ড. মেহমেদ গরমেজ

ড. মেহমেদ গরমেজ

ড. মেহমেদ গরমেজের প্রবন্ধ ‘ইসলামি চিন্তা কী’

অনুবাদ: বুরহান উদ্দিন

প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০২২

যেসব পরিভাষা ইসলামি জ্ঞানের ধারা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তাফাক্কুর বা চিন্তা হলো সেগুলোর মধ্যে একটি। কোরআনের আয়াতগুলোকে নিয়ে গবেষণার ফলে, তাফসির, ফিকহ, ইলমূল কালামের মতো জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলো উদ্ভাবিত হয়েছে এবং অনুপম এক ইলমি (জ্ঞানগত) জগৎ গড়ে তুলেছে।

মহাগ্রন্থ আল কোরআনের আয়াতগুলো মহাবিশ্বকে নিয়ে চিন্তা করার জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কোরআনের এই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিমরা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান Natural Sciences নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা করে এবং এই সম্পর্কিত অনেক গ্রন্থ রচনা করে এই অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে তোলে।

মানুষের অভ্যন্তরীণ জগতে বাস্তবায়িত চিন্তা মনোবিজ্ঞান ও আখলাকের মতো বিভিন্ন জ্ঞানের পাশাপাশি আমাদের অন্তর্জগৎকে সমৃদ্ধকারী এক ইরফানের ধারা সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে চিন্তা সম্পর্কিত পরিভাষার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই, এই চিন্তার ধারা তায়াক্কুল التعقل, তাফাক্কুর التفكر, তাদাব্বুর التدبر, তাজাক্কুর التذكر, তায়াম্মুল التأمل, নাজার النظر, বাসার البصر ও ইতিবার الاعتبار এই সকল পরিভাষার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে।

তায়াক্কুল হলো, যেসব অংশ চিন্তা করে সেসব কিছুকে সবসময় চিন্তা করার দিকে ধাবমান রাখা এবং চিন্তাকে ইস্তিকামাতের উপর রাখার চেষ্টা করা। তায়াক্কুলের ফল হলো তাফাক্কুর। আর এর জন্য আলাদা কোনো সময় নেই। সর্বাবস্থায় সকল বিষয়ে চিন্তা করার নাম হলো তাফাক্কুর। জিকরা ও জাকির থেকে উদগত তাজাক্কুল হলো অতীত নিয়ে চিন্তা করা। দাবার বা তাদবির থেকে উদগত হতে উদগত তাদাব্বুর হলো আকিবাত। ফলাফল ও পরিনামের ব্যাপারে চিন্তা করা।

তায়াম্মুল শব্দটি উদগত হয়েছে أمل শব্দ থেকে। এর অর্থ ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা। নাজার হলো, আমরা যেটা দেখি বা অবলোকন করি সেটা নিয়ে চিন্তা করা। মহাবিশ্ব ও সৃষ্টিজগৎকে আকলের মাধ্যমে অবলোকন করা। বাসার হলো, আকল ও কালবের মধ্যে সমন্বয় সাধন বা এই দুইটিকে একে অপরের সাথে একীভূত করা। মহাবিশ্ব ও সৃষ্টিজগৎকে অন্তর দিয়ে দেখা। কথা ও চিন্তার মাধ্যমে আমরা অর্থ ও হাকিকতে পৌঁছাতে পারি আর তাফাক্কুর ইবরাতের এর মাধ্যমে ইতিবারে পৌঁছা যায়। ‘হে দৃষ্টিশক্তির অধিকারীরা, শিক্ষাগ্রহণ করো। সূরা হাশর: ২

আমরা যদি উসূলের কিতাবগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, ফকিহরা এই আয়তটিকে ইজতিহাদের দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর মুজতাহিদ হলেন তিনি, যিনি এই সকল চিন্তা পদ্ধতিকে একত্রিত করে দ্বীনকে সঠিকভাবে বুঝার জন্য আমাদের জন্য পদ্ধতি ও পন্থা উদ্ভাবন করেছেন।

বর্তমান যুগে ইসলামি চিন্তা ও বিশ্বাসকে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য, ইসলামি চিন্তার মূলধারা ও মূলনীতিগুলোকে এইসব পরিভাষার আলোকে নতুন করে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। একটি নব সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিংবা একটি সভ্যতাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্রথমে আমাদেরকে সিধান্ত নিতে হবে যে, আমরা এই ব্যাপারে কোন উৎসকে মূলভিত্তি হিসেবে নেব এবং এইসব উৎসের সাথে আমরা কেমন সম্পর্ক স্থাপন করব। এর সাথে সাথে অন্য যে কাজটি আমাদের করতে হবে তা হলো, এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো উসূল ও মেথডোলজি দাঁড় করাতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হলো, ইসলামি চিন্তার ইতিহাসের মূল বিষয়গুলো গঠনকারী মৌলিক বিষয় নির্ধারণ করতে হবে।

এইসব বিষয়কে নির্ধারণ করার সময় আংশিক নয়, সামগ্রিক একটি অধ্যয়ন গুরুত্বপূর্ণ। আংশিক অধ্যয়ন কখনোই সঠিক সমাধান বইয়ে আনতে পারে না। এজন্য সামগ্রিক অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই। কেননা ইসলামি চিন্তার ইতিহাস সামগ্রিকভাবে একে অপরের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত।

ইসলামি সভ্যতার ধারণাকে যদি আমরা সকলের মানসপটে অঙ্কন করে দিতে চাই তাহলে আমাদেরকে আমাদের অতীত চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে এবং আধুনিকায়ন করে মুসলিম উম্মাহর সামনে পেশ করতে হবে। এটা ছাড়া ইসলামি সভ্যতার রেনেসাঁর চিন্তা গড়ে ওঠা অসম্ভব। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ মুসলমানরা ইসলামি চিন্তার মৌলিক উৎসগুলোকে অধ্যয়ন করে না। শুধু তাই নয়, এই সকল বই অধ্যয়ন ও বুঝার ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতিগত সমস্যা বোধ করে থাকে। ইসলামি চিন্তার এই সকল মৌলিক গ্রন্থ অনেকেই সাধারণ বই ভেবে যেনতেনভাবে পাঠ করে থাকে। যার ফলে তারা এই সকল বইকে বুঝতে সক্ষম হয় না। আর না বুঝার ফলে এই সকল মৌলিক গ্রন্থকে গুরুত্বহীন মনে করে ফেলে রাখে।

অনেক সময় এমন হয়, এই সকল মৌলিক বইয়ে ব্যবহৃত পরিভাষাগুলো না বুঝার কারণে ওইসব বইকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারে না এবং সমৃদ্ধ ও আধুনিকায়ন করে তার রূহকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয় না। তবে একটি বিষয় এখানে খেয়াল রাখতে হবে, অতীতের ওইসব মৌলিক বইগুলো অধ্যয়ন করার সময় অতীতকে যেন পুনরাবৃত্তির জন্য না পড়ি, অতীতকে যেন সমালোচনার ঊর্ধ্বে মনে করে সেগুলোর অন্ধ অনুকরণ শুরু করে না দেই। এখানে একটি বিষয় আমাদেরকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে, অন্ধ অনুকরণ ও অনুসরণ করার মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যকে ভুলে গেলে চলবে না। অতীতে লেখা মৌলিক বইগুলোর মাধ্যমে অতীতের অন্ধ অনুকরণ নয়, বরং ওইসব মৌলিক উৎসগুলো চিন্তার ক্ষেত্রে যে প্রবাহমানতা ও গতিপথ দেখিয়ে গেছে, সেগুলোর অনুসরণ  করা।

যেসব বই-পুস্তক বর্তমানের সমস্যাকে সমাধান করে না, বর্তমানকে মূলভিত্তি হিসেবে নেয় না, বর্তমানকে বুঝতে সাহায্য করে না, সেসব বই পড়ার মধ্যে কোনো ফায়দা নেই। এজন্য আমরা যখন ইসলামি চিন্তার মৌলিক বইগুলো পড়ার কথা বলি তখন যেন কেউ এই কথা না বলে যে, আমরা বর্তমানকে বাদ দিয়ে অতীতে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের উচিত হলোল অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। বর্তমানকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে বর্তমানকে জন্মদানকারী গতকালকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। আবার আগামীকালকে বিনির্মাণ করতে হলে বর্তমানকে ভালোভাবে বুঝতে হবে।

ওরিয়েন্টালিস্টদের দ্বারা লিখিত সিস্টেম্যাটিক ইসলামি চিন্তার ইতিহাস এবং এই সকল লেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেড়ে ওঠা অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ, ইসলামের ছায়াতলে গড়ে ওঠা ভিন্ন মাযহাবের মধ্যকার ঐক্যমতপূর্ণ বিষয় চিহ্নিত করার ও সামনে আনার পরিবর্তে ভিন্নতা ও ইখলিলাফি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। ফলে ইসলামি চিন্তার যে এক বিশাল অভিজ্ঞতা রয়েছে এর মধ্যকার অভ্যন্তরীণ সামগ্রিকতা, সঙ্গতি ও প্রবাহমানতা থেকে তারা দূরে সরে গেছে। ভিন্ন ভিন্ন মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যে অধিকতর কম গুরত্ত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক তাদের মধ্যে দ্বন্দ সংঘাত সৃষ্টি করেছে।

পাশ্চাত্য দর্শনের থিওলজিক ধারার মধ্যে ক্যাটাগরিক্যাল পার্থক্যসমূহকে বিশ্বজনীন করে ফেলার ফলে, এই ক্যাটাগরিক্যাল পার্থক্য সমূহকে সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে ধরে নিয়ে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা হয় এবং সকলেই এগুলোকেই সত্য বলে ধরে নেয়। থিওলজি, ফিলোসফি এবং মিসটিসিজম (সুফিবাদ) এই গুলোকে ক্যাটাগরিক্যালি পার্থক্যকে ইসলামী চিন্তার ইতিহাসের উপর প্রয়োগ করলে আমরা দেখতে পাই যে, ইসলামি চিন্তা দর্শনে এগুলো কালাম, ফিলোসফি এবং তাসাউউফ (বায়ান, বুরহান ও ইরফান) এই নামে ছিল এবং এই চিন্তা পাশ্চাত্যের চিন্তা দর্শনের চেয়ে অনেক উচ্চে অবস্থিত। এই সকল উচ্চ চিন্তাগুলোর উপস্থিতিই মুসলমানদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

লেখক পরিচিতি: তুরস্কের প্রথিতযশা ইসলামি চিন্তাবিদ প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ মুফাক্কির ও উসূলবিদ। তিনি ইসলামি জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নতুন উসূল বিনির্মাণ করার বয়ানকে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন। ২০০৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি তুরস্কের রিলিজিয়ার্স অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামি জীবনদর্শনের বিভিন্ন দিকের ওপর এ পর্যন্ত তার দশটি বই এবং অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থটের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।