ঝুলে যাওয়া বারান্দার অপ্রেম কাহিনি
দেবদুলাল মুন্নাপ্রকাশিত : আগস্ট ২৪, ২০১৯
বারান্দার ওপাড়ে আরেকটি বারান্দা, মানে অ্যাপার্টমেন্টের। এপাড়ে আমার বারান্দা। দুই বারান্দা সমান্তরাল নয়। ওই বারান্দা চারতলায়। এই বারান্দা ছয়তলায়। মাঝে বহে গেছে মহল্লার রাস্তা। ওই বারান্দায় খুব মিলিয়ে তিন বা চারদিন লোকজন দেখেছি। একদিন দেখি, এক সত্তরোর্ধ্ব লোক ইজিচেয়ারে বসে জাম্বুরা খাচ্ছেন, রোদের তাপ নিচ্ছেন, তখন মনে হয় শীতকাল ছিল। কিন্তু শীতকালে কি জামবুরা পাওয়া যায়? আমি কনফিউস। আরেকদিন দেখি, রাস্তা দিয়ে শিলপাটা শিলপাটা ফুটা বলে যখন এক লোক যাচ্ছিল তখন এক নারী হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে ওই লোককে ডাকছিলেন, সেটা হবে কোনো এক রমজান মাসে। কারণ লোকজন ইফতারি কিনে তাড়াহুড়ো করে যে যার মতো গন্তব্যে ফিরছিল। আরেকদিন সম্ভবত, না, কিছু মনে পড়ছে না, কারণ উম্মে গোলাপের সাথে আমার পরিচয় হওয়ার পরই তাকে আমি একদিন ওই বারান্দায় দেখেছিলাম। ঝড় আসছিল। বর্ষাকাল। বারান্দার দড়িতে মেলে দেয়া কাপড়গুলো নিতে এসেছিল। আর বাকিদিনগুলো বারান্দায় কাউকেই দেখিনি। অথচ বাসায় থাকলে আমি বেশিরভাগ সময়ই বারান্দায় কাটাই। বসে থাকি। মানুষের চলাচল দেখি। ছাদের ওপরে ডিশ লাইনের তার, ঘড়ি, নির্মাণাধীন ভবনের অনেক অনেক উঁচু তলায় শ্রমিকের মাটি বা ইটতোলা দেখি।
এই এলাকাটি খুব একটা ভালো না। কিছু হাইরাইজ ভবন উঠেছে। সস্তায় মানুষ ফ্ল্যাট কিনছে বা বাড়ি ভাড়া করে থাকছে। তবে খুব গাছগাছালি আছে। রাস্তাঘাট একটু বৃষ্টি হলেই ডুবে যায়। আমি ফিরছিলাম এক বিকেলে। সেদিনও বৃষ্টিতে ডোবা রাস্তা। সেদিনই প্রথম পরিচয় উম্মে গোলাপের সাথে। তার একহাতে কাঁচা বাজারের প্যাকেট, অন্যহাতে ফাইল, কাগজপত্র। এ এলাকার রাস্তা ডুবে গেলে লোকজন সদর রাস্তা থেকে দশ টাকা রিকশা ভাড়া বিশটাকা দিয়ে আসে। কিন্তু উম্মে কুলসুম হেঁটে হেঁটে ফিরছিলেন। শাড়ির নিচটা ভিজে যাচ্ছিল, কিন্তু তুলছিলেন না, খুব হালকা পায়ে এগুচ্ছিলেন। বাসার কাছাকাছি আসতেই তার হাত থেকে ফাইলসমেত কাগজগুলো পড়ে গেল। পড়ার কারণ ছিল। পেছন থেকে ক্রমাগত বেল আর রিকশাঅলার ‘রিকশা রিকশা’ আওয়াজ। যেন এক্ষুণি না সরলে তুলে দেবে গায়ের ওপর। পরিস্থিতি অমনই।
তো খুব সাধারণ সৌজন্যবোধ থেকে আমি উনার পানিতে ভিজে যাওয়া ফাইল ও কাগজগুলো কুড়িয়ে দেই। চুপসে গেছে সব। তিনিও সৌজন্যবশত বলেন, আমি উম্মে গোলাপ। সিটি কারোনেশন স্কুলে শিক্ষকতা করি। এরপর তার অ্যাপার্টমেন্টের উল্টোদিকের আমার এ্যাপার্টমেন্ট দেখিয়ে বলেন, আপনি তো মনে হয় এই বিল্ডিংয়েই থাকেন?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ি। তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেন।
এসব ঘটনা অন্তত বছর পাঁচ-ছয় আগের। এর মাঝে আমি বাসা পাল্টেছি। অন্য শহরেও পোস্টিং হয়েছে। বছর দুয়েকের মাথায় আবার পুরানো শহরে ফিরেও এসেছি। কিন্তু পুরনো শহর ভেতরে ভেতরে বদলে গিয়েছিল অনেকখানি। এই যেমন, পোস্ট অফিসটা যেখানে ছিল সেটি প্রায়শই বন্ধ থাকে। কলেজ রোড ধরে ভাড়াউড়ার দিকে এগুলে বাঁ পাশের ভিক্টোরিয়া মাঠে সন্ধ্যার পর কেবলই কয়েকটি বৃত্তে বিড়ির আলো জ্বলে। চিত্রালী সিনেমা হলে কেউই আর সিনেমা দেখতে যায় না। এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্তও। হলটি বন্ধ হওয়ার জোগাড়। গুহরোডের যে পাশটায় সিপিবি অফিস ছিল সেখানে একটা এনজিওর সুসজ্জিত অফিস। সন্ধ্যার পরপরই পূর্বাশা মহল্লার রাস্তা দিয়ে তরুণদের বুড়বুড়িয়া চা বাগানে যাতায়াত বেড়ে যায়। বুড়বুড়িয়াতে গজিয়ে উঠেছে বাংলা মদের সস্তা দোকান।
পুরনো অফিসে পুরনো সহকর্মীরাও আর নেই। সবকিছু অচেনা, কেমন জানি, তবু মন্দ লাগে না আমার। কেননা যখন মনে হয় এই শহরেই উম্মে গোলাপ আছে, তখন মন ভাল হয়ে যায়। যদিও জানি দেখা হবে না আমাদের আর কোনোদিন। কিন্তু আমি অফিস ছুটির পর অনেক অলিগলি একা একা হাঁটতাম। ওই রকম একটা বারান্দা খুঁজতাম। যে বারান্দাটা ছিল উম্মে গোলাপদের বাসার। ওই বারান্দা যে দেখার মতো কিছু, তা নয়। খুবই সাধারণ। নির্জন। পাতাবাহার ছিল সম্ভবত। রোদের আভা বিকেলে যেন দোলাতো বারান্দাটিকে ডিঙি নৌকার মতো। রাত হলে ঘরের আলোর এপাশে বারান্দাটা ছিল ক্লান্ত কয়েদির ঘুমানোর আগের যত অবসাদ।
আসলে যেভাবে বলছি এসবই বানানো। এও না বোঝার কথা নয়, মানুষ তার কল্পনার অনেক ছায়া ফেলে দেখে বাস্তবেও। যারা এভাবে দেখে তারা এক ধরনের ন্যাচারালিস্ট রোমান্টিক। তাদের সমস্যা অনেক। অরণ্যে গেলে সত্যজিৎ রায় বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো সাঁওতালি নাচ দেখতে ভাল লাগে। সাঁওতালি মেয়ের পায়ের গোছা দেখে কামনা জাগে। তারা চাপা চাপা লুকানো সত্যগুলো বলে উদাস হয়। এইসব সত্য বলতে তাদের অরণ্য লাগে বা সমুদ্র। শৈশব মনে পড়ে। নক্ষত্রের আলো কেন একভাগ স্থলে পড়ে আর তিনভাগ জলে, এনিয়ে তর্কে মেতে ওঠে। আমি ওমন না। আমার ভরদুপুরেও নদীকে চিলেকোঠায় পেয়ে যৌন বাসনা জেগেছিল। ওর কাঁধে হাত রেখেছিলাম। জড়িয়ে ধরেছিলাম। ওসব তো একটু অরাবীন্দ্রিকই, তাই না?
কিন্তু আমার কাছে বারান্দাটা অন্যরকম। সব বারান্দা নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু উম্মে গোলাপের বারান্দাটা... এর কারণ আর কিছুই নয়, ওই যে বর্ষামুখর সন্ধ্যায় দেখা হয়েছিল, তার ভেজা জিনিসগুলো তার হাতে তুলে দেয়ার আগে বা পরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি উম্মে গোলাপ’ সেই যে বলা সেই যে চাহুনি এরপর লম্বা বেনীকে একপাশে টেনে নিয়ে চলে যাওয়া ওই মূহূর্তটা আমার ভেতর প্রথম একটা বারান্দার ছবি এঁকে দেয়। আমার এক আর্কিটেকচার বন্ধু একদিন আমায় বলেছিলেন, ঘর হচ্ছে ঘর। ঘরের বারান্দা হলেও চলে, না হলেও চলে। তবু ঘরের সাথে বারান্দা লাগে। কেন জানো? ঘরে যখন মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে তখন বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। একটু বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়, আকাশ দেখে, আশপাশ দেখে। কিন্তু বারান্দাতে কেউ ঘুমায় না। ঘরেই ঘুমায়। মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বারান্দা থাকে। ধরেন, আপনি কারো জীবনে বারান্দা। ওইরকম আরকি। আপনাকে ঘর করল না। সেও বারান্দা হয়ে আপনার কাছে এলো না। কিন্তু মাঝে মাঝে ঘরে হাঁপিয়ে উঠলে বারান্দায় মানে আপনার কাছে এসে দাঁড়ালো। তার ঘরের সাথে আপনি সারাজীবন বারান্দা হয়ে ঝুলে রাইলেন। তার ঘর থাকল। সংসার থাকল। বাচ্চাকাচ্চা থাকল। সব থাকল। আপনি অরক্ষিত ঝুলে থাকা বারান্দা হয়েই তার জীবনে থেকে গেলেন।
আর্কিটেকচার বন্ধুর কথাটি আমার মন্দ লাগেনি। কারণ একঅর্থে দীর্ঘদিন থেকেই আমি ঝুলে থাকা মানুষ। যেন কার্নিশে আমার দুহাত শক্ত করে ধরা, পা`গুলো ঝুলে আছে, শুধু ছিটকে পড়ার অপেক্ষা। একঅর্থে আমার ঘরও নেই। যেন উদ্বাস্তু মানুষ। আমি বিশ্বাস করতাম সব সম্পর্কই রাজনৈতিক। কিন্তু বার্লিনে প্রাচীর ধসে পড়ল আর এদিকে ঢাকায় পল্টনে কম্যুনিস্ট পার্টির অফিসে দেয়াল উঠল। আমার মাথার ওপর থেকে ধীরে ধীরে সেই যে ছাদ সরে গেল, মানে ঘরহীন হয়ে গেলাম আমি। একটা বাসা ছিল আমাদের। আব্বা আম্মা ভাই বোন সবাই ছিল। একে একে আব্বা আম্মা মারা গেলেন। দুই ভাই একবোন ইউরোপ আর কানাডায় সেটেলড করল আর ছোট ভাইটা কেন এনকাউন্টারে মারা গেল, জানি না। সে কোনো এন্টি সোশ্যাল ছিল না। তবে থুতনিতে দাড়ি ছিল, নামাজি ছিল। তার লাশের পাশে পাওয়া গেল কিছু ইসলামি জিহাদি বই।
ওই বাসাটিও বিক্রি করে দিয়েছিল আব্বা আম্মা মারা যাওয়ার পর সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে। ওই বাসায় এখন অন্যের বসবাস। আমি দূর থেকে ওই বাসা দুইতিন দিন দেখেছি। আমাকে একজন ভালোওবাসতো। নাম, শ্যামলিমা। আমার কথাগুলো তার খুব স্ববিরোধী মনে হতো। কখনো বলতাম, শরীর শরীরই। শরীরকে স্পর্শ করলেই অপবিত্র হয়ে যায় না। অপবিত্র বা পবিত্র ধারণা বলেও কিছু নেই। আবার দেখা গেল, দুদিন পর বলেছি, ইনটেলেকচুয়ালি কমিউনিকেটেড না করলে তো কোনো নারীর সাথে শোয়ার সম্পর্কই আসে না। এরকম অনেক অনেক কথা। যেমন একদিন বলেছিলাম। আমার মাঝে দেশপ্রেম খুব কম কাজ করে। কারণ জাতীয়তাবাদী হওয়াটাকে আমার কাছে ধার্মিক হওয়ার সামিল মনে হয়।
শ্যামলিমা বিভ্রান্ত হয়েছিল এবং এক সরকারি আমলাকে বিয়ে করে এখন সম্ভবত সুখি জীবন যাপন করছে। মানে ঘর বলতে যদি আশ্রয় বোঝায় তবে একে একে সব আশ্রয়ই আমি যখন হারিয়ে ফেলে জগতের সব অবসাদ নিয়ে বারান্দায় বসে ঝিমুতাম তখনই উম্মে গোলাপের বারান্দা আবিষ্কার করি। পুরনো শহরে কতদিন হলো ফিরে এসেছি, উম্মে গোলাপের বারান্দাটা দেখি না।
এক সাপ্তাহিক ছুটির সন্ধ্যায় আমার মধ্যে কী যে হয়! মনে হয়, কেউ আমাকে ডাকছে। মনে হয়, অপেক্ষা করছে। মনে হয়, পানিতে ঢুবে আছে রাস্তা। চারদিকে বড় বড় গাছ। শান্ত রাস্তা। স্তব্ধ সন্ধ্যা। ওই সন্ধ্যার আলোছায়ায় একজোড়া চোখ দেথা যায়। মনে হয়, ওই চোখের ভেতর থেকে দুটো নীল কালো ভিজে যাওয়া মার্বেল গড়িয়ে পড়ছে। আমি সেই সন্ধ্যায় এরপর আর কিভাবে কি ঘটল কিছুই জানি না। সত্য কখনো কখনো নয়, সবসময়ই গল্পের চেয়ে অবাক করার বিষয়।
আমি দাঁড়িয়ে আছি উম্মে গোলাপের ফ্ল্যাটের দরোজার সামনে। কলিংবেল টিপেছি। তিনি দরোজা খুললে কি বলব আমি? ঘর নেই, একটি বারান্দা হতে চেয়েছিলাম? জানি না। বেল বাজছে। আমি দরোজার এপাশে দাঁড়িয়ে। ওপাশে দরোজা খুলে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধ। সেই সত্তরোর্ধ্ব চোখ, তারও অনেক পেছনে দাঁড়ানো উম্মে গোলাপ। আমি চোখ থেকে যে দুটো মার্বেল পড়ে যেতে দেখেছিলাম ওগুলো দেখি ওই বৃদ্ধের চোখে। অপেক্ষার চোখ আমার আব্বার মতো। আমি কিছু না বলেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে থাকি। ।