ড. তানভীর রাতুলের দার্শনিক গদ্য ‘প্রেমের সমসাময়িক তত্ত্ব’
প্রকাশিত : মে ২৭, ২০২২
ইরোস, অ্যাগাপে ও ফিলিয়ার মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে ওঠে যদি আবেগপ্রবণ কামনাময় প্রেম ও বন্ধুত্বময় প্রেম বিষয়ক সমসাময়িক তত্ত্বগুলির সাথে তুলনা করা হয়। কামনাময় প্রেমের কিছু আধুনিক তত্ত্ব এটাকে আগাপের মতোই প্রেমিক বা প্রেমিকার মধ্যে মূল্য সৃষ্টি করা হিসাবে বোঝে, এবং প্রেম কামনার অন্যান্য বিবরণ বা বিশ্লেষণগুলো যৌন কার্যকলাপকে নিছক এমন একটা প্রকাশ হিসাবে বিবেচনা করে যা অন্যথায় আসলে বন্ধুত্বের মতোই।
এখানে যেহেতু ব্যক্তিগত প্রেমের ওপরেই শুধু দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হবে, তাই মানুষের প্রতি ঈশ্বরের ভালবাসা বা স্রষ্টার জন্য মানুষের ভালোবাসার ধারণাগুলি বাদ দেওয়া হবে আর তাই ইরোস ও ফিলিয়ার মধ্যের পার্থক্যটা ঝাপসা হয়ে যাবে। যেমনটি সাধারণত সমসাময়িক দার্শনিক বিবরণগুলিতে দেখা যায়। এই লেখায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হবে আকাঙ্ক্ষার প্রেমসহ, এইসব সমসাময়িক প্রেমের বোঝাপড়া বা বিশ্লেষণগুলো ওপর। অন্য ব্যক্তির প্রতি মানুষ যে মনোভাব নিয়ে থাকে, তা বোঝানোর জন্য।
প্রেমের বর্ণনা দেওয়ার ক্ষেত্রে দার্শনিক বিশ্লেষণের সময় অবশ্যই যে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় তা হলো, ভালোবাসাকে অন্যান্য ইতিবাচক মনোভাব যা একজন মানুষ অন্য মানুষের প্রতি অনুভব করে, যেমন পছন্দ করা ইত্যাদি থেকে আলাদা করা। স্বজ্ঞাতভাবে বা মানুষের নিজের থেকেই জানে যে, ভালোবাসা তার গভীরতার পরিপ্রেক্ষিতে বা বিবেচনায় শুধু পছন্দ করার মতো মনোভাব থেকে আলাদা। আর সমস্যাটি হলো, মানুষ কোন ধরনের বা কতটা গভীরতায় স্বজ্ঞাতভাবে বা আপনা আপনিই ভালোবাসা খুঁজে পায় তা ব্যাখ্যা করা।
কিছু আধুনিক বিশ্লেষণ আংশিকভাবে এই কাজটা করে থাকে যা পছন্দের পরিমাণ সম্পর্কে খুবই ঝাপসা ধারণা দেয়। এইভাবে আধুনিক ধারণা পছন্দকেই আকাঙ্ক্ষার বিষয় হিসাবে বিবেচনা করে। কিন্তু পছন্দ আসলে এমন একটি মনোভাব বা আবেগ যা সর্বোচ্চভাবে লক্ষ্যবস্তুর সাথে জড়িত থাকে শুধুমাত্র যন্ত্রগত বা বস্তুবাদী মানদণ্ডে, অন্তর্নিহিত মূল্যায়নে নয়। তবুও ব্যাখ্যাটা অপর্যাপ্ত বলে মনে হয়। অবশ্যই মানুষের অন্যদের প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে যা একজন ব্যক্তির কোনো একটা বস্তুর প্রতি আকাঙ্ক্ষা এবং অন্য একজন ব্যক্তিকে ভালোবাসার মধ্যবর্তী কিছু একটা।
কেউ একজন নিজের স্বার্থেই অন্য একজনের যত্ন নিতে পারে এবং নিছক যন্ত্রানুযায়ী নয়, এবং তবুও এই ধরনের যত্ন সেই ব্যক্তিকে আকাঙ্ক্ষাময় ভালোবাসার সমান নাও হতে পারে। ঠিক যেমন মানুষ একইভাবে একটা কুকুরেরও যত্ন নিতে পারে। এটা এমন এক ধরনের যত্ন যা ভালোবাসা হয়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্তভাবে ব্যক্তিগত নয়। সাধারণত মানুষ ভালোবাসাকে ভালো লাগা থেকে আলাদা করে। স্বজ্ঞাতভাবে ভালোবাসার যে গভীরতায় নিজেকে শনাক্তকরণ করতে পারে বা খুঁজে পায়, সেই ধারণার মাধ্যমে কাউকে ভালোবাসা মানে তার সাথে নিজেকে চিনতে পারা বা একাত্মবোধ করা। কিন্তু ভালো লাগার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পরিচয়ের এমন কোনো ধারণা জড়িত নয়। একটি সম্ভাব্য প্রেম এবং অন্য আরেকটা সম্ভাব্য প্রেমের পছন্দ বা ভালো লাগার অনুভব ও সেই অনুভবের স্তরটা বুঝতে পারা যায়, এবং হতে পারে তা জীবনের একটি পথ বেছে নেওয়া হিসাবে, কিছু মূল্যবোধগুলোর পরিবর্তে অন্য মূল্যবোধগুলোকে নিজেকে নিবেদিত করার সিদ্ধান্তের মতো।
পছন্দ বা শুধু ভালোলাগার স্পষ্টভাবে এই ধরনের গভীরতা নেই। প্রেমের সাথে কোনো প্রকার ব্যক্তিগত-শনাক্তকরণ বা নিজেকে খুঁজে পাওয়ার বিষয়টা জড়িত কিনা এবং যদি তাই হয় তবে ঠিক কিভাবে, এসব ধরনের একাত্মতা বোঝা যায়, প্রেমের বিভিন্ন বিশ্লেষণ বা বিতর্কের জন্য সেটা একটা কেন্দ্রবিন্দু। তবে বিশেষ করে, আত্মপরিচয়ের এই ধারণা প্রেমের-অনুপ্রেরণার প্রচলিত বোধগম্যতাকে বিকৃত করে দেয়। কারণ আক্ষরিক অর্থে এটি বোঝায় যে, ভালোবাসা প্রেম-স্বার্থের বা লক্ষ্যবিন্দুর পরিবর্তে আত্মস্বার্থের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত। এইভাবে, প্রেমের কেন্দ্রবিন্দু হলো সেই সম্ভাবনা যে প্রেম প্রেমিক-প্রেমিক বা লক্ষ্যবস্তুকে নিজের বাইরে নিয়ে যায়। তারমানে একজন অন্যের স্বার্থের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়ে নিজেকে ভুলে যায়। অবশ্যই, আমাদের এইভাবে আক্ষরিকভাবে ব্যক্তিপরিচয়-শনাক্তকরণের ধারণাটা নেওয়ার দরকার নেই। একজনের প্রিয়জনের সাথে সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে একজনের প্রিয়জনের জন্য ঠিকই একই উদ্বেগ থাকতে পারে, যা সেই একজনের নিজের জন্য উদ্বেগের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
অন্যান্য ব্যক্তিগত মনোভাব থেকে ভালবাসাকে আলাদা করার আরেকটি সাধারণ উপায় হলো, একটি স্বতন্ত্র ধরনের মূল্যায়ন, যা নিজেই প্রেমের গভীরতার জন্য দায়ী হতে পারে। আবার, প্রেমের মধ্যে মূলত একটি স্বতন্ত্র ধরণের মূল্যায়ন জড়িত কিনা এবং যদি তাই হয় তবে কীভাবে সেই মূল্যায়নের অর্থ করা যায়, তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক রয়েছে। মূল্যায়নের প্রশ্নগুলির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ন্যায্যতার প্রশ্নগুলি, মানুষ কি কোনো একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকেই ভালোবাসা বা সেই ভালোবাসা অব্যাহত রাখার ন্যায্যতা বা যুক্তি দিতে পারে এবং যদি তাই হয় তবে কীভাবে? যারা প্রেমের যু্ক্তি সম্ভব বলে মনে করেন, তাদের জন্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই ধরনের ন্যায্যতার স্বতন্ত্র মূল্যায়ন ব্যবহার করেন, আর সেই প্রশ্নের উত্তরগুলো স্থিরতা বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রেমের সাথে জড়িত বলে মনে হতে পারে, তবে উত্তরগুলো বা প্রেমের বর্ণনার ব্যক্তি-প্রচেষ্টাকে দ্বারা প্রভাবিত, এই অর্থে যে, কার ভালোবাসা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের দিকে প্রবাহিত হয় তা অনির্দিষ্ট।
এর পরবর্তী প্রেমের তত্ত্বগুলিকে সন্দিহানভাবে অস্থায়ী চার প্রকারে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়:
১. মিলন বা ঐক্যবদ্ধ ভালবাসা।
২. চরম সংস্রব বা দৃঢ় উদ্বেগময় ভালবাসা।
৩. মূল্যায়িত ভালবাসা।
৪. আবেগঘন ভালবাসা।
তবে এটা পরিষ্কার হওয়া উচিত যে, এক প্রকারের অধীনে শ্রেণিবদ্ধ করা নির্দিষ্ট তত্ত্বগুলি কখনও কখনও দ্বন্দ্ব ছাড়াই, অন্যান্য ধরণের ধারণাগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। এখানে চিহ্নিত প্রকারগুলি কিছু পরিমাণে সমাপতিত অংশ হিসেবে অন্য শ্রেণিতেও বিস্তার করে এবং কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তত্ত্বগুলিকে শ্রেণিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে অত্যধিক সীমাবদ্ধ বিভাগে ভাগ করা হয়। শ্রেণিবিভাগীয় সমস্যাটির একটি অংশ হলো, প্রেমের অনেকগুলি বিবরণই আপাত-খণ্ডতাবাদী বা হ্রাসমূলকভাবে আংশিকতাবাদী। যার মানে হলো, সংযুক্তি, শঙ্কা, মূল্যায়ন, স্নেহ ইত্যাদির মতো ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে ভালবাসাকে বোঝা, যেগুলোর নিজেদেরই কোনো সঠিক বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না বা করা হয় না। এমনকি যখন এই বর্ণনাগুলি স্পষ্টভাবে হ্রাসমূলক ভাষা পরিহার করে, তখন খুব কমই দেখানোর চেষ্টা করা হয় যে, কীভাবে প্রেম বিষয়ক কোনো একটি দৃষ্টিভঙ্গি ধারণাগতভাবে অন্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। ফলস্বরূপ, যেহেতু নির্দিষ্ট তত্ত্বগুলিকেই শ্রেণিবদ্ধ করার কোনও সুস্পষ্ট এবং সংশয়াতীত উপায় নেই, তাই প্রাসঙ্গিক শ্রেণিগুলি কী কী হওয়া উচিত তা চিহ্নিত করাটাও দুরুহ।
লেখক: ড. এস. তানভীর রাতুল; এফআরএসএ, এফআরএসএল
অধ্যাপক, স্কুল অব হিস্টোরি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার (ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি)
পরিচালক, সেন্টার ফর নিউ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়