ড. তানভীর রাতুলের দর্শনগদ্য ‘মূল্যায়িত ভালোবাসা’
পর্ব ২
প্রকাশিত : জুন ২০, ২০২২
মূল্যদান-মূল্যায়িত ভালোবাসা
মূল্যবান-মূল্যায়িত তত্ত্বের বিপরীতে, এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রেমকে মৌলিকভাবে প্রিয়জনকে মূল্যদান বা মূল্য দেওয়ার বিষয় বলে বোঝানো যায়। অন্যকে সাম্মানিক মূল্য প্রদান করা মানে অন্যজনের মধ্যে এক ধরনের অন্তর্নিহিত মূল্য অভিক্ষেপ বা স্থাপন করা। প্রকৃতপক্ষে প্রেম সম্পর্কে এই সত্যটিই প্রেমকে পছন্দের থেকে আলাদা করে বলে ধারণা করা হয়। ভালোবাসা হলো এমন একটি মনোভাব যার কোনো স্পষ্ট উদ্দেশ্য নেই, পক্ষান্তরে পছন্দ হলো মজ্জাগতভাবে উদ্দেশ্যবাদী। অতএব এই ধরনের মূল্য প্রদানের জন্য সঠিকতার বা গভীরতার কোনো মানদণ্ড নেই। আর এভাবেই ভালোবাসা অন্যান্য ব্যক্তিগত মনোভাব যেমন কৃতজ্ঞতা, উদারতা ও সংবেদন থেকে আলাদা। ভালবাসা, বস্তুর মূল্য যাই হোক না কেন তাকে মূল্যায়িত করে, গুরুত্ব দেয়। ফলস্বরূপ প্রেম এমন মনোভাব যা কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত বা যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।
কাউকে এই ধরনের মূল্য প্রদান করাটা আসলে কী? এটি প্রিয়জনের প্রতি এক ধরনের সংযুক্তি এবং প্রতিশ্রুতি, যেখানে একজন অন্যজনকেই প্রেমের শেষগন্তব্য বা বিরাজমান লক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করে এবং তাই নিজস্ব স্বার্থ, আগ্রহ, উদ্বেগ ইত্যাদির মূল্য হিসাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। এর অর্থ আংশিকভাবে এই যে, মূল্যদান তত্ত্ব নিজেকে প্রকাশ করে প্রিয়জনের চাহিদা এবং স্বার্থের প্রতি যত্নশীল হওয়ার মাধ্যমে, সেই স্বার্থরক্ষার ইচ্ছা ও উপকার বা উন্নতি সাধনের মনোভাবের দ্বারা, অন্যজনের কৃতিত্বগুলিতে আনন্দিত হয়ে। এটি অনেকটা দৃঢ় উদ্বেগের দৃষ্টিভঙ্গির মতো শোনাচ্ছে, তবুও মূল্যদানের দৃষ্টিভঙ্গি এমন দৃঢ় উদ্বেগকে বোঝার ক্ষেত্রে আলাদা। মূল্যদান মূল্যোয়িত তত্ত্বানুসারে, উদ্বেগগুলো প্রেম গঠনের উপদান নয়; বরং এধরণের উদ্বেগাকাঙ্ক্ষাগুলো ভালোবাসায় সম্মানের অনুদান বা গুরুত্ব প্রদানেরই প্রভাব।
একজন প্রিয় অন্যজনকে মূল্য দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন অন্যজনকে এমনভাবে দামি-মূল্যবানে পরিণত করে যে, একজন সেই অন্যজনের প্রতি প্রচণ্ড উদ্বেগের সাথে প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করাটাকে নৈতিক দায়িত্ব হবে মনে করে। একজন অন্যজনকে মূল্য দেওয়ার বিষয়টা বোধগম্য করানোর জন্য, একজনের অবশ্যই অন্যজনকে মূল্যবান হিসাবে যথাযথভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়। এবং এর জন্য অন্যজনের মঙ্গল কীসে নিহিত এবং কীসব সেই মঙ্গলকে ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে একজনের কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। এই বোধের জন্য অন্যজনের শক্তি ও ঘাটতিগুলি কী কী তাও একজনের জানা প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজন জানার বিষয়টা আসলে বিভিন্ন উপায়ে মূল্যাবধারণ করারই আরেকটা নাম। প্রদান নির্ভর এই তত্ত্ব প্রিয় অন্যজনকে প্রকৃত দর্শন বা সত্যিই দেখার এবং সেই অন্যজনের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার বিষয়টি আগেভাগেই এক ধরনের মূল্যায়ন হিসাবে অনুমান করে।
প্রেমের মধ্যে কী রয়েছে বা ভালাবাসা কী দিয়ে তৈরি তা বোঝার জন্য এই আন্দাজটাই প্রাথমিক প্রদান। প্রাথমিক এই মূল্যায়ন শুধুমাত্র প্রয়োজন যাতে প্রিয় অন্যজন ও তার মানসম্মানের প্রতি প্রতিশ্রুতি এইভাবে প্রদত্ত বা দেওয়া যেন ব্যবহারিকভাবে ফলিতার্থ হয়। মানে, এটি কোনো অজানার অন্ধভাবে বশ্যতা স্বাীকার করা নয়। ভালোবাসার দর্শন এ ধরনের বিবরণে মূল্যায়নের জন্য জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করে একটি আঁটসাঁট সরুপথে চলে গেছে। যেহেতু এসব ব্যাখ্যা মৌলিকভাবে প্রদান বা অনুদানের বর্ণনা তাই এগুলো দিয়ে প্রেমকে ন্যায়সঙ্গত বিষয় প্রমাণ করা যায় না; কারণ মানুষ প্রেমের প্রাসঙ্গিক মূল্য কারণ ছাড়াই অযৌক্তিক, অবাঞ্ছিত ও অনৈচ্ছিকভাবে প্রদান করে। এটা ইঙ্গিত দেয় যে, প্রেম অন্ধ; প্রিয় অন্যজন কেমন মানুষ সেটা বিবেচ্য বিষয় না, যা স্পষ্টতই মনে হয় মিথ্যা।
মূল্য-প্রদানের গুরুত্ব ও প্রভাব সনির্বন্ধভাবে পুনর্বিচার করলে এই উপসংহারটি এড়ানোর চেষ্টা করা যায়। কারণ মানুষ অন্যের শুধুমাত্র কিছু পূণ্য ও পাপ তথা গুণ ও গুনাহ মূল্যায়িত করে। তারপরও এখানে কারণ শব্দটা ব্যবহার করা হলো এইজন্য যে, যদিও তা প্রেম-প্রদানকে ন্যায্যতা দিতে পারে না, তবুও অন্তত এক ধরণের আনুষঙ্গিক নৈমিত্তিক কার্যকারণ ব্যাখ্যা করে। এক্ষেত্রে প্রেমের নির্বাচনশীলতা অনেকটা পূর্বোক্ত মতবাদের মতোই, এবং একই সমালোচনার সম্মুখীন। প্রেমের যোগ্যতা বিষয়ক ধারণা ভালোবাসা যেসব ভাল বা খারাপ কারণে বিচক্ষণ বা বিবেচক হতে পারে সেটা বোঝার উপায়কে অবোধগম্য করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে প্রেমকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করাটা যে এক অসফল প্রয়াস এই উপলব্ধি যে কোনো উপহার বা প্রদান দৃষ্টিভঙ্গির জন্য একটি সমস্যা।
হয় (ক) অনুদান কখনোই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না, যে ক্ষেত্রে প্রেমের ন্যায্যতা অসম্ভব, অথবা (খ) অনুদানকে ন্যায়সঙ্গত মনে করা যেতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে প্রদত্ত মূল্যবোধ বা সম্মানের মূল্যায়ন করা কঠিন, যার মানে হলো সেই মূল্য অর্পণ বা দেওয়ায় লক্ষ্যবস্তুর পূর্ববর্তীভাবে বিদ্যমান গুণাবলি বিবেচ্য বিষয় না। আরও সাধারণভাবে, প্রদান তত্ত্বে যে কোনো প্রবক্তারই প্রেম সম্প্রদান করা বলতে কী বোঝায়, তা এযাবত পর্যন্ত প্রাপ্ত বর্ণনার চেয়েও অনেক বেশি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা দরকার। একজন কী বা কতটুকু মূল্য প্রদান করে, এবং কিভাবে একজনের প্রদান করা মূল্য অন্যজনের কাছে আমানত বা জমাকৃত হতে পারে? ডেভিড হিউম-এর আলোকে অপরিশোধিত উত্তরটি হতে পারে যে, মূল্যমানটি একজনের মনোভাবের স্বপক্ষে বিশ্বের সম্মুখে প্রক্ষিপ্ত কিছু একটা, যেমন ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা।
তবুও এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অপর্যাপ্ত, যেহেতু প্রক্ষিপ্ত মান একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির সাপেক্ষে আপেক্ষিক হওয়ার পরেও কোনো তাত্ত্বিক উপযোগিতা নেই এবং ব্যাখ্যাটি মূলত শক্তিশালী উদ্বেগের দৃষ্টিভঙ্গির একটি বৈকল্পিক বা ভ্ন্নিরূপ মাত্র। তদুপরি, ভালবাসার অনুদান নির্ভর বিবরণের জন্য, প্রশংসা এবং সম্মানের মতো অন্যান্য ব্যক্তিগত মনোভাব থেকে ভালোবাসাকে আলাদা করার জন্য সতর্কতা প্রয়োজন: এইসব অন্যান্য মনোভাবও একপ্রকার মূল্য প্রদান? যদি তাই হয়, তাহলে এই ক্ষেত্রে প্রদান কীভাবে ভালোবাসার প্রদান থেকে আলাদা? যদি তা না হয়, তবে কেন নয়, এবং ভালোবাসার এমন বিশেষ উপাদান কী আছে যার জন্য প্রশংসা এবং সম্মানের চেয়ে মৌলিকভাবে ভিন্ন মূল্যায়নমূলক মনোভাব প্রয়োজন?
তবুও, দান দৃষ্টিভঙ্গিতে সত্যের একটি অন্তর্বীজ বা মর্মস্থল আছে: এই ধারণা অবশ্যই কিছুটা সঠিক আছে যে, প্রেম সৃজনশীল এবং লক্ষ্যবস্তুর পূর্ববর্তী মূল্যের প্রতি নিছক প্রতিক্রিয়া নয়। আর প্রেমের যে বিবরণগুলো মূল্যায়নের ধরণকে বা ভালোবাসাকে শুধু মূল্যবানের মূল্যায়ন বা লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে নিহিত গুণাবলি প্রশংসা হিসেবে মনে করে, সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে কী কী বিষয় উল্লেখে ব্যর্থ তা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে। চলবে
লেখক: ড. এস. তানভীর রাতুল; এফআরএসএ, এফআরএসএল
অধ্যাপক, স্কুল অব হিস্টোরি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার (ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি)
পরিচালক, সেন্টার ফর নিউ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়