জেনগল্প

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৮

আনুগত্য

জেনগুরু বাংকেই এর বাণী শুধু জেনবাদের ছাত্র বা সংশ্লিষ্ট লোকজনদের মাঝেই প্রিয় ছিল না, বরং তার ‘কথা’ সব ধরণ ও মতবাদের মানুষের কাছে অতি পছন্দের ছিল। উনি কোনোরকম ধর্মীয় মন্ত্র পড়তেন না না কিংবা কোনো লিখিত প্রবন্ধও পড়তেন না। বরং তার মুখের কথা, তার নিজের হৃদয় থেকে শ্রোতার হৃদয় পর্যন্ত বহমান হাওয়া বা ঢেউয়ের মতো গড়িয়ে পড়ত।

এদিকে নিচিরেন* তরিকার কিছু জেনবাদী বাংকেই এর উপর বিরক্ত ছিল, কেননা তারা জেনবাদের বিশুদ্ধ বয়ান শুনতে চায়। নিচিরেন তরিকার এক পণ্ডিত বাংকেই এর সাথে তর্ক করার জন্যে মঠে এসে হাজির হলেন। তিনি বললেন, ‘হে জেনগুরু, এক মিনিট থামেন। অন্য জেনবাদীরা যারা আপনাকে সম্মান করে তারা আপনি যা বলেন তা শুনতে পারে, কিন্তু আমার মতো লোকের পক্ষে আপনাকে মানা সম্ভব না। আপনি কোনোভাবে এমনকিছু করতে পারেন বা বলতে পারেন যাতে আমিও আপনাকে মেনে চলি, আপনার কথা শুনি…’

বাংকেই বললেন, আমার পাশে আসো, আমি তোমাকে দেখাচ্ছি।
লোকটি ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলো। বাংকেই বললেন, ‘উঠে আসো। এসে, আমার বামপাশে বসো।’ লোকটি উঠে এসে বামপাশে বসলো।

বাংকেই বললেন, ‘না। সবচে ভালো হয় তুমি ডানপাশে এসে বসলে। এতে আমরা আরো ভালোভাবে মনযোগ দিয়ে কথা বলতে পারি।’ লোকটি ডানপাশে এসে বসলো।

বাংকেই বললেন, ‘দেখো, এখন পর্যন্ত আমি যা যা বলেছি, তুমি তাই তাই করেছ। আমার মনে হয়, তুমি একজন আদি ও আসল ভদ্রলোক। এখন দয়া করে সবাই যেখানে বসেছে, সেখানে গিয়ে বসো এবং আমি কি কই মনোযোগ দিয়ে শোন।’

এক কাপ চা

মেইজি যুগে নান-ইন নামে এক জেন সাধু ছিলেন। জেন সম্পর্কিত জিজ্ঞাসাগুলি জানতে তাঁর কাছে এলেন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। নান-ইন তাঁকে চা খাওয়ানোর জন্য বসালেন। কাপে চা ঢালতে শুরু করলেন এবং কাপটি পুরোপুরি ভরে গেলেও ঢালতেই থাকলেন। প্রফেসর সাহেব ব্যাপারটি লক্ষ্য করলেন। ‘ওটা পুরোপুরি পরিপূর্ণ। আর একটুও চা ওতে ধরবে না।’
‘ব্যাপারটা এই কাপটির মতোই’ নান-ইন বললেন। তিনি আরো বললেন, ‘আপনার নিজস্ব মত আর চিন্তা দিয়ে আপনি পরিপূর্ণ। কিভাবে আমি আপনাকে জেন সম্পর্কে বলবো, যতক্ষণ না আপনি আপনার কাপ খালি করছেন।’

স্বর ও অনুভূতি

বাংকেই এর মৃত্যুর পর এক অন্ধ শিষ্য যিনি মঠের পাশে বাস করতেন, এক বন্ধুকে বলছিলেন, ‘যেহেতু আমি অন্ধ, আমি কারও মুখ দেখতে পাই না; আমাকে তাই একটা মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে হয় মানুষটির ‘কণ্ঠস্বর’ শুনে। বেশিরভাগ সময়েই, আমি যখন কাউকে কোনো সফলতা কিংবা সুখকর ঘটনার জন্য অভিনন্দন জানাতে শুনি, এই কণ্ঠের পাশাপাশি আমি একটা ‘অহংকার’ এর গোপন কণ্ঠও শুনতে পাই। যখন ‘সমবেদনা’ জানানো হয় কারো দুর্ভাগ্য কিংবা খারাপ সময়ে, আমি ‘সন্তুষ্টি আর অন্তর্নিহিত আনন্দ’ শুনতে পাই পাই কণ্ঠস্বরে। এটি সত্যিকার সমবেদনা হলে, আক্রান্ত ব্যক্তিটির অন্তর্জগতে এক পরিবর্তন আনে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাংকেই এর কণ্ঠস্বরে সমসময়ই ছিলো আন্তরিকতা আর আনুগত্য। যখন তিনি ‘সুখানুভূতি’ প্রকাশ করতেন, আমি ‘সুখানুভূতি’ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেতাম না; আর যখন তিনি ‘দুঃখ’ কে বর্ণনা করতেন, আমি ‘দুঃখ’ ছাড়া আর কিছুই শুনতাম না।’

ধনাগার

দাইজু একদা চীনে গিয়ে জেনগুরু বাসোর সাথে দেখা করলেন। বাসো জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী খুঁজছ?’ দাইজু জবাব দিল, ‘আলোকিত অন্তরলোক।’
তোমার নিজেরই ধনভাণ্ডার আছে। তুমি বাইরে বাইরে কী খোঁজ?
দাইজু জানতে চাইলেন, কোথায় আমার ধনভাণ্ডার?
বাসো উত্তর দিলেন, তুমি যা জানতে চাইছ, সেটাই তোমার ধনভাণ্ডার।
দাইজু তৎক্ষণাৎ বোধি লাভ করলেন।

এরপর দাইজুকে তার বন্ধুসমাজে বলতে শোনা যেত, নিজের ধনভাণ্ডারটি খোলো এবং আপন ধন কাজে লাগাও।

অ, তাই নাকি

জেন গুরু হাকিউন একদম খাঁটি ও নিষ্পাপ একটা জীবন যাপনের জন্য তাঁর প্রতিবেশীদের কাছে খ্যাত ছিলেন। তাঁর বাড়ির খুব কাছেই এক রুপবতী যুবতী থাকতো যার বাবা একটি খাবারের দোকান চালান। হঠাৎ করে, কোনো ঘটনা দুর্ঘটনা ছাড়াই মেয়েটার বাবা-মা আবিষ্কার করলেন তাঁদের মেয়ের শরীরে একটা শিশু বাস করছে। এতে মেয়েটির বাবা মা খুব ক্ষেপে গেলেন। চাপের মুখে মেয়েটি কিছুতেই কারো নাম বলে না। অবশেষে অনেক চাপাচাপি ও নির্যাতনের পর মেয়েটি হাকিউনের নাম বললো।

ক্রোধে জ্বলতে জ্বলতে মেয়েটির বাবা-মা হাকিউনের কাছে গেলেন। রাগে গজগজ করতে করতে মেয়েটির বাবা সব বলে গেলেন। জেন গুরু হাকিউন সব শুনে নির্বিকারভাবে বললেন, অ, তাই নাকি?

শিশুটির জন্মের পর তাকে হাকিউনের কাছে আনা হলো। শিশুটি এখানেই বেড়ে উঠতে লাগলো, তাঁর সাথে। ইতিমধ্যে হাকিউন তার সমস্ত সুনাম হারালেন। তাঁর প্রতি মানুষের সমস্ত বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেল। যদিও এগুলো তাঁর কোনো সরাসরি সমস্যার কারণ হলো না। আর হাকিউন যত্নের সাথে শিশুটির লালন পালন করতে লাগলেন। তিনি তাঁর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে দুধ এনে শিশুটিকে খাওয়াতে লাগলেন।

কয়েক বছর এভাবে চলে যাবার পর, সেই কুমারী মাতা আর নিতে পারছিলেন না; আত্মপ্রবঞ্চনার বোঝা। অতঃপর সে তার বাবা-মায়ের কাছে তার সন্তানের প্রকৃত পিতার নাম বলে দ্যায় যে, সেই লোকটি হলো একজন যুবক যে মাছবাজারে কাজ করে।

এরপর মেয়েটির বাবা-মা হাকিউনের কাছে গেলেন, তাদের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এবং শিশুটিকে ফেরত চাইলেন। সব শুনে হাকিউন শিশুটিকে ফেরত দিতে দিতে নির্বিকারভাবে বললেন, অ, তাই নাকি?

ইংরেজি থেকে বাঙ্লায়ন: গ্যাব্রিয়েল সুমন