জেনি এক্লেয়ারের গল্প ‘তমালিকার কার্ডিগান’

বাঙ্লায়ন: লুনা রাহনুমা

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০

ইংলিশ শিল্পী জেনি এক্লেয়ার, একাধারে কমেডিয়ান, উপন্যাসিকা এবং অভিনেত্রী। জন্ম ১৯৬০ সালের ১৬ই মার্চ। জেনি লন্ডন রেডিও টক্ শোর হোস্ট হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন অনেক বছর থেকে। রেডিও ফোর একবার জেনিকে প্রস্তাব করে রেডিওতে শ্রুতি গল্পের জন্য পনেরো মিনিটের মতো দীর্ঘ কিছু ছোট গল্প লিখতে। সেই প্রস্তাবের পর জেনি লিখে ফেললেন চব্বিশটি ছোট গল্প। আমাদের আজকের এই গল্পটি তার "লিসেনিং ইন" বইয়ের প্রথম গল্পের ছায়া অনুবাদ।


চ্যারিটি শপে ঢোকার সময় পেছন থেকে লক্ষ্য করলাম ওকে।

আগে সব সময় দেখতাম সেজে গুঁজে পরিপাটি হয়ে থাকতো। আজকেও পড়েছে সেই অনেক বছর আগের হালকা গোলাপি রঙের কার্ডিগানটি —বুকে চিতা বাঘের ছাপ, কলারে সৌখিন কাজ করা বোতাম। আমার মাথার পেছনদিক টা ঝিম করে উঠলো, ঠিক যেমন লাগতো ডাক্তার আমাকে লো ব্লাড প্রেসারের ওষুধ না দেয়া পর্যন্ত।

 

সামনে গিয়ে বুঝলাম এটা তমালিকা তালুকদার না। নির্লিপ্ত হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানের প্লাষ্টিক পুতুল যাকে তমালিকা তালুকদারের পোশাক পরানো হয়েছে। তমালিকা তালুকদারের সেই দামি ব্র্যান্ডের কালো হাত ব্যাগটি ঝুলছে ওর কিঞ্চিৎ বাঁকানো হাতে। মনে হচ্ছে যেন তমালিকা তালুকদার গত সপ্তাহে বাস থেকে পড়ে হাত ভেঙে ফেলেছে।

 

আমি চ্যারিটি শপে গিয়েছিলাম চায়না কাঁচের পাখি খুঁজতে। আমার বোন বিয়ের সময় একজোড়া চায়না কাঁচের পাখি উপহার দিয়েছিল। সেটাতে আমার আর আমার বরের নাম লেখা ছিল। সাথে সুন্দর শুভেচ্ছা আমাদের জন্য। আর সেই থেকে আমিও আটকে গেছি চায়না কাঁচের পাখির খাঁচায়।


উহু ভাববেন না যে, আমি পাখি দেখলেই পাগল হয়ে যাই। বরং খুব সাবধানে খুঁজে খুঁজে বের করি আমার পচ্ছন্দের পাখিদের। কয়েক বছর আগেও আমার কাছে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র পাখি ছিল। আর এখন আমার বসার ঘরে একটা দেয়াল পুরোটা ভরে গিয়েছে চায়না কাঁচের পাখি দিয়ে। আমি নকল কাঁচের পাখি কিনি না, আর ভাঙা ফাটা থাকলেও না।


আমি মনে করি সব মানুষের একটা কিছু শখ থাকা ভালো — তাতে নিজেকে অনেক বদ অভ্যাস থেকে দূরে রাখা যায় ।


প্রায় পঞ্চাশ বছরের বিবাহিত জীবন আমাদের। আমার আর জলিলের। আমাদের পরিচিত জনেরা বেশ অবাক হয়েছিল আমাদের বিয়ে করতে দেখে । কারণ আমি ছিলাম খুব উচ্ছল-চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে আর জলিল অতিরিক্ত শান্ত - কথা কম বলা মানুষ। নিজেকে আমি কয়েক ধাপ নামিয়ে নিয়েছিলাম জলিলের সাথে মানিয়ে নিতে।আমি জানতাম জলিলই আমার জন্য উপযুক্ত পুরুষ হবে।

 

সে ধুমপান আর মদ্যপানে সংযত, গাড়ি আস্তে চালায়, আর মানুষ হিসেবে খুব বোরিং। কিন্তু সত্যি কথা বলতে যে আমি কখনো আমার মায়ের মতো জীবন চাইনি। সেই জীবন, যেখানে প্রতি শুক্রবার রাতে স্বামী স্ত্রীর গলা ফাটানো ঝগড়া চলে ঘন্টার পর ঘন্টা। বাচ্চাদের সাজু বা নাজু খালার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয় যাতে তারা মারাত্মক অশালীন সেই বাক্যালাপের শ্রোতা না হয়। আর রাতে ওরা যেন ঘুমোনোর আগে কিছু খেতে পারে অন্তত।

 

আমি আমার জীবনে নিরাপত্তা চেয়েছিলাম, কোন হঠাৎ চমক চাইনি সংসারে। তবে অবশ্য আমি চাইলে জলিলের সাথে হইচই তর্ক করতে পারতাম মাঝে মধ্যেই ওর নানা রকম বদঅভ্যাসের কারণে। যেমন গোসলের সময় গোটা বাথরুম ভিজিয়ে ফেলতো সে। পানি খাবার সময় গলার ঢক ঢক শব্দ শোনা যেত পাশের ঘর থেকেও। কিন্তু আমি সব কিছু গিলে গেছি নি:শব্দে।

 

দুই হাতে ঘরের সব কাজ একাই করতাম। আমাদের একটি খুব লক্ষী বাচ্চা ছিলো যে কখনো কোন কষ্ট দেয়নি আমাকে। এখনো প্রতি মাসে দুই বার আসে আমাদের সাথে দেখা করতে। শহরের আরেক মাথায় ওর নিজের সংসার। যদিও ওর বৌটা একটা ডাইনি।

 

আমার বোন আমার সাথে চ্যারিটি শপে আসতো সব সময়। গত বছর মারা গেছে সে। ওর কথা খুব মনে হয় আমার। আমি আমাদের দুই বোনের ছোট বেলার কথা ভাবি প্রায়ই। খুব মন খারাপ হয় আমার সেইসব দিনের কথা মনে হলে। কিন্তু মন যতই খারাপ হোক না কেন নিজেকে আমি ঘরের কোনায় লুকিয়ে রাখি না। প্রতিদিন বাইরে যাই। সবার সাথে যোগাযোগ রাখি নিয়মিত।

 

তাছাড়া সারাদিনবাড়ি বসে কতক্ষণই বা টেলিভিশন দেখা যায়। ঘুম পায় আমার টিভির ঐসব বোকা প্যাঁচাল শুনলে। বেশি অসহ্য লাগে আলোচনামুলক অনুষ্ঠানগুলো।

 

টেলিভিশনের জ্ঞানী লোকগুলো মনে করে তারা সব জানে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে মেয়েরা ওসব ভারী ভারী গবেষনা টাইপ জ্ঞানে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। তারা জীবনমুখী আলোচনায় বেশি আগ্রহী। কিভাবে পায়েস রান্না করলে দুধ ফাটে না, কোন ফোরনে রসুনের আচার ভালো সুবাস ছড়ায়, বাচ্চার গলায় আঙ্গুর আটকে গেলে পিঠে থাপ্পড় দিয়ে দ্রুত বের করার উপায়, এই সব।

 

সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই হয়তো কিন্তু আমি আমার চোখ দুটো দিয়ে চারপাশে যা দেখি, এই দেখা খুব পরিষ্কার বাস্তবচিত্র এঁকে দেয় আমার সামনে। আমি মনে করি আমার মাথার পেছনেও দুটো চোখ আছে।ঠিক যেই কারণে, বিশ বছর আগে, তমালিকা তালুকদারের নিষ্পাপ মুখকে বিশ্বাস করিনি আমি। পারলে পায়ে পিশে মেরে ফেলতাম ওকে তখনই।

 

তার কারন, অন্য আরেকটি অনুভূতি আমাদের মেয়েদের থাকে — সহজাত প্রবৃত্তি। সোজা কথায় বাতাসে বিপদের গন্ধ পাওয়া। এই গুণের কল্যানে আমরা দুইয়ের সাথে দুই মেলাই আর পরিষ্কার দেখতে পাই আসন্ন সর্বনাশ।

 

জলিলের এসব কিছুই ছিলো না। সে কখনো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আবহাওয়া বোঝার চেষ্টা করতো না। বাতাসে গন্ধ শুকে বলতে পারতো না একটু পর বৃষ্টি হবে কি না। জলিল পত্রিকার পাতা খুলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পড়ে ফেলতো। ওর ভরসা ছিল শুধু বিজ্ঞান, যন্ত্রপাতি আর অভিজ্ঞতার উপর।

 

আমি ওর মতো নই। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায় বরফ পানির ঠান্ডা অনুভূতি, আমার ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে উঠে, হঠাৎ তামাটে স্বাদ আঁশটে করে দেয় আমার জ্বিভের উল্টো দিকটা।

 

আজকাল আমি খুব সহজেই বলে দিতে পারি বাতাস কোন দিকে বইছে। অনেকটা খরগোশের মতো। ওরা যেমন সুগভীর চিন্তা করে প্রতিটি লাফ দেয়ার আগে, বহুবার উঠে আর বসে আর ভাবে। তেমনি বিপদের সুক্ষ্মতম আভাসের গন্ধ শুকতে পারে আমার তীক্ষ্ণ নাসিকা। বোধহয় শৈশবে অসুখী পরিবারে বেড়ে উঠার কারনে আমি দরোজার ছোট্ট ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে আসা সামান্য মন বেজারের খেলা দেখে বুঝে নিতে পারি ঠিক কখন দমকা হাওয়া এসে দুমরে মুচড়ে গুড়িয়ে দেবে আনন্দের বিকেল। শৈশবেই আমি শিখে গিয়েছিলাম নিজেকে কিভাবে আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হয়। এতটা আড়ালে যে দেখাই যায় না। আমি গোপন ছায়ার মতো দরোজার কাঠে ঝুলে থাকতাম, সব কিছু শুনতাম আর দেখতাম শুধু।

 

আমি আমার চারপাশের সব কিছু পর্যবেক্ষণ করতাম।

 

জলিল কিছুই লক্ষ্য করতো না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি সকালে ওর অফিসের কাপড়ের উপর এক জোড়া টকটকে লাল মোজা রেখে না দিতাম। “মমতা, লাল মোজা কেন! লাল মোজা পরবো না।" ওর শুধু সাদা মোজা পছন্দ ছিলো। এক ফোঁটা ও মাংস থাকা যাবে না কিছুতে।

 

“বেশি ভোলাভালা স্বামীর দিকে নজর রাখতে হয় কড়া” — আমার বোন বলতো আমাকে। তারপর নিজে অনেক বেছে এমন এক লোককে বিয়ে করেছিল যে বকবক করতে করতে দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানিয়ে ফেলতো। সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে অনেক টাকা জমিয়েছিল আমার দুলাভাই। আমার বোন বলতো, বিলেতের মাটিতে নিজের নামে একটা বাড়ি থাকা খুবই আনন্দের বিষয়।

 

আমার পছন্দ গহনা। সম্ভবত শৈশবে আমাদের সাজ গহনার কিছু ছিলো না বলে। যা কিছু আমার মার পছন্দ ছিলো সে সব কিছুই ভেঙে ফেলতো লোকটা। মা ভেঙে ফেলা গহনাগুলো গুলো দিয়ে জোড়া দিতে বসতেন। আঠা বা গ্লু দিয়ে কোন কিছু জোড়া লাগানোর ধৈর্য্য আমার নেই। আমি জানি বার বার আহত হওয়া ভাঙ্গা গুলো  সাময়িক জোড়া দেয়া গেলেও একটি গভীর গোপন দাগ তাতে থেকেই যায় ভেতরে কোথাও।

 

আমি পুরনো জিনিসের দোকান ঘুরে ঘুরে সস্তায় ভালো জিনিস খুঁজি। আমার ছেলে বলে, "মা তুমি এই সব কিছুই ইন্টারনেটে কিনতে পারো ঘরে বসে।"

 

ছেলে আমাকে একটি আই প্যাড কিনে দিয়েছে, কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তাও দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার কাছে ভালো লাগে না। কোনো রোমাঞ্চ নেই এতে। আমি নিজে খুঁজে আবিষ্কার করতে ভালোবাসি। দুই চোখ দিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজি পুরনো জিনিস পত্রের দোকান এবং হঠাৎ মাঝে মধ্যে মিলে যায় ভালো কিছু। বলি ইউরেকা।

 

আজ দোকানের বাইরে থেকে একটা চায়না গ্লাসের পাখি দেখে ভেতরে ঢুকে ছিলাম। পাখির ঠোঁট দুটো কি সুন্দর রুপোলি রং করা। বেশি আগ্রহ দেখানো যাবে না। নিয়ম হচ্ছে এমন একটা ভাব দেখতে হবে যেন পাখিটি আমার খুব একটা পছন্দ হয়নি। ঠিক সেই সময় আমি তমালিকা তালুকদারের প্লাস্টিক মূর্তিটি কে দেখি। আর দোকানের আয়নায় দেখি আমার ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া বিবর্ণ মুখ।

দোকানের মেয়েটি আমাকে দেখে এগিয়ে এলো।


"খুব সুন্দর রং, তাই না?"


"কাশ্মীরি", তার মোটা সহকর্মীটি বলে উঠে।

"এ রকম আরো অনেকগুলো কার্ডিগান আছে আমাদের কাছে।"

"আমরা অল্প কিছু কাপড় সামনে রাখি, ভেতরে আরো অনেক আছে।"

"দোকানে ভীড় লেগে যাবে সব একসাথে সামনে আনলে।"


মনে হয় মেয়ে দুটো একসাথে পর পর এক কথা বলতে অভ্যস্ত। একজন থামলেই অপরজন কিছু বলছে। রেল গাড়ির মতো।

 

আমি অন্য কিছু কাপড় নেড়ে চেড়ে আবার কার্ডিগানটি হাতে নিলাম। লেবেল পড়লাম, ১০০% কাশ্মীরি। বাচ্চাদের পায়ের আঙুলের মতো হালকা গোলাপী রঙ। কোনটা নেবো বুঝতে পারছি না। ১২০০ টাকা দাম।

 

"ম্যাচিং জুতা ও আছে আমাদের কাছে।"

"খুব ভালো কোয়ালিটি।"

"কিন্তু ও জুতা পড়তো ৬ নাম্বার," আমি বললাম, "আমি তো পড়ি ৫ নাম্বার --- "

"তাই তো", মেয়েটি বলে।


বুঝলাম মেয়ে দুটি আমার কথা শুনছে না।


একজন টেবিলের নিচ থেকে টেনে একটি প্লাস্টিকের বাক্স বের করলো।


বলে, "কিছু দারুন গহনা আছে।"


বাক্সে কয়েকটা মালা, ইমিটিশন চুরি, চুলের ক্লিপ। ভালো কিছু না।


"কেউ বাড়ি বদল করছে নাকি?" আমি জিজ্ঞেস করলাম হালকা করে।


ব্যাস, আবার চালু হয়ে গেলো দুজনের কথার রেলগাড়ি।


"ঠিক তা না।"


"ভদ্র মহিলা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো।"


"এখন মানবিকা নার্সিং হোম আছে।"


"তার ছেলে বাড়িটা বিক্রি করে দিচ্ছে।"


"ছেলে এখানে থাকে না তো, তাই।"


আমি হালকা গোলাপি রংঙের কার্ডিগানটি কিনলাম।


জানি এটা আমার একটু টাইট হবে। তমালিকার সাইজ ছিল ১২, ও আমার থেকে আরেকটু বেশি শুকনো আর অনেক বেশি লম্বা ছিল। পাখি নিয়ে আজ আর মাথা ঘামালাম না। বাসে করে চলে গেলাম মানবিকা নার্সিং হোমে। নার্সিং হোমটি মানুষে গিজ গিজ করছে যেন। তমালিকার নাম বলতেই আয়া আমাকে তমালিকার রুমে নিয়ে গেলো। আমি তমালিকার বন্ধু না হয়ে খুনিও হতে পারতাম।


তমালিকা শুয়ে আছে নার্সিং হোমের একেবারে পেছনের দিকের ছোট্ট একটি কামরায়। এখানে আমি আগেও এসেছি, আমার পরিচিত একজনকে দেখতে।

 

তমালিকা ঘুমাচ্ছে সাদা চাদর আর সাদা কম্বল গায়ে দিয়ে। আমি ওর খাটের পাশে একটি চেয়ার টেনে বসলাম। তমালিকা খুব আস্তে নিঃশাস ফেলছে। এতো আস্তে যে হঠাৎ মনে হচ্ছে .... কিন্তু বেঁচে আছে, কারণ ওর বুকের কাছে কম্বল টা কয়েক সেকেন্ড পর পর সামান্য ফুলে উঠছে।


এরপর আমরা কথা বলতে থাকি। নাকি আমি একাই বলছিলাম!


আমি তমালিকাকে বাইরের পৃথিবীর আলো বাতাসের কথা বলি।আজ চ্যারিটি শপে কেমন সুন্দর চায়না গ্লাসের পাখিটি দেখেছি সেই গল্প করি। তারপর ওকে জানালাম যে ওর ছেলে এখন ওর বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছে। মনের আনন্দ চেপে কণ্ঠে করুনার সুর ঝরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি এই নার্সিং হোম একলা পরে আছো কেন?"


গর্বের সাথে বললাম, আমার ছেলে মৃত্যুকালে অবশ্যই আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে রাখবে। যদিও ওর স্ত্রী হয়তো পছন্দ করবে না সেটা।


কিন্তু কিচ্ছু না।


তমালিকা মুখটি পর্যন্ত ফেরালো না।


আমি জানতাম তমালিকা এই ঘুমের ঘোর থেকে জাগরণের সচেতনায় আর আসবে না। তাই আমি কথা বলতে বলতে ওর লকারের কাছে গেলাম।

 

নার্সিং হোমে সবার একটা করে লকার থাকে। একটি লকার আর একটি আলমারি। বাচ্চাদের বোর্ডিং স্কুলের মতো।লকারের ভেতর আমি সহজেই পেয়ে গেলাম বাক্সটি। বাক্সটি কেউ সরিয়ে ফেলেনি তখনও। বাক্সের ভেতর একটি বিয়ের আংটি, দুগাছি মুক্তোর মালা, ম্যাচিং কানের দুল। আর একটি সোনার ব্রেসলেট। ব্রেসলেটটি ২৪ ক্যারট সোনার, খুব সাধারণ ডিজাইন, মাঝে রুবি আর ছোট্ট হীরে বসানো।


ব্রেসলেটটা খুব সহজেই আমার হাতে ঢুকে গেলো। আমি সেটাকে ঠেলে জামার ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর নার্সিং হোম থেকে বের হয়ে বাস স্টপে এসে বাসে না উঠা পর্যন্ত টান টান হয়ে থাকলাম।


আজ ভেবেছিলাম বাড়ি ফেরার পথে মাছ কিনব। তারপরই মনে পড়লো কার্ডিগানটি কিনতে কতগুলো টাকা খরচ হয়ে গেছে আজ। তাছাড়া মাছ না কিনলেও চলে। গতকালের রান্না করা মাংস আছে ফ্রিজে। জলিল বাসি খাবার দিলে রাগ হয় না। ও খুবই সহজ সরল মানুষ। কখনো কোন যন্ত্রনা দেয়নি আমাকে। শুধু সেই একবারটি ছাড়া।


সেই সময় পুরো ঘটনাটি আমি আমার নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছিলাম। এখন ভাবলে মনে হয় তখন আমি সিনেমা দেখছিলাম।

প্রথমবার যখন ওদের দেখলাম,ওরা একসাথে কফি খাচ্ছিলো জলিলের একাউন্টেন্সি ফার্মের পাশে একটি কফি শপে।


আমি ওদের সন্দেহ করিনি।


ভেবেছিলাম কোনো ব্যবসায়িক আলাপ করছে হয়তো। হয়তো সদ্য স্বামী মারা যাওয়া মহিলাকে সরকারি টাকা পেতে সাহায্য করছে জলিল।


কিন্তু তারপর থেকে সবখানেই দেখতে লাগলাম মেয়েটিকে।


শাড়ির দোকান, পাবলিক লাইব্রেরির ক্যান্টিন, রাস্তার ধরে একসাথে দাঁড়িয়ে চা খাওয়া। তারপর একদিন রফিকের মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে । এক কোনে জলিলের ঠিক পাশে। আমার মনে হলো কফি দেয়ার সময় জলিল তমালিকার ডান হাতে হালকা চাপ দিলো। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, ওরা হাত ছেড়ে দিলো আবার।


ঘটনাগুলো এতো দ্রুত ঘটে যাচ্ছিলো যে আমার মনে ভয় হচ্ছিলো সব আমার মনের কল্পনা না তো! কিন্তু তার কদিন পর আমি জলিলকে গ্রীন স্ট্রিটের একটি সোনার গহনার দোকানে দেখে ফেলি ঈদের ঠিক ক`দিন আগে।


মনে মনে ভাবলাম, "অপদার্থ, তুমি এইখানে কি করো!”


রাস্তার ফুটপাতে আঠার মতো আটকে থাকলো আমার পা আর অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম দোকানের দিকে।দেখলাম দোকানির হাত কাঁচের সেলফ থেকে চিকন একটি ব্রেসলেট বের করে আনলো।


দোকানদারকে ব্রেসলেটটি আর ফেরত রাখতে দেখলাম না সেলফে।


জলিল দোকান থেকে বেরিয়ে আসে একটু পর। মুখে অপরাধীর চাহনি। সেকেন্ডের ভগ্নাংশেরও কম, সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো আমার সামনে।


আমি দৌড়ে গিয়ে তখন আমার বাবার কাছে নালিশ করতে পারতাম।


অনেক গুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে বেহুস হয়ে যেতে পারতাম।


জলিলের কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দিতে পারতাম।


কিন্তু আমি এসব কিছুই করিনি। অনেক ভেবে চিন্তে একটা বুদ্ধি বের করলাম আর প্রতিদিন তা অল্প অল্প করে বাস্তবায়ন করতে লাগলাম।


পরদিন থেকে আমি জলিলের সাথে মাত্রাতিরিক্ত আহ্লাদী হয়ে উঠলাম। রোজ খুব যত্ন করে রান্না করি ওর পছন্দের খাবার। বাড়ি ঘর ধুয়ে মুছে ছবির মতো পরিপাটি করে রাখি। রাতে ঘুমাবার আগে নানান মানুষের ডিভোর্সের গল্প শোনাই জলিলকে। বাবা মায়ের ডিভোর্সের পর তাদের প্রিয় সন্তানদের জীবন কেমন করে বরবাদ হয়ে গিয়েছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা শোনাতে লাগলাম। মনে করিয়ে দিতে ভুলতাম না যে আমাদের মিষ্টি ছেলেটি কত সৌভাগ্যবান, ওর বাবা মা একসাথেই থাকে। পরীক্ষার হলে বসে টেনশনে বা দুঃশ্চিন্তা করে পরীক্ষা খারাপ করার কোনোই কারণ নেই আমাদের ছেলের।


হঠাৎ করে বিছানায় আমি জলিলের থেকে আরো বেশি আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকি। সেই কয়েকটি মাস আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছি জলিলকে আটকে রাখতে। প্রতিটি মুহূর্ত ওর আশেপাশে থাকতাম। দুপুরে ওর অফিসে চলে যেতাম একসাথে লাঞ্চ করতে। অসম্ভব করে দিয়েছিলাম অন্য কারো সাথে একটি সেকেন্ডও পার করা। ছায়ার মতো সেটে ছিলাম লোকটার পাশে পাশে।


এবং, সত্যি একসময় ওরা দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পরে, ক্ষান্ত দেয় সাক্ষাত অথবা গোপন অভিসারের সকল চেষ্টা।


তমালিকা তালুকদার মিলিয়ে যায় আমার দৃষ্টি, আমার স্বামী ও আমার সংসারের দৃশ্যপট থেকে।


পরে শুনেছি তমালিকা স্পেনে চলে গিয়েছে ওর খালাতো ভাইয়ের কাছে। গুজব আছে যে স্পেনের বাতাস ওকে বেশি মানিয়েছে। ইংল্যান্ড আসে কয়েক বছরে একবার।


প্রতিদিনের মতো আজ রাতেও খাবার পর আমি আর জলিল এক সাথে সোফায় বসে টিভি দেখছিলাম। টিভি দেখলে আমরা সাবটাইটেল অন রাখি কারণ আমরা দুজনেই এখন কানে কম শুনি। রাতে টিভি দেখার সময় জলিল কিছুক্ষন আমার হাতটা ধরে বসে থাকতে পছন্দ করে।


যদিও আমরা সারাক্ষন গায়ের সাথে লেগে থাকা দম্পতি নই। যখন তখন জড়িয়ে ধরি না একে অপরকে। কিন্তু আমরা একটা টান অনুভব করি একে অন্যের প্রতি। জলিল আমার কার্ডিগানের হাতটায় এমনভাবে ওর আঙ্গুল নাড়তে থাকে যেন আমার হাতটি ওর পোষা বেড়াল। হঠাৎ করে ওর আঙুলে আমার ব্রেসলেটটি আটকে যায়।


জলিল আমার হাত উঁচু করে ব্রেসলেটটি বের করে আনে চোখের সামনে। চশমার কাছে নিয়ে ভালো করে দেখে। একটু বিব্রত দেখায়  জলিলকে।


"এটা কি নতুন কিনেছো?"

আমি বললাম, "হ্যা গো হ্যা, এটা আমার ৫০তম বিয়ে বার্ষিকীর উপহার। তুমিই দিয়েছিলে।"

আমি ফ্রিজ খুলে পায়েসের বাটি বের করলাম। আমাদের দুজনের জন্য দুটি বাটিতে পায়েস নিলাম অল্প করে।

পায়েস খেতে খেতে জলিল আবার আমার হাতের ব্রেসলেটটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

আবার প্রশ্ন করলো, "এটা কি নতুন?"

আমি আজ  ওকে যা খুশি তাই বলতে পারি। আমার কোন কথাই জলিলের মনে থাকবে না বেশিক্ষণ।

পাঁচ বছর আগে আমার স্বামী বাড়ির ছাদ পরিষ্কার করতে গিয়ে মই থেকে পা পিছলে পড়ে যায়। তখন থেকে ওর শারীরিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে, স্মৃতিশক্তি মারাত্বকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে।

আমি জলিলকে ভালোবাসি। যদিও ওর মস্তিকে একটা বড় ফাটল আছে এখন, কোন পরিমান গ্লু ই ওকে পরিপূর্ণ পুরুষ বানাতে পারবে না আর ।

আমি ওকে যা ইচ্ছে তাই উত্তর দিতে পারি। কিছুই মনে থাকবে না ওর।

আমার মনে হয় তমালিকার কথাও জলিলের মনে নেই এখন আর।

কিন্তু আমার মনে আছে ।


(সমাপ্ত)