জিয়া হাশানের গল্প ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’
শেষ পর্ব
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১
কাইল রাইতে মহাজনে খাস কামরায় ডাইকা নিয়া হুমকি দিছে। আঙুল উঁচা কইরা কইছে, ভাডা ঠিক কইরা, হ্যার অসুখ-বিসুখ দূর কইরা না দিলে মোর জান আস্ত রাখবে না। কবজ কইরা ফালাইবে। এ্যাই কয় দিনেই বুঝতে পারছি দক্ষিণের এরা চউর্যা জাত। বেপারির মুখোশ পইরা থাহে। আদতে হগোল ডাকাইত। খুন-খারাবি পেশা। দিনেদুপুরে যে কাউরে ফিনিশ কইরা দিতে পারে। মোর জান লইয়্যা চরের মইদ্যে পুইত্যা ফালাইলে কিংবা গাঙে ভাসাইয়্যা দিলে কারো কিছু করার থাকবে না।
তুই ভাইগা পর। চইল্যা আয়।
ক্যামনে যামু? মোর লগে ফেউ লাগাইছে। সারাক্ষণ পিছে পিছে থাইকা নজরদারি করে। আপনে আহেন, ভাডারে দ্যাইখা-শুইন্যা দরকার অইলে টেস্ট-টোস্ট কইরা দাওয়াই দ্যান। মহাজনে কইছে, খরচাপাতি যা লাগে দিবে। অনুপান যা দরকার হয়, জোগাড় কইরা আনবে। আপনে আহেন। মোরে উদ্দার করেন।
শিষ্য ডাকলেই কি ওস্তাদে ছুটতে পারে? তাতে কি তার ওস্তাদি ভাঁজ থাকে? তাই লতিফ কারিগরের আরো দুই বার কল দিতে হয়। তিন বারের মাথায় গিয়া এক সন্ধ্যায় তাজ ওস্তাদ সদরঘাট থেকে জলযানের আশ্রয় নেয়। তা আবার মেঘনায় পা দিতেই শিষ্যরে কল লাগায়, কীরে লতিফ্যা! তুই মোরে কই ডাকতাছ। এ্যাত দ্যাহি গাঙের সীমা-সদর কিছুই নাই। এপার ওপার দ্যাহা যায় না। জাহাজ ডুবলে আর বাঁচার উপায় নাই। এ্যাই বুড়া বয়সে মোরে গাঙে ডুবাইয়্যা মারার মতলব আঁটছো, অ্যাঁ?
না ওস্তাদ, জাহাজ ডুববে না। এহন শীতের রাজত্ব। তার কড়া শাসনে মারা সাপের নাহান দশা এহন গাঙের। কোনো ঝড়-তুফান ঢেউ নাই। আপনে নিশ্চিন্তে ঘুম দ্যান। সাতসকালেই দীঘল কাডি আপনার সামনে খাড়াইবে। মুই ঘাডে হাজির থাকুম নে।
জলযানে চলাচলে অনভ্যস্ত তাজ ওস্তাদ পরদিন সকালে মাটিতে পা দিয়া স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে, কই তোর ব্যামোঅলা ভাডা? ল, দেহি হ্যার চেহারা-সুরত ক্যামন।
তাজ ওস্তাদে তিন দিন ধরে তার রোগী দেখে। গোলাপি ভাটার গা-গতর টেপে। এমাথা ওমাথায় সায়ের করে বেড়ায়। জিহ্বায় চোখ রাখে। খোলার মুখে চুল্লির ভেতরে মনোযোগে তাকায়। হৃদকম্পনের খোঁজ-খবর নেয়। হাতের মুঠোয় মাটি নিয়া পরখ করে। তারপর গিয়া পুরা একরাত অবজারভেশনে নামে। সারাটা রাত ভাটায় কাটায়। নির্জন নিশিতে রোগীর সাথে নিভৃতিতে কথা কয়। খোলামেলা আপাদমস্তক বাতচিত যারে বলে। পরদিন সকালে শিষ্য লতিফ কারিগরের কাঁধে হাত রাখে, নতুন মাটিতে নতুন ভাটা। ভোগ ছাড়া তার তুষ্টি হয় কী কইরা? ব্যামো ছাড়ে ক্যামনে? জ্যান্ত পেরান তার ভোগ চাই।
গুরুর কথায় লতিফ কারিগরের চোখ বড় হয়, অ্যাঁ, ওস্তাদেকীকয়? একেবারে জ্যান্ত পেরান?
ভোগের কথায় য্যানো অবাক হইলি? দ্যাশজুড়ে যে এ্যাত বড় বড় ভাটা, নামিদামি ইটের কারখানা। তার একটাও কী ভোগ ছাড়া খাড়াইছে? কিন্তু তোর ভাটার ব্যামো বড় কঠিন। মনোবিকার ভয়ংকর। তারে তৃপ্ত করার, তার ব্যামো দূর করার লাইগা চাই দামি প্রসাদ। নামি নৈবেদ্য। ক্যান তোর মনে নাই খদরপুর ভাটার কথা? তুই তো পুরাডা মৌসুম মোর লগে আছিলি। দ্যাখছো সব কিছু।
মনে না থাকার কোনো কারণ নাই। লতিফ কারিগরের সে ভাটাতেই প্রথম এ লাইনে কাম শুরু। গাজীপুর সদর থেকে ভেতরে বনের কোলঘেঁষে খদরপুর। তার খোলা মাঠে ধানের জমি কেটে ভাটা পাতে আয়নাল মহাজন। তাজ ওস্তাদরে হায়ার করে নিয়া মেইন কারিগর বানায় আর লতিফ রেলেবার সর্দার। সে কত সাল আগের কথা। লতিফ কারিগর কর হিসাব করে গুণে গুণে দেখে, উনিশ পার, বিশে পা।
কিন্তু খেতের মাঝখানে একলা ভাটা। আশপাশে আর কেউ নাই। একেবারে নিঃসঙ্গ। তাতেই বোধহয় তার মনোবিকার দেখা দেয়। তাই তার প্রোডাক্ট ইট হয় শিখিল, শক্তপোক্ত বিহীন। আবার তাপ-উত্তাপে জোর দিলে, দুদিন বেশি চুল্লিতে রাখলে হয় দোমড়ানো মোচড়ানো কালো পিণ্ড। এক কথায় ঝামা।
তার মনোবিকার কাটে কী কইরা ওস্তাদ?
কী করে আবার ভোগে। এ্যাকেবারে জ্যান্ত প্রসাদ পাইয়্যা তবেই তার তুষ্টি হয়। মনে নাই, ভাটায় যে নাদুস-নুদুস ছেলেটা আছিল। রাস্তা থাইকা তুইলা আইনা লেবারিতে বহাল করছিলাম। খোঁজ নিয়া দ্যাহি তিন কূলে তার কেউ নাই। ছয় মাসেও কেউ তার খোঁজ-খবরে আসে নাই। তাই এক নিশুতি রাতে তারে চুল্লিতে দেই। সামান্য ধাক্কাতেই একেবারে মুখের ভেতরে চালান অইয়্যা যায়। দ্যাহি, আগুনের লকলকে জিহ্বা তারে টাইনা নেয়। মুখের গহ্বরে নিয়া চাইটা পুইটা খায়। নরম কচি হাড্ডিও হজম কইরা ফালায়। তারা সব ছাইয়ে রূপ নেয়।
তোর এহানে বাপ-মাবিহীন ঘরছাড়া কেউ নাই? কোনো কুলি-মজুর? না থাকলে নিজেই বানাইয়্যা ল। পেরান প্রোডাক্ট কইরা নে। ইবরাহিম নবির পথ ধর। নিজের ঔরসের জাতরে কোরবানী দে। তাতে ফায়দা বেশি। দেবতা কূলের তুষ্টি বিপুল। ল্যাওড়ায় জোর আছে না? না থাকার কী আছে? বয়স তো পঞ্চাশও পার হয় নাই। তাহলে এহনই নাইমা পর। হাডের কোনায় দ্যাখলাম এক ছাড়া মাগী। লগে মরদ কেউ নাই। তারে কব্জা কর। ভাটায় কাম দে। হাতের মুডায় লইয়্যা ল। হেরপর সুযোগ মতো, গোন বুইজা, পিরিয়ডের হিসাব-নিকাশ কইরা পেরানের ভিত্তি গইড়া দে। হেরপর তোর আর কিছু করতে অইবে না। বাকিডা আল্লায় কইরা দেবে। দশ মাস দশ দিন পর আস্ত পেরান তোর হাতে আইয়্যা ধরা দেবে। একবারে খাঁটি নিষ্পাপ মাসুম ভোগ অইবে। ভাটায় একবার তার স্বাদ পাইলে জীবনে আর ভুলবে না। জনমভর সোনার বরণ চারকোনা বার জনম দিয়া যাইবে।