টিকটিকির রক্ত লাল হয়ে ওঠার আগে

চঞ্চল আশরাফ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯

প্রথম দিবস
‘তাহলে আপনি বলতে চান আমিই আপনাকে খুন করলাম?’
‘হ্যাঁ।’
কয়েকটি গাছ, শালিক আর বাদামের খোসার মধ্যে বসেছিলাম আমি। ঘাসে, যার গোড়ায় জমে ছিল কোনো জলীয় পদার্থ, আমার পশ্চাৎদেশ তাতে ভিজে উঠেছিল।
‘আমি মানি না।’
‘এই বাক্য একজন হন্তারককে চিনিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। বিশেষ বিশেষ শ্রেণির বিশেষ বিশেষ উক্তি থাকে।’
শান্তার মুখ অবনত হয়, বুকের কাছে নেমে আসে। ঈষৎ মাথা ঝাঁকালে না-সূচক, চুলও সামান্য স্থান বদল করে। ‘আপনি এতদিন এখানে আসেন নাই কেন?’
‘আমাকে হত্যার কাজটি এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। তাই না?’
‘কেন আসেন নাই এখানে এতদিন সেটা আপনি বলেন নাই।’
‘তোমার সঙ্গে এখানে আমার দেখা হয়েছিল। তারপর আমার আর ফেরা হয় নাই।’ শান্তার দিকে না-তাকিয়েই কথাগুলো আমি বলি। হঠাৎ বাতাসে চানাচুরের শূন্য ঠোঙা উড়ে আসে আমার দিকে। তখন ক্ষুধা অনুভব করি। কিন্তু সেটা শান্তাকে বুঝতে দিই না।
‘আমার চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি যাব না। আপনার সঙ্গে বোঝাপড়া হওয়া দরকার।’
তারপর সে আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যায়।... একটা বিশাল বাড়ি, সেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে শুধু সিঁড়ি আর সিঁড়ি। আমার শরীর উপর্যুপরি প্রশ্বাসে অবসন্ন হয়ে আসে; একটা সিঁড়ির উপর বসে পড়ি আমরা। তখন বিকেল শেষ হতে থাকে।
‘আমার ওপর কি আপনার রাগ আছে, ক্ষোভ আছে?’ শান্তা প্রশ্ন করে।
‘টিকটিকির রক্ত দেখ নাই? তেলাপোকার রক্ত? শাদা। ঠাণ্ডা।’ আমি বলি। বলার পর অনেকক্ষণ আমাদের মধ্যে বিশেষ কোনো কথা হয় না। হত্যাকাণ্ড সাঙ্গ হলে যে নৈঃশব্দ্য নেমে আসে, আমরা, না না আমি, সে-নৈঃশব্দ্যের ভেতর অনড় অস্থির ঠাণ্ডা নিয়ে বসে থাকি। ঝাপসা অন্ধকারে হাঁটুতে মুখ গুঁজে শান্তার বসে থাকাকে মনে হয়, প্রেতিনীর অনুতাপের মুদ্রা। হঠাৎ তার গলা শুনি, ‘আপনি আত্মহত্যা করেছেন। হ্যাঁ, আপনি নিজেই নিজেকে...’ এই অসমাপ্ত উক্তির ভেতর শান্তা অদৃশ্য হয়ে যায়। অন্ধকার গাঢ় হয়ে ওঠে তখন। তার ভেতর আমি মিশে যেতে থাকি। আচ্ছা, এর পর কোথায় যাব? আমি কোথাও যাব না বলে দিলাম, আমি শুধু আসবো, আসতে থাকবো। কোথাও যাব না, শুধু আসবো আর আসবো।...
অন্ধকার বাগানকে দখল করতে থাকে।

দ্বিতীয় দিবস
এটা এমন এক উদ্যান বা বাগান যার টিকে থাকার মতো কোনো নাম নেই, যেহেতু সময়ে-সময়ে তার পরিবর্তন ঘটে। সেখানে আমরা হাঁটি, কারণ গাছের গোড়া ও ছায়া ক্লান্ত বেশ্যা ও অক্লান্ত প্রেমিক-প্রেমিকার (!) দখলে। আমরা হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে আমদের মধ্যে যেসব কথা বা সংলাপ হয়, সেগুলি এরকম—
শান্তা: আমি কি আপনার সময় নষ্ট করলাম?
আমি: আই অ্যাম আউট অব মাই টাইম। অথবা, আমার কোনো সময় নাই।
শান্তা: আমি আপনাকে কিছু দিতে চাই।
আমি: আমি মৃত।
শান্তা: আমি আপনাকে খুন করি নাই।
নৈঃশব্দ্য।
শান্তা: আমি নিজেই নিজেকে।... আমি জানি।
এই অসম্পূর্ণ কথার ভেতর শান্তা অদৃশ্য হয়। হঠাৎ বাতাসে গাছের পাতাগুলি ঝরে  পড়তে থাকলে ক্ষুধা পায় আমার। তবে তা ঠোঁটের। শান্তাকে চুমু খেতে ইচ্ছা করে। তা না করে হাঁটতে শুরু করি আবার। এক সময় মনুষ্যনির্মিত হ্রদের কাছে এসে পড়ি। কৃষ্ণচূড়ার প্রতিবিম্ব যখন দেখি পানির দিকে তাকিয়ে, তখন আমার সোয়েটারের হাতায় পেছনমুখি টান অনুভব করি। দেখি, শান্তা হাসছে; সে আমাকে অনুসরণ করতে বললে, করি এবং বাগানে একটা ঢিবির পাশে, ঘাসে বসে পড়ি।
শান্তা: আপনার অদ্ভুত শক্তি। কেমন আমাকে নিয়ে এলেন এখানে।
আমি: এটা মৃতদের জায়গা।
শান্তা: এই গাছগুলি?
আমি: কবরের উপর দাঁড়ানো।
শান্তা: এই ঘাসের সবুজ? আকাশ, সাদা সাদা মেঘ?
আমি: ইলিউশন।
শান্তা: আর আমি?
নীরবতা।
তারপর সে আমাকে আর কথা বলতে দেয় না। একাই বলে যায়, আমি কেউ না কারও না, যাদের কাছে গেছি— চারজন, আপনিও তাদের সঙ্গে— হ্যাঁ, সবাই আমাকে তাদের পৃথিবীটা দেখিয়ে বলে— এখানে তোমার জায়গা নাই, তুমি যাও অন্য কোথাও— আমি কোথায় যাব? আমি কোথাও যাব না বলে দিলাম, আমি শুধু আসবো, আসতে থাকবো, আমি কোথাও যাব না, আমি শুধু আসবো, আসবো আর আসবো...
অন্ধকার বাগান দখল করতে থাকে।

 

তৃতীয় দিবস
এবং শান্তা এলো। আমার নিদ্রা তখনো ভঙ্গ হয়েছিল না, আসলে কখনো আমার নিদ্রা ভেঙে ছিল না; সেই কঠিন ও দীর্ঘ নিদ্রার মধ্যে শান্তা কথা বলতে লাগলো। তার দেহবেষ্টন করে আমি ব’সে ছিলাম রিকশার হুডের ভেতর। আমরা যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার কোনো গন্তব্য ছিল না। ধীরে-ধীরে আমার আঙুল তার পেট থেকে বুকে নিয়ে বললাম, ‘তুমি দেখছি মোটা হয়ে যাচ্ছ।’
‘আপনি শেষ পর্যন্ত শরীর বুঝলেন। আমার কি আর কিছু নাই?’ শান্তা বললো।
‘কি বুঝিতে চাই আর?’ আমি বললাম।
‘ভালোবাসা বোঝেন না, হৃদয় বোঝেন না?’
‘এটা আবার কী? আর একটা কী যেন বললে— হৃদয়, হ্যাঁ, এক প্রকার সুস্বাদু খাদ্য না? তোমরা বেশ তৈরি করতে পারো। অমি অবশ্য খেয়েছিও।’ শান্তার বাঁ স্তনে ম্লান-সাদা চাদরের আড়ালে চাপ দিয়ে আপাতত শেষ বাক্যটি উচ্চারণ করি, সে বহু দিন আগের কথা, কবিরা তখন রাজার প্রশংসা করিয়া পয়ার রচনা করিতেন।...
শান্তা হঠাৎ স্তন থেকে আমার হাত অপসারণ করে। তারপর আমাকে এলোমেলো কিল-চড়-ঘুষি মারতে থাকে। রিকশার ঘোমটা কেঁপে ওঠে, রাস্তা ও দৃশ্যগুলি ঝনঝন নড়ে আর শব্দ করে; আমার নিদ্রা তখনও ভঙ্গ হয়েছিল না, আসলে কখনো আমার নিদ্রা ভেঙে ছিল না। সেই কঠিন ও দীর্ঘ নিদ্রার মধ্যে শান্তা আমাকে কিল-চড়-ঘুষি মারলো।

চতুর্থ দিবস
হন্তারক ও শিকারের কিংবা জীবিত ও মৃতের সম্পর্ক সম্পর্কে এভাবে গল্পকে কতটুকু এগিয়ে নেয়া যায়? তাই, অথবা যেহেতু, আমিই এই গল্পের মূল একটি চরিত্র, যেহেতু প্রহার আমাকে সহ্য করতে হয়েছে, আমি ঠিক করি হন্তারকের সঙ্গে সঙ্গম করব। শুধু এই একটা প্রান্তে এসে হন্তারক আর আমার সমঝোতায় আসা যায়, গেল বটে। আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা নিশ্চয় জানেন এবং বোঝেন যে, মুক্তযৌনতা একরকম সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ। বিশেষত যাদের প্রতিবাদের ভাষা জানা নেই, পথও আগে থেকে রোধ করা হয়ে আছে, তাদের জন্য। (জীবজন্তুর ক্ষেত্রে এটা আরও প্রযোজ্য। সঙ্গমের আগে কি টিকটিকির রক্ত লাল হয়ে উঠতে চায় না? অথবা, তেলাপোকার?)
শান্তা বলে, আমি আপনার সঙ্গে আজ রাতটা থাকতে চাই।
আমি বলি, আমিও।
শান্তা বলে, কোথায় থাকবো?
আমি বলি, কোথায়?
শান্তা বলে, হাসানের বাসায়। হাসান আমাকে ভালোবাসে।
আমি বলি, থাকতে দেবে?
শান্তা বলে, দেবে।
আমরা হাসানের বাসায় যাই। অনেকবার ডোরবেল টিপলেও দরজা খোলে না কেউ। শান্তা আমার দিকে তাকায়। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ‘হাসান বোধ হয় বাড়িতে নাই।’ আমরা তবু দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন, দেখতে হাসানের মতোই, এগিয়ে আসে। বলে, হাসান নাই।
আমরা রাস্তায় নেমে আসি।
শান্তা বলে, কোথায় থাকবো তাহলে?
আমি বলি, কোথায়?
শান্তা বলে, অরুণের বাসায়। অরুণ আমাকে ভালোবাসে।
আমি বলি, থাকতে দেবে?
শান্তা বলে, দেবে।
আমরা অরুণের বাসায় যাই। অনেকবার ডোরবেল টিপলেও কেউ দরজা খোলে না। শান্তা আমার দিকে তাকায়। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বলে, ‘অরুণ বোধ হয় নাই।’ তবু আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। অপেক্ষা করি। আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কোঁকড়ানো চুল মাথায় করে অরুণের মতোই দেখতে একজন এগিয়ে আসে। বলে, ‘অরুণ তো নাই।’
এরপর আমরা রায়হানের বাসায় গিয়ে ডোরবেল টিপে দাঁড়িয়ে থাকি, অপেক্ষা করি। আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাতলা ঠোঁট ও খাড়া নাকবিশিষ্ট রায়হানের মতোই দেখতে একজন এগিয়ে এসে বলে, ‘রায়হান নাই।’
আমরা রাস্তায় নেমে আসি।
শান্তা বলে, কোথায় থাকবো আমরা?
আমি বলি, কোথায়?
শান্তা বলে, আপনার বাসায় থাকবো। আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন।
আমি বলি, আমি মৃত।
শান্তা বলে, আমি তো থাকতে চাইছিলাম আপনার সঙ্গে। একটা রাত।
আমি বলি, আমিও।
তখন বাতাসে ধূলা প্রবাহিত হয় আমার মাথার উপর দিয়ে। আমার ক্ষুধা পায় না। আমি তা পেতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমার খুব শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। রাস্তায়, যে-কোনোখানে, অথবা সর্বত্র। দাঁড়িয়েই আমি অনুভব করি, আমি শুয়ে যাচ্ছি।
ততক্ষণে আমার বাইরে দণ্ডায়মান আর ভেতরে শায়িত শরীরের উপর শান্তা রহস্যময়, প্রলুব্ধকর ও ভয়জাগানো মুদ্রায় নাচতে শুরু করেছে।