ড. তানভীর রাতুলের গল্প ‘একজন সলিমুল্লা’
প্রকাশিত : অক্টোবর ২৬, ২০২২
খুবই গভীর কথা। হিসাব বিভাগের মর্জিনা আমাকে আমার দিবাস্বপ্ন থেকে ডেকে তুললো।
কি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তুমি যা লিখেছ।
আমি নিচে তাকালাম। সেখানে আমার খাতায় হাবিজাবি: আমরা প্রকৃতির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই; আমরা সৌন্দর্যের জন্য লজ্জিত। লেখা অগোছালো। আমি হাতের লেখাটাকে নিজের বলে চিহ্নিত করতে পারতাম না। তবে যেহেতু মর্জিনা বলছে, অবশ্যই আমার।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললাম, মনেও নেই।
কিন্তু এটাই আমি, বুঝলেন, দিবাস্বপ্নকারী। নিজেকে বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন মোহগ্রস্থতায় আবন্ধ অবস্থায় খুঁজে পাই। কিন্তু আমি আগে কখনো সেভাবে কিছু লিখিনি। সেইদিন পরে আরেকবার আবার দিবাস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসে আমার খাতায় একই অপরিচ্ছন্ন হাতের লেখায় আরেকটি লেখা বাক্য পেলাম: আমি কি আত্মহত্যা করব, নাকি এক কাপ কফি খাব?
আরেকটা গভীর কথা এবং কিছুটা বিরক্তিকরও। আমি এবার কফিটাই বেছে নিলাম। একটু আগেই তো সোনালীকে দেখলাম। সোনালী, তীক্ষ্ণ মেধাবী ও গুরুতর-অভিব্যক্তি দেখানো, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনো, এবং জীবনের প্রথম চাকরিতে নিজেকে সহজেই ঢোকানো একজন। তিনি ভেষজ চা পান করতে পছন্দ করেন আর খাদ্যতালিকাটা শাকাহারী।
সোনালী, সে এখনো সোনা পর্যন্ত নামেনি, আপনি কি আমার জন্য এই বিবৃতিগুলিতে একটু নজর বুলিয়ে দিতে পারেন?
আমি তাকে আমার লেখাগুলো দেখালাম, এবং তার মুখে স্বীকৃতির ঢেউ বয়ে গেল।
আহ। অ্যালবার্ট কামু! সে বলল, খুব ভালো। ফরাসি আলজেরিয়ান দার্শনিক এবং অযৌক্তিকতাবাদী।
অযৌক্তিকতা! আমি কথার পুনরাবৃত্তি করলাম।
হ্যাঁ। তিনি বলেছিলেন যে, দর্শনে একটিই আসল প্রশ্ন, আর তা হলো আত্মহত্যা করা উচিত কিনা। তিনি বলেছিলেন যে, জীবনের অর্থ অনুসন্ধান করা অর্থহীন কারণ তা অযৌক্তিক।
দারুন. তার শেষমেষ কি হলো? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ওহ, সে আত্মহত্যাও করেনি। তিনি বলেছিলেন যে, সেটাও অর্থহীন। কারণ মৃত্যু অযৌক্তিক। তিনি ষাটের দশকে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান।
কিন্তু আমি তার কথা আগে শুনিনি বা তার কোনো বইও পড়িনি। আমি কি করে জানব এটা কিভাবে লিখতে হয়? আমি অবাক হয়ে গেলাম।
আচ্ছা, কামু বেশ ভালোই পরিচিত। হতে পারে আপনি তার কোনো কিছু জিনিস অবচেতনে সংগ্রহ করেছেন। সোনালীর প্রস্তাবিত সম্ভাব্য কারণ। অথবা হয়তো আপনার ওপরে তিনি ভর করছেন।
পরের কয়েক দিনে কামুর লিখিত চিন্তা নিয়মিতভাবে বেড়ে গেল। আমি জানতাম ভাবনাগুলো কামুর কারণ। আমি ঘাঁটাঘাটি করেছি।
শেষ বিচারের জন্য অপেক্ষা কোরো না। এটা প্রতিদিন হয়।
যেহেতু আমরা সবাই মারা যাচ্ছি, স্পষ্টতই কখন এবং কিভাবে সেটা আর কোনো বিবেচ্য বিষয় না।
মানুষই একমাত্র প্রাণী যে সে যা তা হতে অস্বীকার করে।
আমি কেবল সোনালীকেই এই অভিজ্ঞতাগুলির অংশীদার করেছি, যে কিনা ঘটনাগুলির দ্বারা বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠে এবং তার পুরানো বইয়ের স্তূপ থেকে আধুনিক ফরাসি দর্শন সম্পর্কে কি একটা খুঁজে পায়। সেখানে স্বয়ংক্রিয় লেখা নামক আমার দিবাস্বপ্নের মতই ঘটনা নিয়ে গবেষণার কথা লেখা আছে। সচেতনভাবে লেখা ছাড়াই লিখিত শব্দ তৈরি করার ক্ষমতার উপরে। লেখক একটি ঘোরের মতো অবস্থায় প্রবেশ করেন। তিনি কী লিখছেন তা নিয়ে ভাবেন না এবং যে কাগজে তিনি লিখছেন তার দিকেও তাকান না। স্বয়ংক্রিয় লেখকরা প্রায়ই দাবি করেন যে, লেখার সময় অন্য কেউ একজন তার উপর `ভর করেছে` বা তাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই একজন কেউটা হয় মৃত কোনো ব্যক্তি।
সোনালী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধানের সাথে আমাকে কথা বলানোর জন্য সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে। যখন আমরা দেখা করতে গেলাম সেখানে দর্শন বিভাগের প্রধানের সাথে জাদুকর বা সম্মোহকারী কেউ একজন ছিল যিনি আমাকে গভীর ঘোরের বা ঘুমের মধ্যে পাঠিয়ে দেন। যখন আমার চেতনা ফিরে আসে তখন আমি দেখতে পাই সামনে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে কিসব লেখা, তবে সেই বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আর সোনালী যেন খুবই মুগ্ধ। অধ্যাপক বললেন, এগুলি যে আলবার্ট কামুর কথা তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিছু ধারণা ইতিমধ্যেই তার প্রকাশিত রচনাগুলিতে অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু, কৌতুহলজনকভাবে, কিছু সম্পূর্ণ নতুন এবং এমন ধারণা যা কামু নিজেও তার জীবনে কখনো প্রকাশ করেননি।
অধ্যাপক জোর দিয়ে বললেন যে নিকট ভবিষ্যতে নির্বাচিত-আমন্ত্রিত সহকর্মীদের একটি দলের সামনে পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করা দরকার। বাড়ি ফেরার পথে সোনালী আমার হাত ধরে আর আমি আমার নতুন আজব ক্ষমতাটা উপভোগ করতে থাকি। পরের কয়েক সপ্তাহে কামু আমাকে বড় একটা লেখা লিখতে সাহায্য করে, কিন্তু যখন আমি সচেতনভাবে লেখাটা পড়ি তখন আমি ভাবলাম, মানে, আমি ভেবেছিলাম কেমন যেন বর্ণহীন-নিরানন্দ ভাব সেখানে। সত্যি বলতে একটু দুর্দশাগ্রস্ত। তাই আমি আমার নিজের কিছু কথা দিয়ে পরিবর্তন করি যাতে লেখাটা আরো একটু আনন্দদায়ক হয়। জীবনকে অর্থহীন এবং অযৌক্তিক হওয়ার বিষয়ে কামু যে জিনিসগুলি লিখেছিলেন তা আমি বদলে দিয়ে লিখেছি যে, জীবন মানে ফূর্তি করে সময় কাটানো এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভাবভালবাসা বিনিময়। আমি ভাবলাম, এটাই তো উত্তম দর্শন।
যাইহোক, বিষয়টি অবশ্যই কামুকে বিরক্ত করে কারণ সে আমার উপর ভরকরা বা আমাকে মাধ্যম বানানো বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত আলোচনাসভার দিন ঘনিয়ে আসছে আর কামুর সাথে আমার দুই সপ্তাহের বেশি যোগাযোগ নেই। আমি একেবারে আতঙ্কিত। সোনালী আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যায় এবং তার উত্তেজনা আমার উদ্বেগকে কেবল আরো বাড়িয়েই তোলে। বক্তৃতার নাট্যশালায় প্রায় জনাত্রিশেক গুরুতর-মুখোভঙ্গিরত শিক্ষাবিদদের জটলা। বেঢপ-ধূসর পাজামা, দাগযুক্ত জামা পরা বেশিরভাগ বৃদ্ধ পুরুষ এবং তিক্ত-মুখের কয়েকজন মহিলা।
আজকে একজন স্টেনোগ্রাফার বা শ্রুতিলেখকও ছিলেন যে কিনা আমি যা লিখবো তার সব কিছু টাইপ করবে যাতে আন্তর্জাল-ইন্টারনেট-অনলাইনের বিস্তৃত তথ্যভান্ডার থেকে লেখা এবং লেখককে শনাক্ত করা যায়। আমি এই শিক্ষিত দর্শকশ্রোতাদের হতাশ করা নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলাম। সম্মোহকারী তার কাজ শুরু করলেন, তবে প্রথমে তেমন কিছুই ঘটলো না। কিন্তু কয়েক মিনিটের পরে আমি গভীর ঘোরে চলে যাই, তাই আমি এখানে যা বলছি তা আমার স্মৃতি নয়, কারণ আমার স্মৃতিতে কোন কিছুই নেই, তবে সাক্ষীদের সাক্ষ্য আছে— বেশিরভাগ সোনালীর।
দীর্ঘ সময় নীরবতা ও নিস্তব্ধতার পর আমি কলম ধরলাম এবং লিখতে শুরু করলাম। অধ্যাপক শব্দগুলো উচ্চস্বরে পড়লেন আর শ্রুতিলেখক একই সাথে শব্দগুলো টাইপ করলেন। একজন চাটগাইয়া পতিতার কাছে গেল। দেহজীবী জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি চোষা চাও? চাটগাইয়া বলল, এটা কি আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাতায় প্রভাব ফেলবে? সৈকতে দুই বৃদ্ধ দাসী, একটা পাশ দিয়ে দৌড়ে গেল, আরেকজনের স্ট্রোক হয়েছিল, তবে অন্যটি পৌঁছতে পারেনি। সেখানে একজন গোপালগঞ্জের, একজন সিলেটী, একজন জামাতী এবং একজন উপজাতি...
ঠিক সেই মুহূর্তে সোনালী সামনের দিকে দৌড়ে আসে এবং আমাকে ঘোর থেকে জাগ্রত করার জন্য, আমার চেতনা ফিরিয়ে আনার জন্য, মুখের বামপাশ জুড়ে শক্তকরে চড় মারে। অধ্যাপক ঘোষণা দিলেন যে, আলবার্ট কামু আমার উপর ভরকরা বন্ধ করে দিয়েছে এবং পরিবর্তে ১৯৮০`র দশকের কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদ ও আজীবনের রাজাকার গোলাম আজম এখন একসাথে আমার ঘাড়ে। আমি দর্শন অনুষদের আর কোন কাজের না। সোনালী বললো যে সে এর আগে কখনো এত অপমানিত হয়নি, আমি সেদিন একা একাই বাড়ি ফিরি কোন ধরার মত কারো কোনো হাত ছাড়াই।
তবুও ভালো দিবাস্বপ্ন দেখাটা।
তারপর থেকে সোনালী আমার সাথে খুব কমই কথা বলে, দর্শনের নন্দিততারকা হিসাবে আমার সময় শেষ। আমি এবার গ্রীষ্মের মওসুমে কক্সবাজারে যাবো আর বাংলাদেশে আফগানী ছদ্মবেশী কাপড়ের ফ্যাশন আরো যেন চালু হয় সেই ধান্দা করবো। যাইহোক, টেলিসামাদ বা গোলাম আজম এখনও ভরপুর আর স্বচ্ছভাবে আসে আর এখন আমার আছে আগ্রহের একটি নতুন বলয় যা আর্থিকভাবে লাভজনক।