ডেঙ্গুর ভ্যাক্সিন

তৌফিক জোয়ার্দার

প্রকাশিত : আগস্ট ০৬, ২০১৯

এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। এ নিয়ে প্রচুর কথা হচ্ছে। রোগটা নিয়ে মানুষের মাঝে ব্যাপক আগ্রহও জন্ম নিয়েছে। ডেঙ্গু হলো ভেক্টর বর্ন ডিজিজ। অর্থাৎ, এ রোগের ভাইরাস সরাসরি এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের শরীরে যায় না। এ ভাইরাস যে মানুষের শরীরে আছে, তাকে এডিস প্রজাতির মশা কামড়ালে তা আক্রান্ত মানুষের রক্তের মাধ্যমে এডিস মশার শরীরে ঢোকে। পরবর্তীতে সেই মশা অন্য কোনো মানুষকে কামড়ালে তা মশার শরীর থেকে অন্য একজন মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। তবে ডেঙ্গু ভাইরাস আছে এমন মশা মানুষকে কামড় দিলেই যে মানুষটার ডেঙ্গু রোগ হবে এমন কোনো কথা নেই। মশাটা গড়ে চারজন মানুষকে কামড়ালে এরমধ্যে মাত্র একজন মানুষের ডেঙ্গু হবার সম্ভাবনা থাকে। এদের মধ্যে যে সবাই মারা যাবে, তাও নয়। সারা পৃথিবীতে গড়ে প্রতি বছর ৩৯০ মিলিয়ন বা ৩৯ কোটি মানুষের শরীরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ হয়, এদের মধ্যে ৯৬ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষের শরীরে ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ প্রকাশ পায়। এদের মধ্যে মারা যায় মাত্র ২০,০০০ মানুষ।

ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা, প্রতিরোধ, প্রতিকার নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে, এর কিছু বিজ্ঞানসম্মত আবার কিছু কল্পনাপ্রসূত। আমি সেই আলোচনায় যাব না, আমি বরং ডেঙ্গু ভ্যাক্সিন নিয়ে এমন একটা ঘটনা বলবো যা গ্লোবাল হেলথ ফিল্ডে ফেইলিউর বা ব্যর্থতার একটা টেক্সটবুক কেইস হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, ডেঙ্গুর মতো ভেক্টর বা মশাবাহিত রোগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য এবং নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব। সেক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন হতে পারে এ রোগের অন্যতম সমাধানসূত্র। কিন্তু ডেঙ্গু রোগের একটা অদ্ভুত পিকিউলিয়ারিটি আছে, যা যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানীদেরকে হতবুদ্ধি করে এসেছে, এবং ডেঙ্গুর টিকা তৈরির প্রয়াসকে করেছে সুদূর পরাহত। সেই কাহিনিই বলছি।

বেশিরভাগ সংক্রামক ব্যাধিরই একটা কমন বৈশিষ্ট্য আছে, রোগটার একবার সংক্রমণ ঘটলে পরের বার রোগটা হয় আর হয়ই না, আর হলেও তা হয় আগের বারের চেয়ে মাইল্ড বা নিরীহ প্রকৃতির। যেমন, আমরা অনেকেই জানি, চিকেন পক্স কারো একবার হয়ে গেলে সেটা আর সাধারণত দ্বিতীয়বার তার হয় না। মিজেলস বা হাম একবার হলে, পরের বার তার আক্রমণ হলেও খুব একটা ভোগায় না। কিন্তু ডেঙ্গু হলো অদ্ভুত এক ব্যতিক্রম। এটা প্রথমবার হলে, দ্বিতীয়বার তা ফিরে আসে আরো প্রলয়ঙ্করী রূপ নিয়ে। এই দ্বিতীয় আক্রমণটা এমনকি প্রাণসংহারীও হতে পারে। প্রথমবারের আক্রমণটা সেই তুলনায় এতটাই মাইল্ড হতে পারে যে, অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তি জানতেই পারেন না যে তার আদৌ ডেঙ্গু হয়েছে, বা অনেক সময় সাধারণ ভাইরাল ফিভার হিসেবে এটাকে উপেক্ষা করে যান। কারও এর আগে ডেঙ্গু হয়েছিল কিনা এটা তাই রোগী নিজেও অনেক সময় বলতে পারে না, তবে তা ইমিউনোলজিকাল টেস্টের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। এ ধরণের রোগীদের রক্তে IgG (ইমিউনোগ্লোবিউলিন জি) বেশি থাকে এবং IgM (ইমিউনোগ্লোবিউলিন এম) কম থাকে বা থাকেই না।

যাই হোক, ২০১৫ সালে সানোফি নামের একটা অষুধ কোম্পানি ডেঙভ্যাক্সিয়া নামে প্রথম ডেঙ্গুর ভ্যাক্সিন বাজারজাত করে। ফিলিপাইনের ম্যানিলা হচ্ছে বিশ্বের ডেঙ্গু প্রবণ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ফিলিপাইনের সরকার অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই ভ্যাক্সিনটা জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের সাথে বিশদ আলোচনা না করেই সর্বজনীন টিকাদান কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এর পরই ঘটে মজার ঘটনাটা (ভুক্তভোগীদের জন্য মজার না অবশ্যই; আমাদের মতো পাবলিক হেলথ প্রফেশনালদের জন্য ইন্টারেস্টিং, যেমন মেডিকেল স্টুডেন্ট বা ইন্টার্ন ডাক্তারদের জন্য ব্যতিক্রমী কেইসগুলো ইন্টারেস্টিং)। আপনারা অনেকেই টিকার মূলসূত্রটা জানেন। যে রোগের টিকা দেয়া হয়, টিকাটা আসলে ওই রোগটারই মাইল্ড সংক্রমণ সৃষ্টি করে মানব শরীরে। অর্থাৎ, টিকা হলো অনেকটা ‘বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে’ বলে শরীরকে এক রকম ধোঁকা দেয়া। তবে মিথ্যেবাদী রাখাল বালকের গল্পে রাখাল বালক বারবার বাঁচাতে যাওয়া মানুষকে ধোঁকা দেয়, আর টিকার ক্ষেত্রে একবারই ধোঁকাটা দেয়া হয়, যাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধী রক্তসেনানিরা রাখাল বালকের সম্ভাব্য বিপদের স্থান ও প্রকৃতিটা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে ফিরে যায়।

পরবর্তীতে সত্যিই রোগের সংক্রমণ ঘটলে, সেই বীর সেনানিরা ঠিক ঠিক রোগ জীবাণুদেরকে কুপোকাত করে ফেলে (বারবার ভ্যাক্সিন দিয়ে শরীরকে রাখাল বালকের মতো বারবার ধোঁকা দিলে কী পরিণতি হতে পারে তা অবশ্য আমার জানা নেই, এবং মনে হয় সেটা না জানলেও আপাতত চলবে)। দেখা যাক ডেঙ্গু ভ্যাক্সিন ডেঙভ্যাক্সিয়ার ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল। এই ভ্যাক্সিনটা যখন দেয়া হলো, শরীর সেই ভ্যাক্সিনের কণাগুলোকেই প্রথমবারের মৃদু সংক্রমণ হিসেবে ধরে নিল (আগেই বলেছি, ডেঙ্গু হলো সেই বিভ্রান্তিকর ব্যতিক্রম, যেখানে প্রথমবারের সংক্রমণটা এতটাই মাইল্ড হয় যে অনেক সময় তা অসুখ বলেই প্রতীয়মান হয় না)। এর পরের বছর যখন সত্যি সত্যিই ভ্যাক্সিনেটেড বাচ্চাগুলোকে ডেঙ্গু আক্রমণ করলো, তখন শরীরে এর প্রতিক্রিয়া হলো দ্বিতীয় আক্রমণের মতো, যা অত্যন্ত তীব্র এবং প্রায়শঃই প্রাণসংহারী। দ্বিতীয় সংক্রমণের তীব্রতার এই ফেনোমেনাকে বিজ্ঞানীরা বলেন antibody-dependent enhancement বা সংক্ষেপে ADE । এই ADE’র ভয়াবহতায়, সরকারের মূঢ় সিদ্ধান্তের বলি হয়ে প্রাণ দিলো অনেক নিরপরাধ ফিলিপিনো শিশু। মনে হতে পারে, এখানেই গল্পের করুণ পরিসমাপ্তি, কিন্তু না। পিকচার আভি বাকি হ্যায়।

সরকার পরের বছর ডেঙভ্যাক্সিয়া ভ্যাক্সিনটা জাতীয় টিকা কর্মসূচি থেকে প্রত্যাহার করে নিল। কিন্তু মানুষের মনে টিকার ব্যাপারে যে অনাস্থা সৃষ্টি হলো, তা কেবল ডেঙভ্যাক্সিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকল না। তাদের অনেকেই কোনো রকম টিকা নিতেই অস্বীকৃতি জানালো। অনেকে টিকা কর্মীদের হাত থেকে নানা উপায়ে পালিয়ে বাঁচলো। পরিণামে যা হলো, তা হলো পরের বছর মিজেলস বা হাম মহামারি আকারে দেখা দিল, যে রোগটা সেখানে বহুবছর আগেই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। হামের সংক্রমণে এবার মারা গেল ডেঙ্গুর চেয়েও বেশি শিশু (ডেঙ্গুর ADE-তে মরা গিয়েছিল ৩৫-৪০ জন শিশু, আর হামে মারা গিয়েছিল ১৩০ জন)।

এরপরও এটা নিয়ে আরো অনেক নাটক হয়েছে, যেমন সরকার ডেঙভ্যাক্সিয়াকে রিইন্ট্রোডিউস করার চেষ্টা করেছে আরেকটু বেশি বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে (৯ বছরের বেশি বয়সী), WHO এবং সানোফি কোম্পানি তাদের নতুন নির্দেশনায় বলেছে, ভ্যাক্সিনটা কেবল আগে একবার ডেঙ্গু হয়ে গিয়েছে এমন শিশুদের মধ্যেই প্রয়োগ করা যাবে, কিন্তু আগে ডেঙ্গু হয়েছে এমনটা নিশ্চিত করাও খুব সহজসাধ্য নয়, এদিকে সরকারের বিরুদ্ধে ভু্ক্তভোগী পরিবারগুলো হত্যামামলা করেছে— সব মিলিয়ে ব্যাপারটা একটা কমপ্লিট মেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আমাদের মতো জনস্বাস্থ্য প্রফেশনালদের জন্য এটা হয়েছে একটা শিক্ষণীয় কেস স্টাডি।