ঢাকা থিয়েটারের নাটক মেডিয়া: নারীর বিদ্রোহ
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ১২, ২০২৩
শনিবার সন্ধ্যায় হুমায়ুন কবীর হিমু নির্দেশিত এবং ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত মেডিয়া নাটকটা দেখলাম শিল্পকলা একাডেমীতে। প্রাচীন যুগে গ্রিক এই নাটকটি লিখেছেন বিশ্বের সেরা নাট্যকারদের একজন ইউরিপিডিস। নাটকটির বাংলা অনুবাদ করেছেন আব্দুস সেলিম। যানজটের কারণে সাভার থেকে ঢাকা পৌঁছাতে সামান্য দেরি হয়েছিল। নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছিল শিল্পকলা একাডেমির অষ্টম তলায় স্টুডিও থিয়েটারে। নাটক তখন শুরু হয়ে গেছে। দশ-বারো মিনিট পরে আমি শিল্পকলা একাডেমিতে পৌঁছেছিলাম সাভার থেকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, নাটকীয়ভাবে নিচেই দেখা হলো ঢাকা থিয়েটারের প্রধান ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাইর সঙ্গে। বাচ্চু ভাই সঙ্গে করে নিয়ে অন্ধকার মিলনায়তনে প্রথম সারিতে বসিয়ে দিলেন। মেডিয়া চরিত্রে মঞ্চে তখন অভিনেত্রী তাহমীদা একা একা সংলাপ বলে যাচ্ছেন। তার মুখের উপর নাটকীয় নানান রকম আলো কিংবা আলো আঁধারির খেলা চলছে। আমি ঢুকেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর অভিনয় দেখছিলাম এবং একই সঙ্গে তাঁর বলা সংলাপগুলি গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছিলাম। খুব সামান্য সময়ের মধ্যে আমার পুরো মনোযোগ নাটকটি দখল করে নিয়েছিল।
মঞ্চায়িত নাটকে যদি গুরুত্বপূর্ণ আখ্যান থাকে এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে পরস্পরের বিরুদ্ধে উচ্চারিত যুক্তিপূর্ণ সংলাপ থাকে, তাহলে তা খুব সহজেই দর্শকদের আকৃষ্ট করে। নাট্যকারের রচিত এই ধরনের সংলাপের ভিতর দিয়ে যখন নাটকে কয়েকটি আকর্ষণীয় চরিত্র সৃষ্টি হয় এবং সেই সব সংলাপ অভিনয়কালে অর্থবোধকভাবে প্রক্ষেপণের মধ্য দিয়ে চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে, মঞ্চায়িত নাটকটি তখন প্রবলভাবে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। নাটকে ধারালো সংলাপ না থাকলে নাটক সেভাবে উপভোগ্য হয় না। যদি অভিনেতা অভিনেত্রীরা নাটকের চরিত্রের মুখে বসানো নাট্যকারের সেইসব সংলাপকে জীবন্ত করে তুলতে পারেন নাটক গতিশীল হবেই এবং দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করবেই। মেডিয়া নাটকে এই লক্ষণটি জোরালোভাবেই ছিল এবং তা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। নাট্যকার ইউরিপিডিস তাঁর নাটকে দার্শনিকসুলভ সংলাপ রচনা এবং তার দ্বারা ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে একজন নমস্য ব্যক্তি। বাস্তবকে তিনি নতুন করে দার্শনিক বাস্তবতায় উপস্থাপন করেন তাঁর নাটকে। ফলে তাঁর নাটকে অভিনয় করাটা ততটা সহজ কাজ নয়।
কিন্তু নাটকের প্রধান চরিত্র মিডিয়া চরিত্রে যোগদানকারী তাহমীদা মাহমুদ এ ব্যাপারে সফল। নাটকের আখ্যানটি তাঁর অভিনয়ের ভিতর দিয়ে যথাযথভাবে ফুটে উঠেছিল। ফলে মুগ্ধ হয়ে নাটকটি দেখছিলাম। পাশাপাশি অন্য চরিত্রগুলোও ভালোই করেছেন। তাহমীদা সেখানে অবশ্যই ব্যতিক্রম। মেডিয়া বিশাল মাপের একটি চরিত্র, নাটকটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়েই। খুব সফলতার সঙ্গে সেই চরিত্রে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন তাহমীদা মাহমুদ।
বিশ্বের ইতিহাসে `মেডিয়া` নারীর বিদ্রোহের উপর প্রথম নাটক। নারীর বিদ্রোহের দ্বিতীয় আলোচিত নাটক ইবসেনের ‘ডলস হাউস’। মেডিয়া নাটকে মেডিয়া তার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিন্তু মেডিয়ার এই বিদ্রোহের ভিতর দিয়ে নাট্যকার আড়াই হাজার বছর আগের নারীর সঙ্কটগুলোকে সামনে আনেন। মূল ঘটনার চেয়ে নাট্যকারের দার্শনিক প্রশ্নগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নাটকের গল্পটা এমন কিছু নয় যা প্রতিদিন মানুষের জীবনে ঘটে না। পুরুষের জীবনে দ্বিতীয় ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। প্রাচীন যুগে সেটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। কিন্তু সেই রকম ঘটনাকে নাট্যকার নতুন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করলেন। তিনি সেই যুগের নারীকে দেখলেন ভিন্ন চোখ দিয়ে সামান্য পক্ষপাতিত্ব না করে। বিয়ের চেয়ে নারী পুরুষের প্রেম বা মেডিয়ার জেসনের প্রতি প্রেম প্রধান হয়ে উঠলো। জেসন কার্যসূত্রে ফোলশিয়ার উপকূলে জাহাজ নিয়ে উপস্থিত হলে মেডিয়া তার প্রেমে অন্ধ হয়ে পিতার দেশ ছেড়ে আওলকসে পালিয়ে আসে। সেখানে তার দুই পুত্র জন্ম নেয়। কিন্তু আওলকসে পেলিয়াসের কন্যাকে দিয়ে পিতাকে হত্যা করিয়ে সন্তান স্বামী সহ করিন্থে এসে নতুন করে আশ্রয় নেয়। সন্দেহ নেই জেসান তার স্ত্রীকে ভালোবাসতো।
কিন্তু মানুষের জীবনে ভালোবাসার চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো প্রতিষ্ঠা লাভ। প্রতিষ্ঠা লাভের মধ্য দিয়ে নিজের সন্তানের ভাগ্য ফেরানোর চাহিদা থাকে সব পিতার অন্তরে। বিদেশী রাষ্ট্র করিন্থে এসে জেসন নিজের প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সেখানকার রাজার কন্যাকে বিবাহ করে। কিন্তু বিবাহের আগে এ কথা তার প্রথম স্ত্রী মেডিয়াকে সে জানায় না। মেডিয়া এ বিয়ের খবর জেনে খুব স্বাভাবিকভাবেই এটাকে তার গভীর প্রেমের প্রতি স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে ধরে নেয়। মেডিয়া নাটকের যবনিকা উত্তোলন বা শুরু এখান থেকেই। স্বামী জেসনের এ বিবাহ মেডিয়াকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে এবং প্রতিশোধ গ্রহণের এই স্পৃহা তাকে কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যায়, এটাই এ নাটকের মূল প্রতিপাদ্য।
নাট্যকার অবশ্য নাটকের গোড়াতেই গোটা কয়েক সংলাপে দর্শকদের জানিয়ে রাখেন, `বিপুল ধনসম্পদ বা ঐশ্বর্য-প্রাচুর্যের মধ্যে বসবাস করতে করতে রাজপুত্র এবং রাজকন্যাদের মেজাজ বড় অদ্ভুত হয়। কখনো তারা আদেশ মেনে চলে না, শুধু হুকুম করে সকলকে। ধন ঐশ্বর্য আর উগ্র মেজাজ মানুষের জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারে না। উগ্রমনা ধনীদের সংসারে দুর্ভাগ্য একবার প্রবেশ করলে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই ডেকে আনে।` নাটকের গল্প বা আখ্যানে সেটাই লক্ষ্য করা যাবে। কিন্তু নাটকের নানা সংলাপের ভিতর দিয়ে নাট্যকার গভীর সব প্রসঙ্গের অবতারণা করবেন। ধাত্রী যেমন মূল নাটকের সংলাপে বলছে, `প্রাচীনকালের লোকগুলোকে যদি তুমি অশিক্ষিত মার্জিত বলে গাল দাও কিছু ভুল করবে না তুমি। কারণ তারা যেসব স্তোত্র গান রচনা করেছে তা শুধু আনন্দোৎসবগুলিকে অলঙ্কৃত করার জন্য, মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়কে তৃপ্ত করার জন্য। কিন্তু যে ঘৃণ্য দুঃখ হতে কত নরহত্যার উৎপত্তি হয়, কত সুখী পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় সেই দুঃখের উপসম ঘটাতে কোন স্তোত্র বা কোন চারণকবি রচিত সঙ্গীত সৃষ্টি হয়নি। সঙ্গীতের দ্বারা মানুষের মনের ক্ষত সারিয়ে তোলা গেলে কত ভালো হতো সমগ্র মানবসমাজের। যদি তা না হয়ে থাকে তবে কেন শুধু ধনীদের ভোজসভাগুলির গৌরব বৃদ্ধির জন্য কতকগুলি অলস অর্থহীন সঙ্গীত পরিবেশিত হয়?` মেডিয়া, জেসন, ক্রেয়ন বা এজেউসের নানা সংলাপের ভিতর দিয়ে মানুষের চরিত্রের নানা বিশ্লেষণ চলবে পুরো নাটক জুড়ে। নাটকে এই যে সংলাপের পর সংলাপ গেঁথে মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ এটাই খুব উপভোগ্য মেডিয়া নাটকে। ঢাকা থিয়েটারের মেডিয়া প্রযোজনায় নির্দেশক হুমায়ুন কবীর হিমুর সাফল্য এই যে, তিনি নাটকের অভিনেতা অভিনেত্রীদের দ্বারা নাটকের সংলাপগুলি দর্শকদের কানে অর্থপূর্ণ রস সৃষ্টি করে প্রক্ষেপণ করতে পেরেছেন। নাটকের মূল দার্শনিক জিজ্ঞাসার পাশাপাশি নাটকের অনুভূতির জায়গাগুলি স্পর্শ করতে ব্যর্থ হননি।
নাটকে যা খুব দ্রুত সাবলীলভাবে ঘটে যায়, স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের খবর মেডিয়াকে প্রথম হতাশ করে সে আর বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পায় না। কিছু পরে সে হতাশা কাটিয়ে স্বামী জেসন, জেসনের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং রাজা ক্রেয়নকে অভিশাপ দেয়। কিন্তু সবশেষে সে প্রতিশোধ নেয়ার কথা ভাবে। ঘটনার পিঠে নতুন নতুন সব ঘটনা তৈরি হয়, সকলের পক্ষেই সেখানে যুক্তি আছে। নাট্যকার হিসেবে ইউরিপিসের পারদর্শিতা হলো, নাটকের আখ্যানের উপরে চরিত্রদের সংলাপের প্রাধান্য সৃষ্টি করেন তিনি। যখন নাট্যকার যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে নাটকের গল্পে ভিন্ন মাত্রা সৃষ্টি করেন তা ক্রমাগত উপভোগ্য হতে থাকে। প্রতিদিনের চেনা গল্প, বিশ্বে লক্ষ লক্ষবার ঘটে যাওয়া ঘটনা নতুন করে দর্শককে ভাবতে বাধ্য করে। যখন ভয়াবহ জিঘাংসা মেডিয়ার মনে জেগে ওঠে, ধাত্রী চরিত্রটি তখন বলছে, `তুচ্ছ কারণে নিশ্চয় আমাদের কর্ত্রী এতদূর ব্যথিত হননি।` কিন্তু কোরাস তখন স্মরণ করিয়ে দেয়, কিন্তু ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যেন তিনি আবার একটা অন্যায় না করে বসেন। কারণ কোরাস দল মনে করে: `কালের বিশাল ইতিহাসের মাঝে নারী ও পুরুষদের নিয়ে কতরকম ঘটনাই ঘটে থাকে।` কারণ সমাজে নারী ও পুরুষ আছে, কিন্তু তাদের নিয়ে নানারকম ঘটনা থাকবে না তাতো হতে পারে না। সেখানে পুরুষ শুধু নারীকে ছেড়ে চলে যায়নি, নারীও কতবার পুরুষকে ত্যাগ করেছে। হেলেন অব ট্রয় তার বড় উদাহরণ। সম্প্রতি অনুস্বর অভিনীত `হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা`। ক্লিওপেট্রা এক বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে প্রেমিক হার্মাসিসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটে আলোচ্য মেডিয়া নাটকে।
নাট্যকার ইউরোপেডিস মেডিয়া নাটকে স্বীকার করে নেন, মেডিয়ার প্রেমের প্রতি জেসন বিশ্বস্ত না থাকার কারণে মেডিয়ার ক্রোধ প্রকাশ করা যুক্তিসঙ্গত কারণ জেসনের আচরণে মেডিয়া খুব কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু সেই ক্রোধ কতটা প্রকাশ করা ন্যায়সঙ্গত হবে সেই প্রশ্নও নাট্যকার তুলেছেন। নাট্যকার মেডিয়ার মুখে এইরকম সংলাপ বসিয়ে দিয়েছেন যে, `ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টিশক্তি বা বিচার বুদ্ধি খুব কম লোকেরই আছে।` চিরচেনা নারীর দুর্ভাগ্য মেডিয়ার সংলাপে ধরা পড়ে। মেডিয়া বলে, `প্রতিটি নারীকেই অনেক মূল্যের বিনিময়ে একজন মানুষকে স্বামী হিসেবে কিনে নিতে হয়। পরে সেই স্বামী প্রেমিক হতে গিয়ে হয়ে দাঁড়ায় অত্যাচারী। সেই নারীর কাছে তখন তার স্বামী হয়ে ওঠে দুঃসহ ঘৃণ্য। কারণ স্বামী খারাপ হলেও বিবাহ বিচ্ছেদ নারীর পক্ষে সম্মানজনক নয়। বিবাহের পর নারীরা নতুন পরিবেশে এসে তার জীবনের অংশীদারকে সব বিষয়ে খুশি করার চেষ্টা করে। পিতৃগৃহে যেই ধরনের জীবনযাত্রার সঙ্গে সে অভ্যস্ত ছিল না। পুরুষের একটা সুবিধা আছে, তারা ঘরে শান্তি না পেলে সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে সুন্দর সময় কাটাতে পারে। কিন্তু আমরা স্বামী ছাড়া আর কোনো বন্ধু বা বান্ধবী পেয়ে খুশি হই না। পুরুষরা বলে, ঘরের বাইরে তারা যুদ্ধ প্রভৃতি কতো বিপজ্জনক কর্মে ব্যাপৃত থাকে। কিন্তু তাদের এ যুক্তি দুঃখজনক। কারণ আমি নিজে একবার প্রসববেদনা ভোগ করার চেয়ে তিনবার যুদ্ধে যেতে রাজি আছি।` স্মরণ রাখতে হবে আড়াই হাজার বছর আগের সংলাপ এগুলো।
নাটকে রাজা ক্রেয়ন যখন মেডিয়ার পক্ষ না নিয়ে নিজের মেয়ে-জামাতা জেসনের পক্ষ নিয়ে মেডিয়াকে করিন্থ থেকে নির্বাসন দেয়, স্বাভাবিকভাবেই মেডিয়া সেটাকে অবিচার মনে করে। কিন্তু রাজা ক্রেয়নের পক্ষেও যুক্তি আছে, মেডিয়া ইতিপূর্বেই প্রতিশোধ গ্রহণের কথা বলেছে। ক্রেয়ন পিতা হয়ে নিজের কন্যার ক্ষতি চাইতে পারে না। ক্রেয়ন স্পষ্ট করেই মেডিয়াকে বলে, `তোমাকে আমি ভয় পাই, কারণ তুমি না আবার আমার কন্যার ক্ষতি করে বসো।`ক্রেয়ন মেডিয়াকে একথাও বলে: যদি তোমাকে নির্বাসন দেয়াটা অন্যায় হয়, তাহলেও আমার সন্তানের চেয়ে তোমাকে বেশি আমি বেশি ভালোবাসতে পারব না। কারণ আমি সবচেয়ে ভালোবাসি আমার পরিবারকে, তারপর করিন্থকে। ক্রেয়ন মেডিয়াকে বলে, স্বভাবে তুমি যাদুকরী, মানে কথার জাল বুনতে পারো। মেডিয়া তখন উত্তরে বলে, `শুধু এইবারই প্রথম নয়, আমার যশই আমার ক্ষতি সাধন করেছে। সুতরাং যারা বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ তারা যেন নিজের সন্তানকে বেশি শিক্ষিত না করেন। কারণ, যদি কেউ বোকাদের মাঝে নতুন বিদ্যা বা জ্ঞানের আমদানি করে তাহলে লোকে বলবে ওটা অনাবশ্যক। যদি কেউ জ্ঞানে যশে সকলকে ছাড়িয়ে যায়, সে তাদের বিতৃষ্ণার কারণ হয়ে উঠবে। কেউ কেউ সেইজন্য আমাকে চতুর বলে মনে করে।` যাই হোক, কথার জালে ক্রেয়নকে ভুলিয়ে মেডিয়া নির্বাসন দণ্ড একদিন পেছাতে সক্ষম হয়। ক্রেয়ন অবশ্য বলে: যদিও আমি বুঝছি আমি ভুল করছি তবুও তোমাকে একটা দিন থাকার অনুমতি দিলাম। নিশ্চয় তুমি এই একটা দিনের মধ্যে কোন ভয়াবহ কাজ করতে পারবে না।
কিন্তু এই একটা দিনে যা ঘটবার সেই ট্র্যাজেডি ঘটে যায় নাটকে। মেডিয়া নিজেই বলে: রাজা আমাকে আজই নির্বাসিত না করে থাকতে দিয়ে নির্বোধের মতো কাজ করেছেন। আমি আজকের মধ্যে ওদের তিনজনকে-পিতা, তার কন্যা আর তার স্বামীকে মৃত্যু পুরীতে পাঠাবো। কারণ প্রতিহিংসার নারী আমার হৃদয় সিংহাসনে বসে আছে। কিন্তু জেসন তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, `কতবার বলেছি বদ মেজাজ মহামারীর মতোই ভয়ঙ্কর।` মেডিয়াকে যুক্তি দেখায় জেসন, দ্বিতীয় বিয়েটা তার মেডিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা নয়। নিজের প্রতিষ্ঠার কারণেই রাজকন্যাকে বিয়ে করা, যাতে মেডিয়া সহ তার সন্তানরা ভালো থাকে। জেসন বলে: এবার বল, আমি কি ভুল করেছি? তোমরা নারীরা দাম্পত্যজীবন ও প্রেম যতদিন সুন্দর ও সাবলীল গতিতে চলে ততদিন বেশ থাক। কিন্তু সে গতি কোনোদিন ব্যাহত হলেই তোমরা উন্মত্ত হয়ে ওঠো। তখন একদিন যার সব ভালো ছিল তার সব কিছুই মন্দ হয়ে দেখা দেয়। তখন মিত্র হয়ে ওঠে তোমাদের চরম শত্রু। হায়! যদি পুরুষের নারী ছাড়া সন্তান উৎপাদনের ভিন্ন কোনো উপায় থাকতো!
নাটকটাতে দেখা যাবে নাট্যকার মেডিয়ার সংলাপের মধ্য দিয়েও নারীর সমালোচনা তুলে ধরেন। নারী চাইলে যে ভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে মেডিয়া তা প্রমাণ করতে চায়। মেডিয়া বলে, নারীর স্বভাবে যা কিছু খারাপ, তা ঘটেছে পুরুষদের কারণেই। যদি জেসন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করতো তাহলে কোনো রকম আক্রমণ হতো না মেডিয়ার দিক থেকে। জেসনকে সরাসরি মেডিয়া বলে, `জেসন যদি তুমি আমাকে জানিয়ে এই বিয়ে করতে আমি স্বেচ্ছায় সম্মতি দিতাম। কিন্তু তুমি তা করোনি।` জেসন বলে, `মেডিয়া যদি তুমি ক্রোধ ত্যাগ করতে পারো তোমরাই লাভ হবে।` জেসন নির্বাসিত মেডিয়া এবং তার সন্তানদের আন্তরিকতার সঙ্গে আর্থিক এবং অন্যান্যভাবে সাহায্য করতে চায়। মেডিয়া তা প্রত্যাখ্যান করে। তখন কোরাস ব্যাখ্যা দেয়: সব প্রেম সংযত হওয়া দরকার। বাড়াবাড়ি ভালো নয়, মধ্যপন্থা ভালো। কোরাস বলে: `প্রেম যদি আতিশয্যের স্রোতে ভাসতে ভাসতে সীমা ছাড়িয়ে যায় কারো জীবনে তাহলে সে প্রেম কখনো কোন গৌরব দান করতে পারে না। কিন্তু যদি মধ্যপন্থা অবলম্বন করা যায় তাহলে সে প্রেম মধুর হয়ে ওঠে।`
প্রথম কোরাস দলের কথার জবাবে দ্বিতীয় কোরাস দল তখন বলছে, `সতীত্ব স্বর্গের দান। সেই সতীত্বসম্পন্ন কোনো নারীকে যেন আমি স্ত্রী হিসেবে লাভ করি। দেবী সাইপ্রিস যেন কখনো আমাকে অহেতুক কলহ বিবাদ বা অশান্ত ইর্ষায় জড়িত না করেন। তিনি যেন কখনো অবৈধ প্রেমের কামনার দ্বারা আমায় উন্মত্ত না করে তোলেন। পরস্পরের স্বাধীন নির্বাচনের উপর প্রতিষ্ঠিত এক শান্তিপূর্ণ দাম্পত্যজীবন যেন দেবী আমাকে দান করেন।` কিন্তু দ্বিতীয় কোরাস যা বলছে, নাট্যকার বুঝিয়ে দিচ্ছেন তা মানুষের আকাঙ্ক্ষা হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। মানুষের চাওয়া পাওয়া ভালোলাগা কোনো দেবীই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।
কিন্তু প্রতিশোধ শেয়ার জন্য মেডিয়া তখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মেডিয়া বলে: কেউ যেন আমাকে অবলা দুর্বল নারী না ভাবে। বিপদের সময় আমি গালে হাত দিয়ে বসে বসে ভাবি না। আমি আমার শত্রুদের ভয়ঙ্কর শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু ক্রোধের স্বভাব এমন, নিজের তার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। মেডিয়া যুক্তি দিয়ে প্রথমে যা ঠিক করেছিল, সেই যুক্তি হারিয়ে যায়। ক্রমাগত তার ক্রোধ বল্গাহীন হয়ে পড়ে, সবকিছু ধ্বংস করার উন্মাদনায় পেয়ে বসে তাকে। তখন সে আর জেসনকে হত্যা করতে চায় না। বরং জেসনকে বাঁচিয়ে রেখে নিজের দুই পুত্রকে হত্যা করতে চায়। কারণ পুত্রদের রক্ত এবং হত্যা দেখে জেসন যেন সারাজীবন কষ্ট বা যন্ত্রণা ভোগ করে। মেডিয়া জানে, এই হত্যা মা হিসেবে তাকেও কষ্ট দেবে, কিন্তু জেসনকে কষ্ট পেতে দেখে মেডিয়া খুশি হবে। মেডিয়ার অশান্ত মন শান্ত হবে। সন্তানের প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেই জেসন একদিন মেডিয়াকে ত্যাগ করেছিল। চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল মেডিয়ার সঙ্গে। পুরুষেরা নারীর মাতৃত্বকে একমাত্র সত্তা হিসেবে দেখতে চায়, নারীর আর সব গুণকে অবহেলা করে। শুধু মাতৃত্ব নারীর পরিচয় হতে পারে না। নারী আরো বেশি কিছু। জেসন সেটা বুঝতে পারুক। সবাই মেডিয়াকে দেখে সেটা শিখুক। মেডিয়া সে কারণে নিজের সন্তানকে হত্যার কষ্ট মেনে নেবে।
সর্বগ্রাসী এক ক্রোধের বশে মেডিয়া, নারী হিসেবে নিজের আর এক সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় নিজের হাতে নিজের সন্তানকে হত্যা করে। মায়ের হাতে সন্তান খুনের এ নাটক নানা রকম বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল একদা। হুমায়ুন কবীর হিমু সাহস করে সেই নাটকটি মঞ্চে এনেছেন নির্দেশক হিসেবে। নাটকটি দর্শকদের খুব ভালো লাগবে বলে আমার বিশ্বাস। নাটকটির প্রযোজনা অধিকর্তা ছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। অভিনয়ে: তাহমীদা মাহমুদ, ফাহমিদা কামাল, মিলুর চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান শুভ, সাইফুদ্দীন আহমদ দুলাল, উম্মে সালমান অদৃতা, রেদোয়ান, ওয়ান রিফাত, কাজী আব্দুল গনি।