‘জীবন মানে শুধু জীবিকার নাম নয়’
মাহবুব ইসলামপ্রকাশিত : মার্চ ১১, ২০২২
শ্রোয়েডিংগারের what is life বইয়ের এক জায়গায় আছে, একটা পতঙ্গ একদিন মাত্র বাঁচে। অথচ একদিনে সে জীবন, যৌবন, সংগম ও মৃত্যুবরণ করে।
অথচ মানুষ এত আয়ু নিয়েও তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই একগুয়েমিতায় ভরা। রুটিন বাউন্ড জীবন কাটায়। কয়জন জীবনের মানে খোঁজে! হামীম কামরুল হকের `যেখানে খুঁজেছ তুমি জীবনের মানে` উপন্যাসে ‘তুমি’ সম্বোধন করে মূলত পাঠককে জীবনের মানে খোঁজ করার ইঙ্গিত করেছেন। এক জায়গায় লেখক বলেন, জীবন মানে শুধু জীবিকার নাম নয়।
হামীম পুরুষ প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মূলে যে কপটতা, যৌনতা নিয়ে পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য, সেই ভিতটাকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। বইটি পড়তে গিয়ে টিকলিকে মনে হবে পাওলো কোয়েলহোর ইলেভেন মিনিটস-এর মারিয়ার কথা। যদিও টিকলি মারিয়ার মতো কোনো যৌনকর্মী নয়, তবে সেও যৌনজীবনের মাধ্যমে জীবনের অর্থ খোঁজ করার প্রয়াস করে।
‘টিকলি বলত, মানুষ নিয়ে তার আগ্রহ প্রবল। এক একটি মানুষকে পুরো জেনে নিতে, তার মন ও শরীর দুয়ের খবর নেওয়া দরকার।’ পিউরিটানরা হয়ত নাক সিটকে বলবে, একজন নারীকে এমনভাবে উপস্থাপন করল! আমরা ডন জোয়ান কিংবা বিভিন্ন মিথ পাই, যেখানে জিওসের মতো দেবতারা ইচ্ছেমতো ভোগ করে নারীকে। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নেয়। আর নারী একই কাজ করলে সামাজিক ট্যাবু, ধর্মীয় বিধিনিষেধ দিয়ে তাকে দমিয়ে দেয়া হয়৷
তহুরা বিবির হসপিটালে ডাক্তারের সাথে একটু অন্তরঙ্গ হওয়ার পর, তার নামাজে বসে অনুশোচনা করা, আর কিছু নয় তার ভেতর পুঁতে দেয়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিশ্বাস, সামাজিক ট্যাবু। পুরুষ হরহামেশাই হাজারটা সম্পর্ক করে। টিকলি এই পুরুষতান্ত্রিক মিথটাকে ভেঙে দিয়ে নতুন এক ধ্যান-ধারণার উম্মেষ ঘটায়। সেই কলাবাগানের ঝোপঝাড় থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটির হলে উদ্দাম জীবন যাপনে বিচিত্র পেশার মানুষের সাথে মেলামেশা করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়।
বিবাহিত জীবনের অন্তঃসার শূন্যতা, শীতল জীবন, নিচক কতগুলো অভ্যাসের বশীভূত হয়ে জীবন কাটানো, কর্পোরেট সমাজের নারীলিপ্সুতা সবকিছুকেই কোন রাখঢাক ছাড়াই এই সমাজের মুখোশ উন্মোচিত করেছে টিকলি।
বাংলাদেশের অফিস-আদালতগুলো এজন্য অসভ্য লোকের আস্তানা, আর বিছানা, যেখানে মানুষ তার আদিম হওয়া দরকার সেখানে সে আদিম হতে পারে না। আর আদিম হতে না পারলে আদম হওয়া যায় না। বাঙালির যৌনজীবনের কপটতা খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন হামীম।
প্রেম, ভালোবাসা সম্পর্কে টিকিলির ফিলোসোফি হলো, যাকে ভালোবাসো, তাকে মুক্ত করে দিতে হয়। আফসোস, টিকলি কিংবা পুরুষ, কেউই স্বাধীনভাবে মিশতে পারেনি। টিকলি কারনাইন আর শ্রেয়ার কাছেই ফিরে গেছে এর ‘তুমি’।
তবে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে, হামীম এক ফেটিস বুর্জোয়া শ্রেণির জীবন অনুসন্ধান করেছেন যে সমাজে শোষণ, বঞ্চনা, ভণ্ডামি শুধু যৌনতাকেন্দ্রিক। এদিক দিয়ে এই উপন্যাস ডিএইচ লরেন্স এর পৃথিবীর মতো মনে হতে পারে।