জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশের ৫ কবিতা
স্মরণ
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২২
কবি ও কথাসাহিত্যিক জীবনানন্দ দাশের আজ জন্মদিন। ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালে তার জন্ম। তার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর পরগনা নিবাসী। তার মা কবি কুসুম কুমারী দাশ ও পিতা সত্যনানন্দ দাশ। জন্মদিনে কবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার রচিত কয়েকটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
কার্তিক ভোরে
কার্তিকের ভোরবেলা কবে
চোখে মুখে চুলের ওপরে
যে শিশির ঝরল তা
শালিক ঝরাল ব`লে ঝরে
আমলকি গাছ ছুঁয়ে তিনটি শালিক
কার্তিকের রোদে আর জলে
আমারি হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন;
সূর্য? নাকি সূর্যের চপ্পলে
পা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে
পৃথিবীর থেকে উড়ে যায়
এ জীবনে আমি ঢের শালিক দেখেছি
তবু সেই তিনজন শালিক কোথায়?
স্বপ্ন
পাণ্ডুলিপি কাছে রেখে ধূসর দীপের কাছে আমি
নিস্তব্ধ ছিলাম ব`সে;
শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ`সে;
নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি
উড়ে গেল কুয়াশায়, —কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরও।
তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেল বুঝি?
অন্ধকার হাৎড়ায়ে ধীরে-ধীরে দেশলাই খুঁজি;
যখন জ্বালিব আলো কার মুখ দেখা যাবে বলিতে কি পারো?
কার মুখ? —আমলকী শাখার পিছনে
শিঙের মতো বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিল তাহা;
এ-ধূসর পাণ্ডুলিপি একদিন দেখেছিল, আহা,
সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।
তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র`বে না আর, র`বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন:
সেই মুখ আর আমি র`বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।
সূর্যতামসী
কোথাও পাখির শব্দ শুনি;
কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;
কোথাও ভোরের বেলা র`য়ে গেছে— তবে।
অগণন মানুষের মৃত্যু হ`লে— অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়
বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;
এ কোন সিন্ধুর সুর:
মরণের— জীবনের?
এ কি ভোর?
অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু।
একটি রাত্রির ব্যথা সয়ে—
সময় কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হয়ে
আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য বুকে ক`রে জেগে ওঠে?
কোথাও ডানার শব্দ শুনি;
কোন দিকে সমুদ্রের সুর—
দক্ষিণের দিকে,
উত্তরের দিকে,
পশ্চিমের পানে?
সৃজনের ভয়াবহ মানে;
তবু জীবনের বসন্তের মতন কল্যাণে
সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শুনি;
ভোরের বদলে তবু সেইখানে রাত্রি করোজ্জ্বল
ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ— তুমি?
সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওইদিকে নীল
সমুদ্রের পরিবর্তে আটলাণ্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি!
বিলীন হয় না মায়ামৃগ— নিত্য দিকদর্শিন;
যা জেনেছে— যা শেখেনি—
সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মতো জ্ব`লে
জাগে না কি হে জীবন— হে সাগর—
শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে।
লোকেন বোসের জার্নাল
সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি—
এখনো কি ভালোবাসি?
সেটা অবসরে ভাববার কথা,
অবসর তবু নেই;
তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে
এখন শেলফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে
সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কিনা।
পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে:
সুজাতা লিখেছে আমার কাছে,
বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা;
ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ;
নাড়বো না আমি
নেড়ে কার কি লাভ;
মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব,
সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে
মানে এই— অমিতা বলছি যাকে—
কিন্তু কথাটা থাক;
কিন্তু তবুও—
আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর,
নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো— তবে
এখন কি করে মন কারভান হবে।
প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি
সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতলে ঈষৎ সিমুমে
হয়তো কখনো বৈতাল মরুভুমি,
হৃদয়, হৃদয় তুমি!
তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তব চুপে
মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষণ নামরূপে
সেখানে বালির সৎ নিরবতা ধূ ধূ
প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু।
অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?
অমিতা নিজে কি তাকে?
অবসর মতো কথা ভাবা যাবে,
ঢের অবসর চাই;
দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই
এখনি টেনিসে যেতে হবে তবু,
ফিরে এসে রাতে ক্লাবে;
কখন সময় হবে।
হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোটে—
হৃদয় কেন যে কাঁপে,
`ভালোবাসতাম`— স্মৃতি— অঙ্গার— পাপে
তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান।
সে-ও কি আমায়— সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিল?
আজো ভালোবাসে নাকি?
ইলেকট্রনেরা নিজ দোষগুণে বলয়িত হয়ে রবে;
কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে এর উত্তর হবে?
সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;
অমিতা কি মিহিজামে?
বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে— সবই।
ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে;
সময়ের এই স্থির এক দিক,
তবু স্থিরতর নয়;
প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।
শীতরাত
এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।
শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে—
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।
এদিকে কোকিল ডাকছে— পউষের মধ্যরাতে;
কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব`লে?
কোনো-একদিন বসন্ত ছিল, তারই পিপাসিত প্রচার?
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ`য়ে যেতে দেখেছি,
তারা কিশোর নয়,
কিশোরী নয় আর;
কোকিলের গান ব্যবহৃত হ`য়ে গেছে।
সিংহ হুঙ্কার ক`রে উঠছে:
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,
স্থবির সিংহ এক— আফিমের সিংহ— অন্ধ— অন্ধকার।
চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে
মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে
যায় সব।
সিংহ অরন্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মতো খসে খসে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ,— তুমি
পাশ ফিরে শোও,
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।