ডেঙ্গু: শ্রেণি-শোষণেরই নামান্তর
শাহেরীন আরাফাতপ্রকাশিত : আগস্ট ০১, ২০১৯
ডেঙ্গু এখন কোনো মৌসুমী রোগ নয়। সরকারি কর্মকর্তাদের ভাষ্যেই এটা স্পষ্ট যে, এখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মহামারির রূপ নিচ্ছে। অথচ সিটি করপোরেশনকে মার্চেই এ বিষয়ে অবগত করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও এ নিষয়ে অজ্ঞ ছিল না নিশ্চয়ই। অথচ রাষ্ট্রের প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিল নির্লিপ্ত। কেরোসিনের গন্ধঅলা সিটি করপোরেশনের মশা মারার ওষুধে কাজ হয় না বলে মেয়রদ্বয় জানিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, আগে কি ওই ওষুধে কাজ হতো, আগে কি ওষুধ ছিটানো হতো? এমনকি ওই ওষুধের নামটুকুও কি দায়িত্বশীলদের জানা আছে?
প্রথমদিকে অবশ্য ক্ষমতাসীনদের প্রপাগাণ্ডা ছিল, ডেঙ্গু নাকি গুজব। গুজবের মাধ্যমে নাকি ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে! আমাদের মতো সাধারণদের জীবনের দাম না থাকলেও, তাদের কয়েকজন দায়িত্বশীল যখন আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন, তখন আর গুজবের প্রপাগাণ্ডা ধোপে টিকলো না! এখনো ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ে নাকি গুজব ছড়ানো হচ্ছে! অথচ চিকিৎসক ও রোগতত্ত্ববিদরা এজন্য দুই সিটি করপোরেশনকেই দায়ী করছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেছেন, “মার্চ থেকেই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু সম্পর্কে অবহিত ছিল।” অথচ ডেঙ্গু নাকি গুজব!
এদিকে সিটি করপোরেশনের দাবি, উত্তর মশা নাকি দক্ষিণে, আর দক্ষিণের মশা উত্তরে চলে আসে ওষুধ দিলে! এ দাবি আদালতের সামনে করা হয়! আবার বলা হয়, ওষুধ আনতে নাকি কয়েক মাস লাগবে! তারা কি ওষুধ বানিয়ে আনবে নাকি? জরুরি পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ দু’য়েক সপ্তাহের মধ্যে সেই ওষুধ আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এমনকি দেশব্যাপী এখন ওই অকার্যকর ওষুধ ছিটানো হলেও মশার উৎপত্তিস্থলগুলো ধ্বংস করতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ এখনো পর্যন্ত নেয়া হয়নি। লোকজনের বাড়িতে এডিস মশা জন্মানোর গালগপ্পো বহু পুরনো। এখন ভাবতে হবে, দেশব্যাপী এ ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা ছড়ালো কি করে! যে অব্যবস্থাপনায় লুটপাটতন্ত্র এ দেশে কায়েম রয়েছে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কার্যত তারই পরিণতি। ক্ষমতাসীনদের সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ!
এদিকে, খাদ্যে এন্টিবায়োটিক, ডিচারজেন্ট, শিসা নিয়ে কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে দেয়া হাইকোর্টের রুলও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সরকার বৃহৎ কোম্পানিগুলোর পক্ষে অবস্থান নিয়ে সব তথ্য-প্রমাণ অস্বীকার করেছে, দেশে নাকি দুধে এন্টিবায়োটিক উপস্থিতির পরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা নেই! অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদের যৌথ গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধে ডিটারজেন্ট, এন্টিবায়োটিক ও ফরমালিন, গুড়া মশলায় (হলুদ) টেক্সটাইল রঙের উপস্থিতি এবং তেল (পামওয়েল, সরিষা, সয়াবিন), ঘি ও ফ্রুট ড্রিংকস বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) নির্ধারিত মান উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক এবং বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক এ গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। আর এজন্য পরবর্তীতে তাকে বিভিন্নভাবে অপদস্ত করা হয়। বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে ক্ষমতাসীন মন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে নাকি খাদ্য পরীক্ষা করার মানসম্পন্ন কোনো পরীক্ষাগারই নেই! সরকার কেন জনগণের পক্ষ না নিয়ে কোম্পানির পক্ষ নিলো! এ থেকেও বোঝা সম্ভব, ক্ষমতাসীনরা কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে।
খাদ্যে ভেজাল বা ডেঙ্গুও শ্রেণি-শোষণেরই নামান্তর! ক্ষমতাসীনরা ডেঙ্গু থেকে পালিয়ে বিদেশে থাকতে পারে, তারা বিদেশি দুধ, মশলা, তেল খেতে পারে। অপরদিকে এক বসবাস অযোগ্য সমাজে আমাদের মতো সাধারণেরা ভেজাল পণ্য আর ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে বাধ্য হচ্ছি! এ অবস্থা যেমন একদিনে তৈরি হয়নি, এ থেকে পরিত্রাণের পথও সোজাসাপ্টা নয়।
তারা প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছে, কথিত উন্নয়নের গণতন্ত্র কায়েমের। যে অট্টালিকা ও অবকাঠামো নির্মাণকে উন্নয়ন বলে গলাবাজি করা হচ্ছে, সেখানে সাধারণের জীবনমান কতটুকু বাড়লো, এ সম্পর্কে নতুন করে ভাববার, প্রশ্ন করার এখনই সময়। যে উন্নয়নে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়, যে উন্নয়নে খাদ্যে মিশে থাকে বিষ, সে উন্নয়নে আর যা-ই হোক, মানুষ থাকে না। তাতে এমনকি আজ গণতন্ত্রের লেবাসটুকুও থাকে না! তীব্র শ্রেণি-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সম্ভব ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়ন। এর আগপর্যন্ত যত সংস্কার, তা শুধু ফ্যাসিবাদী শোষকের কলুষতা ঢেকে রাখার। অথচ এখন এ সংস্কার গ্রহণেও অপারগ ফ্যাসিবাদের মহীরুহ। এ সংস্কার চেষ্টা তাকে আরও নগ্ন করে তুলছে ও তুলবে। কারণ, এখন আর রাখঢাকের দোহাই নেই ফ্যাসিবাদ উন্নয়ন প্রকল্পের।