জীবনের শেষ আয়োজন
এমরান মাহমুদ প্রত্যয়প্রকাশিত : নভেম্বর ১৬, ২০২০
তখন দুপুর। সূর্য তার হলদে রোদের তেজ ছড়িয়ে দিয়েছে। রাহাত চৌধুরী উঠানে চেয়ার পেতে বসে প্রকৃতির প্রখরতা দেখছে। আর বাতাসের সাথে আলিঙ্গন করছে নিজের শরীর ও মন। গ্রামে একটু হলেও প্রভাব আছে রাহাত চৌধুরীর। ছাত্র জীবন থেকে সে ভেবেছে দেশ ও জাতির কথা। ছোটবেলা থেকে একটু লেখার হাত ছিল তার। গ্রামের প্রতিভা, তাই বিকশিত হয়নি। তার চলাফেরায় ছিল অন্যরকম মাধুর্য। গ্রাম আর শহরের পার্থক্য খুঁজেছে প্রতিনিয়ত। দিন, মাস, বছর আর সময়ের পরিবর্তন আর বিবর্তনের চিত্রপটগুলি লালন করেছে হৃদয়ে।
মফস্বলের পরে সদর। সদর মফস্বলের তুলনায় উন্নত। তাই মফস্বলের মানুষের আগ্রহী দৃষ্টি থাকে সদরের প্রতি। তেমনি সদরের মানুষেরও করুণার দৃষ্টি থাকে মফস্বলের প্রতি। আবার সব সদর এক রকম নয়। উন্নত জীবনচিত্রর মূল বৈশিষ্ট্য। কারণ অবস্থানগত পরিবর্তনের ফলে আমরা স্বাভাবিক ভাবেই পেছনের অনুন্নত ভাবি। অবজ্ঞা ও অবহেলায় তাদের প্রতি অন্য দৃষ্টি পোষণ করি কেন? এর কারণ কি? এজন্যই কি এত আন্দোলন! ত্যাগ আর তিতিক্ষা! কেন? কিসের স্বার্থে এত ভেদাভেদের প্রশ্ন! ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারের তাজা রক্ত আর ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ!
রাহাত চৌধুরীর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেইসব দিনগুলি, যা এখনও ভাবলে চোখে জল আসে। মনসপটে ভেসে ওঠে স্মৃতিময় যত আক্ষেপ। ছোট্ট একটি চাকরি, বিবাহিত জীবন, গ্রামের সুখী পরিবার। সংসারে ফুটফুটে পুত্র সন্তান। অনাবিল আনন্দ। আসে ডাক ৭১ এর। শুরু হয় যুদ্ধ। পরিবার থেকে বিদায় নেয় দেশ বাঁচানোর অভিলাষে। সন্তান, পরিবার, পরিজন, স্নেহ, মমতা, ভালবাসাকে ত্যাগ করে যুদ্ধের ময়দানে। যুদ্ধ স্বাধীনতার জন্য, দেশ রক্ষার জন্য। মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আজকের এই স্বাধীনতা। যুদ্ধ শেষ।
গ্রামে ফেরার পালা প্রিয়জনের কাছে। স্বাধীনতার সূর্য মাথায় নিয়ে। সবুজের বুকে লালের উদ্ভাস। ধীর গতিতে পেরিয়ে গেল অনেকগুলি বছর। অতীত সবই অতীত। সময়ের তাড়ায় সবাই ব্যস্ত। চৌধুরী সাহেবের ছেলে ও বউ সবাই চাকরিজীবি। সেই সুবাদে শহরে থাকতে হয় রাহাত চৌধুরীকে। নাতি-নাতনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। শহরের পরিবেশ ভাল লাগে না তার। তারপরও বার্ধক্য মানুষকে অনেক কিছু হতে বঞ্চিত করে। বই পড়ে, খবর দেখে, আর নাতনিদের সাথে গল্প করে সময় কাটায়। গল্প শোনায় ৫২ এর ভাষা আন্দোলন এবং ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের।
এ যুগের আধুনিক ছেলেমেয়েরা ভালো করে বাংলা বলতে পারে না, ইংরেজির আদলে কথা বলে। শুনলে গা জ্বলে যায়। কি প্রয়োজন ছিল মাতৃভাষার জন্য জীবন দেয়ার? আর স্বাধীনতার জন্য ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগ। আজ কেন জানি নিজেকে বোঝা মনে হয় নিজেরই কাছে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার। কি মূল্য তার এই সমাজে। গ্রামে ফিরতে মন চায়। গ্রামের আলো বাতাস প্রকৃতি। ফিরতে চাইলেই তো ফেরা যায় না। সময় চলে তার আপন গতিতে। এরই আবর্তে দেশের ছোট একটি দৈনিকে ‘মুক্তিযোদ্ধার চেতনা’ নামে ফিচার প্রকাশ হয় রাহাত চৌধুরীর। প্রকাশ পায় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
চোখের পলকে উল্টে যায় তার জীবনচিত্র। শুরু হয় সাক্ষাৎকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও মিডিয়ায়। তার স্বপ্ন গ্রামের নিরীহ অসহায় মানুষের পাশে থাকা। রাহাত চৌধুরী ভাবে, মনে মনে হাসে, আবার বিষণ্ণতায় একাকার হয়। সে তো দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধা নয়, হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা কি করছে, কে জানে? কে রাখে কার খবর? কৃষক-শ্রমিকরাও তো মুক্তিযোদ্ধা। নয় মাস যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে। তবে কেন এত মানুষে মানুষে ভেদাভেদ? দেশে নৈরাজ্য বেড়েছে। সন্ত্রাস, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন এখন কিছুই না।
আজ অনেকদিন পর গ্রামে রাহাত চৌধুরীর পরিবার। ছায়া সুনিবিড় মুক্ত বাতাস, যেন এক নতুন দিনের সূচনা। চেনা মুখ হলেও তিনি এখন নতুন ব্যক্তিত্ব। নাতি, নাতনি, ছেলে, বউ, আত্মীয়-স্বজন যেন একটি বিয়ে বাড়ি নব ঢেউ। কেন জানি কিছু ভালো লাগছে না রাহাত সাহেবের। উদাস, নিঃসঙ্গ, একাকিত্ব তাকে গ্রাস করছে। আনন্দ শুধু রাহাত সাহেবের বাড়িতে নয়, পুরো গ্রামে। এই রাত শেষ হলেই সেই কাঙ্ক্ষিত ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। যত আয়োজন সব রাহাত চৌধুরীর জন্য। সংবর্ধনা দেয়া হবে তাকে। আজ এতদিন পর শেষজীবনে। গ্রামের স্কুল মাঠে, সাথে দেয়া হবে দু’লক্ষ টাকার চেক আর সম্মাননা ক্রেস্ট। এলাকায় বিশাল আয়োজন। মঞ্চ, এমপি, মন্ত্রীদের পদচারণা।
ঘটে যায় অন্য ঘটনা। মধ্য রাতেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাহাত চৌধুরী। আকাশে বাতাসে কান্নার রোল ছড়িয়ে পড়ে। তাকে ভুলে যায় সবাই ভুলের এই পৃথিবীতে। একই ধারায় চলতে থাকে জীবন।