জোনাইদ হোসেনের গদ্য ‘ভেঙে যাওয়া একটি ভুল’
প্রকাশিত : আগস্ট ১৭, ২০২১
সত্যেন সেন রচিত ‘মসলার যুদ্ধ’ পড়ে আমার ভেতর ভেঙে যাওয়া একটি ভুলের কথা তুলে ধরি। ভাস্কোদাগামাকে আমরা মোটামুটি সবাই চিনি। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন বইতে এবং সাধারণ জ্ঞানে ভদ্রলোকের কথা এতবার পড়েছি যে তাকে একপ্রকার হিরোর মতোই মনে হতো। তিনিই প্রথম ইউরোপ থেকে এশিয়ায় আসার জলপথ আবিষ্কার করেন।
কিন্তু বইটি পড়ার পরে ভদ্রলোক সম্পর্কে আমার ধারণাই পাল্টে গেল। লোকটি নাকি ছিলেন মূলত জলদস্যু। মানুষ হত্যাকারী। পর্তুগাল থেকে ব্যবসার নাম করে ডাকাতি করার জন্যই এশিয়াতে এসেছিলেন এবং সমুদ্রে হাজার হাজার মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করেন। জাহাজে জাহাজে ডাকাতি করে লুটপাট করেন। বিশেষত মক্কায় হজ্জ করতে যাওয়া হাজিদের কাফেলাতে লুটপাটসহ হাজিদের গলা কেটে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করতেন। লুটপাটকৃত মালামাল জাহাজ বোঝাই করে পর্তুগালে পাঠাতেন। সত্য-মিথ্যা আল্লাহই ভাল জানেন।
যাই হোক, এবার বইটি নিয়ে সামান্য কথা বলি। বইটি একটি ইতিহাসের বই। যেখানে উপমহাদেশে ইউরোপিয়ানদের কলোনি স্থাপনের ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে গল্পের ছলে। খাদ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান মসলা। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় স্পাইস। এই মসলা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় একে একে আগমন ঘটে পর্তুগিজ, ডাস এবং পরবর্তীতে ইংরেজদের।
মসলা ছাড়া কোন খাদ্যই বা ভালো লাগে? জন্ম থেকেই মানুষ ভোজন রসিক। আর মসলা বা স্পাইস এই ভোজনের স্বাদ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। সারা পৃথিবীব্যাপী বিশেষত ইউরোপে মসলার রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার মার্কেট। আর মসলা উৎপাদনের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলো খ্যাতি রয়েছে সারা পৃথিবীব্যাপী। পনেরশো শতাব্দী আগে মসলা ব্যবসা মূলত মুসলমান ব্যবসায়ীরা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করত। স্থানীয় লোকজনের সাথে মিলেমিশে ব্যবসা করত। বিভিন্ন দেশে নিয়ে তারা এই মসলা বিক্রি করত। ইউরোপের বাজারেও তাদের যাতায়াত ছিল।
কিন্তু পর্তুগিজরা চাইল মসলার এ ব্যবসা ইউরোপে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। সেজন্যই বিভিন্ন অজুহাতে অভিযান চালায় ভারতীয় উপমহাদেশে। পাঠানো হয় ভাস্কোদাগামাকে। যুদ্ধবিগ্রহসহ বিভিন্নভাবে মসলা সংগ্রহ করে ইউরোপের বাজারে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের অর্থ লাভ করতে থাকে পর্তুগিজরা। তাদের ব্যবসার লাভ দেখে ডাচরা আর লোভ সামলাতে পারল না। তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইল ইউরোপের সমস্ত মসলার ব্যবসা। ফলে মসলা সমৃদ্ধ ইন্দোনেশিয়ায় তারা তাদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করল। জোর জবরদস্তি করে গরিব কৃষকদের দিয়ে মসলা চাষ করিয়ে, জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে ইউরোপের বাজারে একচেটিয়াভাবে ব্যবসা করতে থাকে।
পরবর্তী পর্যায়ে ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই ব্যবসার দিকে নজর দেয় এবং উপমহাদেশে তাদের আগমন ঘটে। তার পরবর্তী ইতিহাস তো আমাদের সকলেরই জানা। এভাবে মসলা ব্যবসা বা মসলা নিয়ে যুদ্ধের মাধ্যমে এ অঞ্চলে শ্বেতাঙ্গদের আগমনের ঘটনা বইটিতে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অনেক বড় ইতিহাস ছোট করে লেখার কারণে পাঠকের কাছে বইটি সুখপাঠ্য বলেই মনে হবে।
পরিশেষে লেখক সম্পর্কে একটি কথা বলি। সত্যেন সেনের মূল পরিচয় তিনি উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা। ব্যক্তিগতভাবে তার মতাদর্শের সাথে অনেকের সম্পূর্ণ মিল না থাকলেও এ বইটিতে তিনি হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের একটি সুন্দর দিক তুলে ধরেছেন। ইউরোপিয়ানরা যখন এককভাবে উপমহাদেশে তাদের ব্যবসায়িক ও সামরিক নৌযানগুলোকে নোঙর করতে পারছিল না। তখন তারা বিভিন্ন কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে থাকে। এদেশের কিছু মীরজাফরকে ভাড়া করে। তাদের দিয়ে আমাদের জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চায়। সামান্য সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে কিছু মানুষ এ কাজে লেগে পড়ে।
কিন্তু এর মধ্যেও অধিকাংশ মুসলমান ও হিন্দু একসাথে মিলে তাদের বিরোধিতা করে। বিশেষত কালিকট অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলিমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পর্তুগিজদের রুখে দেয়। কোনোভাবেই যেন ইউরোপীয়দের আগমন এ ভুখণ্ডে না হয়, সে চেষ্টা করে। যুদ্ধ করে। জীবন দিয়েছে, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমরা পারিনি রক্ষা করতে আমাদের উপমহাদেশের স্বাধীনতাকে। পারিনি ঐক্যকে দৃঢ় রাখতে। যার কারণে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এই অঞ্চল থেকে জাহাজভর্তি করে সম্পদ ইউরোপে পাচার হয়েছে। গোলামি করেছি কয়েকশো বছর।
বইয়ের নাম: মসলার যুদ্ধ। লেখক: সত্যেন সেন। প্রকাশনী: মুক্তধারা। প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৯। পৃষ্ঠা: ৬৭। দাম: ১২০ টাকা।