে আমি তোমাকে তা বলছি। আশা করি তুমি ধৈর্যের সাথে তা পঠন ও অনুধাবন করবে।
যেনাকারী-যেনাকারিনীর শাস্তি বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, যেনাকারিনী নারী ও যেনাকারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশো করে বেত্রাঘাত করো। আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। (সূরা নূর, আয়াত: ২)। এই আয়াতের আলোকে বলা যায় যে, এটাই হচ্ছে অবিবাহিত পুরুষ-মহিলার ব্যাভিচারের ইহকালীন শাস্তি। যদি তারা বিবাহিত হয় বা জীবনে একবার হলেও বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল এমন হয়ে থাকে, তাহলে তাদেরকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করতে হবে। এটা হাদিসের নির্দেশনা । এ মৃত্যুদণ্ডেও যদি তাদের পাপের পূর্ণ প্রায়শ্চিত্ত না হয় এবং তারা উভয়েই তওবা না করে মারা যায় তাহলে তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে পোড়ানো লৌহদণ্ড দিয়ে শাস্তি দেয়া হবে। জাহিদ, এবার তাহলে বলো ইহকালীন শাস্তি থেকে হয়ত আমরা কোনো না কোনোভাবে বেঁচে যাব, কিন্তু পরকালীন শাস্তি থেকে আমরা কিভাবে পরিত্রাণ পাব, বলো?
বিশ্বনবি (স.) বলেছেন, যিনারাকীরা উলঙ্গ অবস্থায় এমন এক চুলার মধ্যে থাকবে যার অগ্রভাগ হবে অত্যন্ত সংকীর্ণ আর নিম্নভাগ হবে প্রশস্ত। উহার তলদেশে অগ্নি প্রজ্বলিত থাকবে আর তাদেরকে তাতে দগ্ধ করা হবে। তারা মাঝে মধ্যে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার কাছাকাছি অবস্থায় পৌঁছে যাবে। এরপর আগুন যখন স্থিমিত হয়ে যাবে তখন তারা আবার সেখানে ফিরে যাবে। আর তাদের সাথে এই আচারণ কেয়ামত পর্যন্ত করা হবে। সহিহ বুখারী ৭০৪৭)
বিশ্বনবি (স.) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো মহিলাকে কুমতলবের ইচ্ছা নিয়ে স্পর্শ করবে তথা দেহের বিভিন্ন অঙ্গ দ্বারা যিনায় লিপ্ত হবে, কিয়ামতের দিন সে এমনভাবে উত্থিত হবে যে, তার হাত তার ঘাড়ের সাথে যুক্ত থাকবে। সে যদি এ নারীকে চুমু দিয়ে থাকে, তাহলে তার ঠোঁট দুটিকে আগুনের কাঁচি দিয়ে কেঁটে ফেলা হবে। আর যদি তার সাথে যিনায় লিপ্ত হয়ে থাকে তাহলে তার দুই ঊরু সাক্ষী দেবে, আমি অবৈধ কাজের জন্য আরোহণ করেছিলাম। তখন আল্লাহ তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাবেন এবং এতে সে অপমান বোধ করে গোয়ার্তুমি করে বলবে, আমি এ কাজ করিনি। তখন তার চোখ বলবে, আমি অবৈধ বস্তুর দিকে তাকাতাম। কান বলবে, আমি অবৈধ কথাগুলো শুনতাম। জিহ্বা তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে বলবে, আমি অবৈধ বিষয়ে কথা বলেছিলাম। হাত সাক্ষ্য দেবে, আমি অবৈধ বস্তু ধরেছিলাম। দুখানা পা বলবে, আমি ব্যভিচার করেছি। তখন প্রহরী ফেরেশতারা বলবে, আমি শুনেছি। অন্য ফেরেশতা বলবে, আমি লিখে রেখেছি। সর্বশেষ মহান তা`য়ালা আল্লাহ বলবেন, আমি জেনেছি এবং লুকিয়ে রেখেছি।
অতঃপর আল্লাহ তা`য়ালা আদেশ দিবেন, হে ফেরেশতাগণ, একে পাকড়াও করে আমার আযাব ভোগ করাও। কেননা যে ব্যক্তির লজ্জা কমে যায় তার উপর আমার ক্রোধের অন্ত নাই। আর নিশ্চিতভাবে প্রেম নামক এই অবৈধ সম্পর্কটি পরিচালনার জন্য আমাদেরকে লজ্জার সর্বোচ্চ স্তর অতিক্রম করতে হয়েছে। যেমন তুমি আমার জন্য মুহরিম নও। তার মানে অপ্রয়োজনে তোমার সাথে আমার দেখা এবং কথা বলা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। অথচ তা প্রতিনিয়তই করছি। যার দ্বারা লজ্জার সর্বোচ্চ স্তর অটোমেটিক অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। তাই নয় কি, জাহিদ? শুধু তাই-ই নয়, এ হাদিসের সমর্থনে নিম্নের আয়াত দ্বারাও সেটির সত্যতা প্রমাণিত হয়, যেদিন তাদের কৃতকর্মের বিরুদ্ধে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও পা সাক্ষ্য দেবে। (সূরা আন নূর ২৪)
আল্লাহ তা`য়ালা বলেন, শয়তান তাদের মন্দ কাজসমূহকে তাদের দৃষ্টিতে চমৎকার ও মনোহরি করে তোলে এবং এভাবে তাদেরকে সরল সঠিক পথ অবলম্বনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। (সূরা আনকাবুত ৩৮)। জাহিদ, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, প্রেমের সম্পর্কে কি এমন অশ্লীলতা আছে? আমরা চাইলেই তো তা পবিত্র রাখতে পারি। আসলে বিষয়টা ঠিক এরকম নয়। অবৈধ প্রেম যেখানে নিজেই একটা অপবিত্র ফাংশন আর তুমি-আমি এই অপবিত্র ফাংশনের চলক হয়ে কিভাবে তা পবিত্র রাখবো, বলো। আরো যদি স্পষ্ট করে বলি, একটা পুকুর পুরোপুরি নাপাক পানি দ্বারা পূর্ণ। এখন ঐ পুকুরের পানি দিয়ে কিভাবে পবিত্রতা আদায় করবো? অবৈধ প্রেমও ঠিক এরকমই একটা অপবিত্র গহ্বর। যেখানে নিমজ্জিত থেকে পবিত্রতার কথা কল্পনা করা নিতান্তই অনর্থক বৈ কিছু নয়। হ্যাঁ, সম্পর্ককে পবিত্র রাখা যায় তবে তা অবৈধ প্রেমের মাধ্যমে নয় বরং বিবাহোত্তর বৈধ প্রেমের মধ্য দিয়ে। যা একটু পরেই আমি তোমাকে বলবো। তাহলে এখন তুমি আমাকে বলো, এরকম একটা অপবিত্র সম্পর্কের মাধ্যমে সর্বদা পাপে নিমজ্জিত থেকে যদি হাজারোটা পূণ্যের কাজ করি তাহলে তা কি করে সৃষ্টিকর্তা গ্রহণ করবেন?
অবৈধ প্রেম-ভালোবাসায় জড়িতরা নানাভাবে হারাম কাজ ও আল্লাহ তা`আলার নাফরমানির মধ্যে ডুবে থাকে। এর ফলে তাদের দিলে একের পর এক কালো দাগ পড়ে দিল অন্ধকার হয়ে যায়। ফলে সে ভালো মন্দের পার্থক্য নিরূপণে ব্যর্থ হয়। অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা করার পর এ সম্পর্ক কোনো কারণে ছিন্ন হলে বিরহ বেদনা তাকে গ্রাস করে। এতে জীবন বরবাদ হয়ে যায়। মাদকাসক্ত হয়ে যায় অনেকে। অনেকেই আবার আত্মহত্যার মতো জঘন্য পন্থাকেও বেছে নিতে এতটুকু কার্পণ্য করে না। এভাবেই সে তার দুনিয়া ও আখিরাতকে ধ্বংস করে। বিবাহের আগে প্রেম-ভালোবাসা করলে, যদি তাদের বিবাহও হয়, কিন্তু পবিত্র বিবাহ বন্ধনের আগেই অপবিত্র সম্পর্কের কারণে তাদের বিবাহের বরকত নষ্ট হয়ে যায়। এতে তাদের বৈবাহিক জীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি চরম আস্থাহীনতায় ভোগে। স্বামীর কাছে স্ত্রীর আর স্ত্রীর কাছে স্বামীর সততা থাকেনা তাই সাধারণ ও তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তারা একে অন্যকে সন্দেহ করতে থাকে। ফলে এধরনের বিবাহ অনায়াসেই ভেঙে যায়। যার নমুনা বর্তমান সময়ের ডিভোর্সের হার দেখলেই অনুমান করা যায়। অবৈধ প্রেম-ভালোবাসার কারণে অনেক টাকা-পয়াস ও মূল্যবান সময় অনর্থক নষ্ট হয়।
অবৈধ প্রেম-ভালোবাসার কারণে প্রচুর মিথ্যা কথা বলা লাগে, আর মিথ্যা বলা মহাপাপ। একসময় মিথ্যা বলতে বলতে এমন হয়ে যায় যে, তখন আর মিথ্যা বলতে বুকে বাধে না। অনায়াসেই যাকে তাকে মিথ্যা বলার অভ্যাস গড়ে ওঠে। বিশ্বনবি (সা.) বলেছেন, হে মুসলমানগণ, তোমরা এরূপ অবৈধ সম্পর্কগুলো ত্যাগ করো। যেগুলো তোমাদেরকে যেনা-ব্যভিচারের দিকে ধাবিত করে। এগুলো পরিত্যাগ করো। কেননা এর ছয়টি শাস্তি রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি দুনিয়াতে ও তিনটি আখেরাতে প্রকাশ পাবে। দুনিয়ায় শাস্তি হচ্ছে, চেহারার ঔজ্জ্বল্য বিনষ্ট হয়ে যায়, আয়ুষ্কাল কমে যায় এবং দারিদ্রতা চিরস্থায়ী হয়ে যায়। আর যে তিনটি শাস্তি আখেরাতে প্রকাশ পাবে তা হচ্ছে, সে আল্লাহর অসন্তোষের পাত্র হবে, কঠিন হিসাবের সম্মুখীন হবে এবং জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। (বায়হাকি ৫৬৪)
জাহিদ, সত্যিকারার্থেই যদি আমরা একে অপরকে ভালোবেসে থাকি তাহলে এখন আমাদের করণীয় হলো দুটি। এক. তওবা করা। আল্লাহ তা`য়ালা বলেন, যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তত করে এবং দেবেন। আর আল্লাহ তা`য়ালা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা ফুরকান ৬৯)। বিশ্বনবি (স.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যখন ব্যভিচার করে তখন তার ভেতর থেকে ঈমান বেরিয়ে যায়, এরপর তা তার মাথার উপর ছায়ার মতো অবস্থান করতে থাকে। এরপর সে যখন তা থেকে তওবা করে তখন তার ঈমান পুনরায় তার কাছে ফিরে আসে। (আবু দাউদ ৪৬৯০, সুনানে তিরমিজি ২৬২৫)
আর দুই নম্বর করণীয় হচ্ছে, বিয়ে করা। এটা শুনে হয়ত আকাশ ভেঙে পড়বে তোমার মাথায়। এমনটা প্রথমে আমারও হয়েছিল। পরবর্তী যখন বিষয়টি বুঝতে পারলাম তখন মনে হলো, এটিই আমার করণীয় হওয়া উচিত এবং সিদ্ধান্ত নিলাম আমি তা করবো। এটাই মনে মনে ঠিক করলাম। জাহিদ, তোমাকে আমি ভীষণ রকমের ভালোবাসি। সারাজীবনের জন্য তোমাকে আমি পেতে চাই। একটিবারের জন্যেও আমি তোমাকে হারাতে চাই না। আর তোমাকে আপন করে পাওয়ার জন্য বিয়ের চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনো উপায় আমি দেখি না। যদি তুমি বিয়ের চেয়ে ভালো কোনো উপায় খুঁজে পাও তাহলে আমাকে জানিও। আমি তোমারটা মেনে নেব। আমার মনে হয়, সম্পর্ক রক্ষার জন্য বিয়ের চেয়ে উৎকৃষ্টতর কোনো পন্থা তুমি খুঁজে পাবে না। কারণ স্বয়ং আল্লাহ তা`য়ালা বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (সূরা নূর ৩২)।
এখন হয়ত ভাববে, বিয়ে করে আমাকে খাওয়াবে কি, পড়াবে কি? এখন কি বিয়ের জন্য আমরা উপযুক্ত হয়েছি নাকি? এরকম অনেক প্রশ্ন সামনে আসবে। জাহিদ, আমি তোমাকে বলি, বিয়ের পর পরই কেন আমাকে খাওয়াতে হবে তোমার। প্রেম যখন করতে তখন আমার ভরণপোষণের দায়িত্ব কি তুমি নিয়ে করতে? দায়িত্ব না নিয়ে প্রেম করছো কেন তাহলে। এগুলো আমাদের সমাজের কিছু সংখ্যক মানুষের তৈরি করে দেয়া রীতি। আর ওইসব মানুষগুলোই কিনা শয়তানের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে আমাদের সমাজে এই অবৈধ প্রেম, মেলামেশা, অশ্লীলতাকে ছড়িয়ে দিতে চায়। এগুলো ভিত্তিহীন। অবৈধ প্রেম নামক অশ্লীলতা, নোংরামির বেলায় কারও কোনো বাধা নাই, বিয়ের কথা আসলেই আসে নানা অজুহাত। জাহিদ, তুমি কি আল্লাহ তা`য়ালার দেয়া প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাসী নও? নাকি আল্লাহ তা`য়ালার দেয়া উপদেশের চেয়েও উৎকৃষ্ট কোনো উপদেশ অনুসরণ করো তুমি? আর এমন উপদেশ দেয়ার সাধ্যই বা কার আছে! শোনো, আমি আমার বাবা-মা সবাইকেই আমাদের বিষয়টা খুলে বলেছি। আমার বাবা-মা তারা সবকিছু মেনে নিবেন যদি তোমার পরিবার থেকে বিয়ের জন্য রাজি থাকেন। জাহিদ, বিশ্বনবির (স.) বাণীগুলো একটু লক্ষ্য করলে তোমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হয়ত পেয়ে যাবে।
বিশ্বনবি (স.) বলেছেন, হে যুব সম্প্রদায়, তোমাদের মাঝে যারা বিয়ে করতে সক্ষম তারা যেন বিয়ে করে নেয়। কারণ বিয়ে দৃষ্টি অবনত রাখতে এবং গুপ্তাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষায় অধিক সহায়ক। আর যে বিয়ে করতে সক্ষম নয় সে যেন রোযা রাখে। কেননা রোযা তার যৌন ক্ষুধাকে দমিত করবে। (বুখারী ২/৭৫৮; মুসলিম ১/৪৪৯; ইবনে মাজা ১৩২)
বিশ্বনবি (স) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যখন বিয়ে করল তখন সে যেন দ্বীনের অর্ধেকটা পূর্ণ করে ফেলল। এখন সে যেন বাকি অর্ধাংশের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে। (মিশকাত ২/২৬৮)। বিশ্বনবি আরো বলেন, তিন শ্রেণির লোককে আল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করবেন, স্বাধীন হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ গোলাম, আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তি। (তিরমিযী ২/২৯৫৪; নাসায়ী ২/৫৮; ইবনে মাজা ১৮১)
জাহিদ লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে বিয়েতে রয়েছে কি অসাধারণ ফজিলত ও আল্লাহ তা`য়ালার রহমত! মানুষ মানবিক প্রাকৃতিক চাহিদার কারণেই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তুমি হয়ত বলবে, এখন কি আমাদের বিয়ের সময় হয়েছে নাকি? তাহলে আমি তোমাকে প্রশ্ন করি, তাহলে এখন আমাদের প্রেমের সময় আসছে নাকি? বৈধ প্রেম তো বিয়ের পরে হয়। এখন যেটা আছে সেটা অবৈধ, অশ্লীলতা, অনর্থক বৈ কিছু নয়। দেখো, ইসলাম বলেছে বিয়ে আর্থিক সচ্ছলতার কার্যকর উপায়। কখনো বলেছে, পবিত্রতার কার্যকর মাধ্যম। আবার কখনও বা বলেছে দ্বীনের অর্ধেক। কখনও বা আখ্যায়িত করেছে আল্লাহর সাহায্য লাভের মাধ্যম হিসাবে। সম্ভবত এত ফজিলত ও মর্যাদার কথা অন্য কোন ইবাদত সম্পর্কে বলা হয়নি। এর কারণও আছে। কেননা সকল ইবাদত বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ রূপে আদায়ের জন্য প্রয়োজন শারীরিক, মানসিক ও চারিত্রিক শুদ্ধতা, পবিত্রতা এবং স্থিতিশীলতা। যার অনেকটাই নির্ভর করে বিয়ের উপর।
তোমার অভিভাবককে রাজি করানোর দায়িত্ব নিতান্তই তোমার। আমাকে যদি সত্যিকারার্থেই ভালোবেসে পেতে চাও তাহলে যত দ্রুত সম্ভব হয় আমাদের দুজনার মিলনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ানো বিয়ের কাজটাকে মিটিয়ে দাও। জাহিদ তোমাকে ভীষণ রকমের ভালোবাসি আমি। তোমাকে ছাড়া হয়ত বেঁচে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তবুও এ পথে আমার কিছু করার নেই। সৃষ্টি কর্তার বিধানকে উপেক্ষা করে আমি তোমাকে চাই না। স্রষ্টার সন্তুষ্টিকে লক্ষ্য করে আমি পথ চেয়ে রইলাম তুমি আসবে বলে।
ইতি
ক্ষমাপ্রার্থী
চিঠি পড়ার পর তপুর চোখে পানি দেখতে পেলাম। অনুশোচনায় সে হাঁসফাঁস করছে বলে মনে হলো। আমি তপুকে জিজ্ঞেস করলাম, ওই ছাগলের বাচ্চা, তোর আবার কি হলো? একটু আগেই তুই না বড় মাপের কনফিন্ডেসের কথা বলে আমাকে সান্ত্বনার বাণী শোনাচ্ছিলি! নিশির চিঠি পড়ে এখন তুই কেন মেয়েলোকের মত মায়া কান্না জুরে দিলি। নিশির লিখা চিঠি পড়ে ইমোশনাল হয়ে গেলি তাই তো। হা হা (অট্টহাসিতে ফেটে পারলাম আমি) আরেহ! মেয়েরা এমনই হয় বেটা। খবরদার কখনো মেয়েদের খপ্পরে পরিস না তাহলে এই আমার মতো বরবাদ হয়ে যাবি বুঝলি। এই নে সিগারেট ধরা। তপু আমার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ও শুধু ছটফট করছিল, কেন জানি অস্থির মনে হলো ওকে। তপুকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে তপু? হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেলি কেন? তপু বললো জাহিদ শোন, আমার সাথে প্রিয়ার প্রেমের সম্পর্ক গত তিন বছর ধরে। ওকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললাম তপু, তুইও প্রেম করিস তাহলে? তপুর প্রেমের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তপুকে এতটাই ভদ্র ছেলে বলে আমরা জানতাম যে, ও হয়ত এসব প্রেম পিরিতি কখনো করবে না। যেই ছেলে তামাকটুকু পর্যন্ত কখনো ছুঁয়েও দেখে নাই। পড়াশোনায় ভালো, ধর্ম কর্মের দিক দিয়েও যথেষ্ট এগিয়ে ছিলো আমাদের চেয়ে। ওর দ্বারা প্রেম! আমি ভাবতেই পারি নাই।
ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, তপু তুই মজা করছিস না তো? তপু বললো একদমই মজা করছি না আমি। শুধু তাই ই না প্রিয়ার সাথে প্রেম হওয়ার পর থেকে ওর সাথে আমার বেশ কয়েকবার শারীরিক সম্পর্কও হয়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কি বলিস তপু? তোর মাথা ঠিক আছে তো। তোর দ্বারা প্রেম, তারপর আবার শারীরিক সম্পর্ক। এবার ভাবলাম ও বুঝি সত্যিই বানিয়ে বানিয়ে বলছে। তখন আমি বললাম, তোর এইসব আজাইরা কথাগুলোও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। কি দিন আইলো রে! আমি মোটেই তপুর কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছি না। ভাবছিলাম তপু হয়ত আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই এমনটা বানিয়ে বলছে। তপু বললো, বাবা-মা আর সমাজের চোখে ভালো থাকার জন্য আমার প্রেমের কথা কখনোই কাউকে জানাই নি। শুধুই আমার আর প্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সবকিছু। বাবা জানলে আমাকে মেরেই ফেলবে। এছাড়াও আমাদের সমাজ একটা নিয়ম চালু করে রেখেছে যে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বিয়ে নয়। প্রতিষ্ঠিত হওয়া বলতে তারা ভালো চাকরি পাওয়া বা ব্যাবসার মাধ্যমে অর্থিকভাবে ভালো অবস্থানে আসাকে বোঝায়। চাকুরী ও ব্যাবসায়ে ভালো অবস্থানে আসার জন্য হয়ত সময় লাগবে কিন্তু ততদিনে আমার মনের ও শরীরের চাওয়াকে কিভাবে কন্ট্রোল করবো যা প্রতিনিয়ত আমাকে ক্ষুধার্থ থেকে অধিকতর ক্ষুধার্থ করে তুলছে। বিয়ের মাধ্যমে বৈধ প্রেমে যেখানে এতো বাধা অবৈধ প্রেম ছাড়া এরকম শারীরিক বা মানসিক চাহিদা কিভাবেই বা পূরণ হবে। আর তাছাড়া আমাদের দেশের অধিকাংশ যুবক-যুবতীরাই এখন এই অবৈধ প্রেমের দিকে ধাবিত। পর্দার অন্তরালে এসব প্রেমের নামে চলে নোংরামি, অশ্লীলতা। জাহিদ, তোর কপালটা অনেক ভালো যে নিশির মতো মেয়ে তোকে ভালোবেসেছে। নিশি সত্যিকারার্থেই তোকে ভালোবেসে পেতে চায় বলেই এমন চিঠি লিখে পাঠিয়েছে। প্রিয়া আমাকে এমন করে বললে কখনোই তা উপেক্ষা করতাম না। শুধু তাই ই না এমন পাপের পথেও আমি হাঁটতাম না আবার এই নোংরামির পথেও যেতাম না। সমাজের চোখে আমি অনেক ভালো আছি ঠিক আছে কিন্তু আমার ভেতরটা তো কর্দমাক্ত করে ফেলেছি। অনুশোচনার আগুন আমার বুকে দাউ দাউ করে জ্বলছে, জাহিদ। অনুশোচনার জ্বালাটা কি সেটা শুধু আমি বুঝতে পারছি এখন। অথচ তুই কি করছিস? নিশির চিঠি পেয়ে কোথায় আরও ভালো হবি তা তো নয় ই উল্টা আরও মদ গিলতেছিস। তোর সাথে আর এক মুহূর্তও নয়। থাক তুই এখানে। মদ গেল বেশি করে আর ব্লেড দিয়ে হাত-পা যা মনে চায় কাট। লাগলে বল, তোকে আরও মদ, সিগারেট, ব্লেড নিয়ে এসে দেই। এই বলে তপু আমাকে রেখেই চলে গেল।
তপুর চলে যাওয়ার পর আর একটা সিগারেট ধরালাম আমি। নেশার ঘোরে কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ওখানেই কাত হয়ে পরে রয়েছি আমি নিজেও জানি না। রাত দুইটা বাজে তখন। বাড়িতে ফিরি নাই দেখে আমার বাবা-মা সহ পরিবারের সবাই হন্য হয়ে আমাকে খুঁজতে বের হয়েছে। কোথাও খুঁজে না পেয়ে আমার বাবা তপুদের বাড়িতে চলে আসছেন। তপু আমার বাবাকে সাথে নিয়ে নির্জনে আমি যেখানে বসে সিগারেট টানতেছিলাম অগত্যা ঐ জায়গাতে চলে আসলে। সেদিনের মতো আমাকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে গেল। ঐ দিনই সব কিছু শেষ হয়ে গেলে হয়ত ভালো হতো। কিন্তু তা আর হলো কই। নিশি আমাকে বলেছে, বিয়ে না করলে আমার সাথে অপ্রয়োজনীয় একটি কথাও সে বলবে না এমনকি দেখাও করবে না। ওকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না। নিশির সেই কথাটিই যেন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, তোমার সাথে আর দেখা হবে না। এরপর থেকে আমার নেশা করার মাত্রাটা অধিক থেকে অধিকতরর সীমনা অতিক্রম করলো। নেশার মধ্য দিয়ে নিজেকে শেষ করার সর্ব্বোচ্চ স্তরে নিয়ে গিয়েছি ততদিনে। নেশার জগতে এমন কোন বস্তু নেই যেটির সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় নি। আর এর সবটাই ছিলো, নিশির চলে যাওয়ার জন্য। নিশি চলে না গেলে হয়ত আমার জীবনটা অন্যরকমও হতে পারতো।
এদিকে নেশার দরূন আমার অবস্থা বেগতিক দেখে তপু আমার বাবা-মাকে সবকিছু বলে দেয়। বাবা-মা প্রথমে আমাকে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে কাউন্সেলিং করানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আমার সাথে গত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া বিষয়টির গভীরতা বুঝতে পেরে অবশেষে আমার বাবা-মা নিশির বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে যেতেই রাজি হন। আর বিপত্তিটা বাধলো সেখানেই। বাবার সামনে আসলো নানা প্রশ্ন, লোকে কি বলবে? এতটুকু বয়সে ছেলেকে বিয়ে দিচ্ছো কেন? ছেলে তার বৌকে খাওয়াবে কি? তুমি কি সমাজে মুখ দেখাতে পারবা? এমন হাজারওটা প্রশ্ন। নিজের ছেলের জীবন বাঁচানো যেখানে বড় কথা সেখানে কে কি বললো তাতে বাবার কি আসে যায়। নিজের লজ্জ্বা-শরম ও সমাজের রীতিনীতিকে উপেক্ষা করেই বাবা নিশির বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। ওদিকে নিশি ওর বাবা-মাকে বিষয়টি ভালোভাবেই বোঝাতে পেরছিল। ফলে দুই পরিবারের সম্মতিতেই আমার ও নিশির প্রণয় হয়ে গেলো। যতদিন পর্যন্ত না আমি কোন কর্ম করছি ততদিন নিশির সকল দেখভালের দায়িত্ব ওর বাবাই করবেন বলে আমার বাবাকে কথা দিলেন। মেয়েকে এ বয়সে বিয়ে না দিলেও তো তাকেই দেখতে হতো। তবুও আমার বাবা বললেন, নিশি চাইলে ওর শশুর বাড়িতেও থাকতে পারবে। এরপর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই। তারপর হলে চলে আসি। সেই ইন্টারমিডিয়েটের ঘটনা ছিলো এটি। তখন আমার বয়স ছিলো আঠারো। নিশি পড়তো আমার এক ক্লাস নিচে। ওর বয়স তখন ষোল কি সতের হবে। একবছর পর নিশিও মেডিকেলে চান্স পেয়ে হোস্টেলে চলে আসে।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হলো কিছুদিন আগে। একটি সরকারি চাকুরিও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। ওদিকে নিশিরও এমবিবিএস প্রায় শেষ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এমন অনেক বন্ধুকে দেখেছি প্রেম নামক এই ফাঁদে পা দিয়ে নিজের সাজানো গোছানো ক্যারিয়ারটাকে ধ্বংস করে দিতে। তাদের এতদিনের রাতজাগা পড়াশোনা, পরিশ্রম, বাবা-মায়ের জমানো স্বপ্নেগুলোর জলাঞ্জলি দিতে। দিনের পর দিন এভাবে পড়াশোনা না করে এই অবৈধ প্রেমে অনেক সময় নষ্ট করতে দেখেছি তাদেরকে। কখনো বা শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য পতিতালয়েও যেতে দেখেছি ওদেরকে। অনেকেরই গার্লফ্রেন্ড বিয়ে হয়ে যাওযায় নেশার জগতে বিচরণ ঘটছে যেমনিভাবে সেই ইন্টারমিডিয়েটে থাকাকালীন আমি করেছিলাম। কেউবা প্রেম বলতেই যৌনতা, নগ্নতাকে বুঝতো। তাদেরকেও দিনশেষে সেক্সুয়ালি ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে হিরোইন সেবন করতে দেখেছি। অথচ এরকমটা আমার ক্ষেত্রে কখনোই হয়নি। যৌবনের মৌবনের ঊষালগ্ন থেকেই ভুল পথে না যাওয়ার গাইডবই যে আমার ছিলো। যৌবনের মৌবনের ঊষালগ্ন থেকেই ভুল পথে না যাওয়ার গাইডবই যে আমার ছিলো। এজন্য হয়ত কুপথে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে নি। যে কারনে আমার ক্যাম্পাসের পুরোটা সময় আমার নিজের কাজে ব্যায় করার মতো একটা মানসিক স্থিতিশীলতা আমি লাভ করি। ওসবের দিকে কখনো ভ্রূক্ষেপ করার প্রয়োজনবোধও করিনি আমি। কারণ আমার যে একটা নিশি ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই। বিয়ের মাধ্যমে নিশি সাথে আমার যে প্রেম হয় সেখানে ছিলো পবিত্রতা, অগাধ বিশ্বাস আর স্রষ্টার সন্তুষ্টি। স্রষ্টার সন্তুষ্টির মাধ্যম হলো বিয়ে। বিয়ের মধ্য দিয়ে যে প্রেমের বাঁধন শুরু হয় তা কি কখনো টুটে যায়! অবিশ্বাস সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার কোন সুযোগই যে পায় না। গাঁটছড়া বান্ধনের দরূন একে অন্যকে ছেড়ে যাওয়াও তো অসম্ভব। তাই কখনো কোন প্রলোভন আমাকে-নিশিকে তথা উভয়কেই কখনোই আপণ পথ থেকে এতটুকু বিচ্যুতি করতে পারে নাই।
অথচ ওদের সাথেও এরকম হতো না যদি আমাদের সমাজে বিয়েটাকে সহজ করে দেওয়া হতো। অধিকাংশ যুবক-যুবতীরা উঠতি বয়সেই বিপথে চলে যায় তাদের নিজেদের প্রবৃত্তির তাড়নায়। কেউ কেউ হয়ত সেই প্রবৃত্তিকে দমন করে রাখতে পারে তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। না পারার দলের সংখ্যাটাই বেশি। যে কারণে শুরু হয় এরূপ অবৈধ সম্পর্ক যা ধীরে ধীরে একজন মানুষকে ধ্বংসের সর্বোচ্চ স্তরের দিকে পরিচালিত করে। তাদের সবচেয়ে বড় ভয়- এই বয়সে বিয়ে করলে সমাজের মানুষ কি বলবে। এই সমাজ কি এই বয়সে বিয়েকে মেনে নিবে। এখনে মনে রাখা প্রয়োজন যে কে কি বলবে, তার বলা না বলা কখনোই সমাজের রীতিনীতি হতে পারে না। আল্লাহ তা`য়ালার সন্তুষ্টিকে মাথায় রেখে সমাজে আমি যা করবো তাই ই সমাজের রীতিনীতি। এই কথাটা আমাদের সকলকেই মেনে নিতে হবে। আমি নিজেই আমার সমাজ। আমার সমাজের রীতিনীতির মূল লক্ষ্যই হলো- মহান আল্লাহ তা`য়ালার সন্তুষ্টি। সেই আল্লাহ তা`য়ালা সন্তুষ্টির জন্য আমি বিয়ে করবো অবৈধ প্রেম নয়। এমন প্রতিজ্ঞাবাক্য উচ্চারণ করতে একবুক সাহসের প্রয়োজন হয়। কিন্তু তা আমাদের ক`জনেরই বা আছে।
কিন্তু তা আমাদের ক`জনেরই বা আছে।নিশির এই চিঠির তাৎপর্য আমার জীবনে কতটুকু তা এখন তিলে তিলে আমি অনুধাবন করতে পারি। নিশির মতো এমন নারী আমার জীবনে আসায় আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি। এজীবন সত্যিই ধন্য হলো নিশির মতো এমন নারীকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে। কোন এক জোৎসা রাতে বারান্দায় বসে নিশিকে জিজ্ঞাসা করলাম, নিশি, বিয়ে করে তোমায় খাওয়াবো কি? নিশি মুচকি হেসে বললো হা হা, এখন আর এ কথা বলার সাধ্য কোন বাবার ছেলের আছে বলো।খাওয়ানোর দায়িত্ব যার হাতে খাওয়ার ব্যাবস্থাও তো তিনিই করবেন, তাই নয় কি? হ্যাঁ, তাই তো। এরপর বললাম নিশি, আমি চাকুরি পেয়ে গেছি। তাও আবার সরকারি। চাকুরির কথা শুনে নিশি এতটুকুও অবাক হলো না। আমার মনে হলো, চাকুরী না হলেও বুঝি নিশির কিছু আসে যায় না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যেই নিশির জীবীকার জন্য তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা রেখেছে চাকুরী সংবাদ যে তাকে এতটুকুও বিমোহিত করবে না এটাই স্বাভাবিক। নিশি বললো, চাকুরী পেয়েছো ভালো কথা এখন বলো আমার সেই চিঠিটা কোথায়। নিশি কথার মোড়টাকে পুরোপুরি অন্য দিকে নিয়ে গেলো। এরপর বললো তুমি নাকি সবসময় আমার সেই চিঠিটাকে সাথেই রাখতে?
কে বললো তোমাকে?
আমার মন বলেছে।
তোমার চিঠিটা? সেটা তো এখনও আমার কাছে সযত্নে আগলে রেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তোমার ঐ চিঠির উজ্জীবনী শক্তিই আমার বিপথে না যাওয়ার মূলমন্ত্র ছিলো।
থাক হয়েছে। আর বলতে হবে না।
নিশি, সুন্দর একটা বাসা নিয়েছি জানো। তোমার হোস্টেল লাইফ শেষ হলেই একসাথে পথচলা শুরু করবো।
এখন কি একসাথে নেই আমরা? সেই কবেই তো বিয়ে করেছি। পাঁচ বছর হয়ে গেলো প্রায়।
হ্যাঁ, আছি তো। তবে তখন আরও কাছাকাছি থাকবো। তোমাকো বুকের মধ্যে আগলে রাখবো। জড়িয়ে রাখবো পুরোটা সময়।
যাও তো। এত ঢং করতে হবে না।
নিশি, বাবা-মা এখন নাতি পুতির স্বপ্ন দেখছে। তাছাড়া আমারও না বাবা ডাক শুনতে খুব ইচ্ছে করে জানো। তুমি কি বলো?
যাহ!
নিশির মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। অগত্যা ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে মুখটি ঢেকে বারান্দা থেকে দৌড়ে ঘরের ভেতরে চলে গেলো সে। বাহির থেকে দেখতে পেলাম, একটি বালিশ জড়িয়ে ধরে নিশি বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে মুচকি হাসছে আর কি যেন ভাবছে।
লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়