টাঙ্গুয়ার হাওর: কল্পনার চেয়েও সুন্দর
প্রশান্ত কুমারপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯
মর্নিং শোজ দা ডে বলে একটা কথা আছে। অনেক প্রবাদ কালের পরিক্রমায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে, কিন্তু এটা টিকে থাকবে। ট্যুরের প্রথম দিন সকাল থেকেই বুঝতে পারছিলাম, সমস্ত ট্যুর বৃষ্টি-বিঘ্নিত হবে। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত যেয়ে সকালবেলা বাস থেকে নামলাম। ‘পানসি’ রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা সারলাম। আমাদের ট্যুর গ্রুপের নাম বাঙ্গাল ট্রাভেলার্স। বাঙ্গালের কিছু মেম্বার সিলেট এবং মৌলভীবাজার থেকে আসলো। ওদের নিয়ে টেম্পু বা লেগুনা জাতীয় গাড়িতে করে তাহিরপুরের উদ্দেশে রওনা হলাম। যাওয়ার সময়ই দেখলাম, রাস্তার দু’পাশে অথৈ জল। কোথাও কোথাও রাস্তার ওপর দিয়ে একহাঁটু পানি উঠে গেছে। আমাদের লেগুনার ড্রাইভার মামা বেশ এক্সপার্ট। এসব পানি-টানি কেয়ার করে না। পানির ভিতর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল।
তাহিরপুরে আমাদের নৌকা ঠিক করা ছিল। বাঙ্গালের কয়েকজন মেম্বার এই দায়িত্ব নিয়েছেন। বড় বড় দুইটা স্টিলের নৌকা। সাথে লাইফ জ্যাকেট। নারী-পুরুষ মিলে আমরা ৫৬ জন ছিলাম। আমরা ৫৬ জনের দুই দিনের চালডাল, সবজি, বোয়াল মাছ, কালবাউস মাছ, রাজহাঁস নিয়ে নৌকায় উঠলাম। যথা সময়ে নৌকা ছাড়ল। আমরা গান বাজনায় মুখর করে তুললাম সমস্ত হাওর। আমাদের নৌকা দৌড়ায়, সাথে সময়ও গড়ায়। বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে আমাদের নৌকা থামলো হিজল-করচ বেষ্টিত এক জায়গায়। আমার তরুণ মন উদ্দীপনায় আর ধৈর্য মানছিল না। অকস্মাৎ ঢেউ কাঁপিয়ে লাফ দিয়ে ফেললাম। আমার দেখাদেখি আরও অনেকে লাফ দিল। রিপন দা`র ধারণা ছিল, আমি সাঁতার জানি না। সেজন্য আগে থেকেই আমার জন্য একটা লাইফ জ্যাকেট রেডি করে রেখেছিল।
রিপন দা`কে দেখানোর জন্যই হোক আর যে কারণেই হোক, আমি সাঁতার কাটতে শুরু করলাম লাইফ জ্যাকেট ছাড়াই। আমাদের নৌকা থেকে একটু দূরে কয়েকটি গাছ ছিল। রিপন দা বললেন, ‘চলেন সাঁতার দিয়ে ওই গাছের ওখানে যাই।’ আমি সাঁতার দিয়ে বেশ খানিক যাওয়ার পরে দেখলাম, পেছন থেকে রিপন দা নেই। গাছে নাকি সাপ থাকে। তাই একা যেতে ভয় লাগছিল। আবার নৌকা থেকে এত দূরে চলে এসেছি যে, আর ফিরেও যেতে পারছি না। তখন বাধ্য হয়েই গাছের ডাল ধরলাম। সাথে জুবায়ের ভাই আসলো। জুবায়ের ভাই আবার আমার এলাকার। ট্যুরে যেয়েই পরিচয়। দুই দেশি ভাই গাছে পানি ছিটিয়ে নিলাম। যাতে সাপ থাকলেও ভয়ে পালিয়ে যায়। পৃথিবীতে সাপের সাথেই মানুষের পারস্পরিক ভয়ের সম্পর্ক। সাপ মানুষকে ভয় পায়, মানুষও সাপকে ভয় পায়।
জুবায়ের ভাই আর আমি গাছে উঠলাম। জুবায়ের ভাই গাছে উঠেই চিৎকার করতে লাগলো, ঝিনাইদহ ফার্স্ট। আমার তখন মনে হচ্ছিল, ইশ! প্রত্যেক জেলার যদি নিজস্ব পতাকা থাকত তাহলে এই গাছের মগডালে টানিয়ে দিতাম। পতাকা নেই বলে ঝিনাইদহ জেলা এক বিরাট স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হলো।
সবাইকে পানি থেকে ওঠানোর জন্য তাড়া করা হলো। কেউ উঠতে চায় না। বলা হলো, পানিতে প্রচুর জোঁক আছে। তখন সবাই যে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় পানি থেকে উঠে পড়লো। কাপড় সাবধান করার সময় পেল না। একজনকে দেখলাম, গামছা পরেছে আবার গায়ে লাইফ জ্যাকেট। দেখতে এত পিকিউলিয়ার লাগছিল যে, না হেসে পারলাম না। তারপর শুরু হলো খাওয়া-দাওয়া। নৌকার মধ্যেই রান্না-বাড়া করা হয়েছিল। নৌকার ছাদে বসে সবাই একসাথে খেলাম। হাওরের মাছ, হাওরে বসেই খেলাম। মাছগুলোর ভাগ্য কত নির্মম। তাদের আস্তানায় গিয়ে তাদেরকে মেরে তাদের আস্তানায় খাওয়া হচ্ছে!
খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথে বৃষ্টি নামলো মুষলধারে। মনে হচ্ছিল, মেঘগুলো আমাদের জন্যই ওয়েট করছিল। খাওয়া শেষ হলেই নেমে পড়বে। আগে থেকে একটু জিজ্ঞেস করেও নেবে না, ‘একটু ঢেলে দিই?’ তবে পরিবেশটা সুন্দর ছিল। চারদিকে শুধু একটানা বৃষ্টির শব্দ। মনে হচ্ছিল, আজ এই মুহূর্তে যদি আমরা সেখানে না থাকতাম তাহলে বৃষ্টির এই সৌন্দর্য উপভোগ করত কে? পৃথিবীতে এমন কত সৌন্দর্যের বিষয় ঘটে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু দেখার কেউ নেই। সৌন্দর্য কখনই নিজে থেকে সুন্দর না; সৌন্দর্য সবসময়ই সৌন্দর্যপিপাসুর অনুভূতিতে সুন্দর। এমন নির্জন অকূল পাথারে বৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে, আজ থেকে কয়েক কোটি বছর আগেও পৃথিবীতে কত কতবার বৃষ্টি নেমেছে। হয়তো কোনো কোনো বৃষ্টিতে এক ডাইনোসর আরেক ডাইনোসরের প্রেমে পড়েছিল: পৃথিবীর ইতিহাসে তা লেখা নেই। কিংবা পৃথিবী থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে কোনো গ্রহে হয়তো প্রতিদিনই এ রকম করে বৃষ্টি নামে। অথচ সেখানে হয়তো কোনো কবি নেই কবিতা লেখার; নেই কোনো প্রেমিকা বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখার।
এমন বৃষ্টিতে মনে পড়ে এক অজানা কবির কবিতা:
কথামালা দিয়েছি তাই
আর কী-ই বা দিতে পারি
বলেছিলে তুমি প্রতিবেশি হওয়া
এখানে মেঘের বাড়ি।
এখানে বর্ষা ভূমিষ্ঠ হলে কান্নার সাথে আড়ি।
বৃষ্টি থেমে গেলে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। কোনদিকে যে গিয়েছিলাম, মনে নেই। আমার মনে হচ্ছিল, দক্ষিণে যাচ্ছি। কিন্তু কম্পাস বের করে দেখলাম উত্তরে। আমার খুব দিক ভুল হয়। ইচ্ছা করেও দিক ঠিক করে রাখতে পারি না।
মৃদু বাতাসের মধ্যে দিয়ে ঢেউ কেটে কেটে আমাদের নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে। খুব দূরে দেখলাম কালো মেঘের মতো কিছু। নৌকা আরও কাছে গেলে মেঘগুলোকে স্পষ্ট করে দেখলাম। ওগুলো মেঘ নয়; মেঘালয়ের পাহাড়। বাঙালির পাহাড় দর্শন খুব বেশি না। সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘পালামৌ’ ভ্রমণকাহিনিতে বলেছেন, ‘বাঙালি একটু মাটির উঁচু ঢিবি দেখলেই মনে করে পাহাড়।’ আমারও তাই মনে হলো। এতদিন যে পাহাড় দেখে এসেছি, মেঘালয়ের পাহাড়ের কাছে নিতান্তই তা মাটির ঢিবি ছাড়া কিছু নয়। পাহাড় থেকে তখনও আমরা অনেক দূরে। তবু মনে হচ্ছে, খুব বেশি দূরে নয়। এক লাফ দিয়ে সাঁতার কেটে পাহাড়ের পাদদেশে চলে যেতে পারব। দূর থেকে পাহাড়কে যত কাছে মনে হয়, কাছে থেকে পাহাড় অতটা কাছে নয়।
আমাদের নৌকা ট্যাকের ঘাটের কাছে এক জায়গায় নোঙর করলো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বেশ আগেই। আমরা কয়েকজন নেমে স্থানীয় একটা বাজারে গেলাম। দেখলাম, সেখানে একটা শহিদ মিনার আছে। ছোট ছোট ভ্রাম্যমাণ দোকান চোখে পড়লো। আরও একটু এগিয়ে গেলে একটা বাজার দেখলাম। একেবারে পাহাড়ের গা ঘেঁষে বাজার। পাহাড়টা সম্পূর্ণ ভারতের। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বাংলাদেশের। যখন নৌকা করে ট্যাকের ঘাটের দিকে আসছিলাম তখন মনে করেছিলাম, টাঙ্গুয়ার হাওরের জলসীমাই হয়তো বাংলাদেশের সীমানা। তারপরে ভারতের সীমান্ত শুরু। কিন্তু এই বাজারে এসে ভ্রম কাটলো। সেখানে বাংলাদেশের বসতি আছে। পাহাড়ের পাদদেশেই বাংলাদেশের বসতিরা বাস করে।
মেঘময় আকাশ। চারদিকে ঘন অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। মন বারবার আরও কিছু জানতে চায়। কী জানতে চায় মন তা জানে না। মন চায়, ওই পাহাড়ের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকি। পাহাড়ের নিশ্চয়ই মায়া আছে। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পালামৌ এবং লাতাহার পাহাড়ে একা একা যেয়ে চুপ করে বসে থাকতেন। কতদিন অমন করে বসে থেকেছেন, তার ঠিক নেই। আমারও মন চায় মানুষের আরোপিত এই রাষ্ট্রীয় সীমানা অতিক্রম করে পাহাড়ে গিয়ে বসে থাকি। মানুষের অনেক নিষ্ঠুর নিয়মের মধ্যে একটি নিয়ম, রাষ্ট্রীয় সীমানা। যদি পাখি হতাম তাহলে হয়তো মানুষের কঠিন নিয়ম মেনে চলতে হতো না।
একে তো সীমান্ত এলাকা তারপর নতুন জায়গা: বেশিক্ষণ বাইরে থাকা ঠিক না। নৌকায় ফিরে এলাম। নৌকার ছাদে বসে চললো আমাদের গানবাজনা আর নাচানাচি। অনেকগুলো নৌকা একসাথে নোঙর করা। প্রায় সব নৌকাতেই গানবাজনা চলছে। তবে, কোনো প্রতিযোগিতা নেই। আমাদের নৌকা কোনো গান ধরলে অন্য নৌকা থেকেও সুর মেলাচ্ছে। এ এক দারুণ মিলনোৎসব। অথচ, বাঙালি এতটা কোপারেটিভ জানতাম না। বেশিক্ষণ গানবাজনা চলতে পারলো না। বৃষ্টি বাধ সাধলো। নিচে নেমে আসলাম। নৌকার ভিতরে বসে বিশ্বজিৎ দা কবিতা আবৃত্তি করলেন। রানা ভাই গান করলেন। আর সোহানের কথা নাই বললাম। সেই সমস্ত ট্যুরের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রইলো গিটার এবং গান দিয়ে।
সারারাত বৃষ্টি হলো। এমনকি সকাল পর্যন্ত। যে যতটুকু পারে ঘুমালো। বেশিরভাগ রাত না ঘুমিয়েই কেটে গেল। একসাথে অনেকে থাকলে যেটা হয়। সকালবেলা বৃষ্টি কমলে লাকমাছড়া ঝর্ণা দেখতে বের হলাম। লাকমাছড়া ঝর্ণা থেকে জল পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করলাম। ভারতের সীমান্তের অনেক কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম, তবু দেখতে পেলাম না। এ এক করুণ নিয়তি! আপনি কিন্নর শব্দ শুনতে পাচ্ছেন কিন্তু দেখতে পারছেন না। এ জন্যই মানুষের তৈরি সীমান্তকে আমার বড্ড অপছন্দ। যদিও ঝর্ণাধারা মানেনি কোনো কাঁটাতারের বেড়া। বয়ে চলে এসেছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই। বলা যায়, একপ্রকার বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করেই।
লাকমাছড়াতে আরও কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছা ছিল। সময়ের অভাবে হলো না। লাকমাছড়া থেকে মোটরবাইকে বিশ টাকা করে নীলাদ্রি লেকে আসলাম। নীলাদ্রি লেকের আরেকনাম শহিদ সিরাজ লেক। এ লেককে অনেকে সুইজারল্যান্ড বলে থাকে। এর রূপ বর্ণনা করার মতো না। এক পাশে সুউচ্চ পাহাড়শ্রেণি। আর মধ্যে মধ্যে সবুজ টিলা। তার মধ্যে লেকের স্বচ্ছ জল। আমার মনে হচ্ছিল, কোনো একদিন যদি কারো ওপর ভীষণ অভিমান করে এসে এই লেকের ধারে বসে এক মনে পাথর ছুঁড়ে মারতে পারতাম। ইশ! তেমন করে কোনোদিন কারো উপর অভিমান হলো না। নীলাদ্রি লেক থেকে পাহাড়গুলো দেখে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল, প্রকৃতি এত সুন্দর কেন!
নীলাদ্রি লেক থেকে নৌকায় ফিরে আসার সাথে সাথে নৌকা বারিক্কা টিলার উদ্দেশে ছেড়ে দিল। পাহাড়ি ঢলের কারণে নৌকার সারেং আগেই বলেছিল যেতে সময় লাগবে। লাগলোও তাই। টানা চার ঘণ্টা নৌকা উজানের দিকে বেয়ে চললো। অনেক দূর থেকেই চোখে পড়লো, দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে ঝর্ণা। আরও কাছে গিয়ে আরও কিছু ঝর্ণা চোখে পড়লো। আমাদের নৌকা বারিক্কা টিলাতে নোঙর করলে আমার হেঁটে হেঁটে টিলার উপরে উঠে পড়লাম। নিচে ভারত এবং বাংলাদেশের সীমানা নির্দেশিত জাদুকাটা নদী। আর টিলা থেকে দেখা যায় মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড়গুলো। একেবারে মেঘের কাছাকাছি। অনেক উঁচুতে ঝর্ণা চোখে পড়লো। এমন এক পাহাড়ের ঝর্ণায় হয়তো অমিত আর লাবণ্য প্রেম করেছিল। হ্যাঁ ‘শেষের কবিতা’র কথা বলছি। শেষের কবিতার সম্পূর্ণ কাহিনিটাই শিলংয়ের। শিলং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। শোনা কথা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি শিলংয়ে বসেই ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসটা লিখেছিলেন।
বারিক্কা টিলা থেকে ফিরে আসতে হলো। এখন ফিরে আসার পালা। কিছু পাথর সংগ্রহ করলাম বাসার টবে ছড়িয়ে রাখবো বলে। সময়ের অভাবে শিমুল বাগান দেখে আসতে পারলাম না। তবে, শিমুল বাগান শীতকালে সুন্দর বেশি। সে সময় শিমুল বাগানে ফুল ফোটে। শেষ করবো টেনিসনের ইউলিসেস কবিতার একটি লাইন দিয়ে, I cannot rest from travel: I will drink Life to the lees.
শেষ করার আগে একটাই প্রত্যাশা, মানুষের যেন একটু বোধোদয় হয়। মানুষ যেন যত্রতত্র প্ল্যাস্টিকের বোতল বা প্ল্যাস্টিক-জাত অন্য কোনোকিছু ফেলে টাঙ্গুয়ার হাওরের দূষণকে ত্বরান্বিত না করে। এটি একটি রামসার সাইট। তাই এর প্রতি আমাদের রয়েছে অসীম দায়িত্ব।
লেখক: প্রভাষক, সরকারি বরহামগঞ্জ কলেজ, শিবচর, মাদারীপুর