জিয়া হাশানের গল্প ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২১

ভাটার উত্তর পাশে টিনে ছাওয়া দুটো ঘর। তার একটায় বসে মকবুল ম্যানেজার। হিসাব-পত্তর রাখা, মজুরি বণ্টন করা তার কাজ। আরেকটায় লতিফ কারিগর বসে। তার দরজা-জানালা পথে পুরো ভাটা খাড়া। চোখ রাখলেই সব নজরে পড়ে। শ্রমিক-মজুর-জোগানদাররা কোথায় কী কাম করে, সব চোখে ধরা দেয়।

মহাজান চলে গেলে কারিগর এসে সে ঘরে বসে। নিজের সন্তান যতই ল্যাংড়া-খোড়া হোক, কুৎসিত-কদাকার হোক তার চেহারা-সুরত, তারে তো আর ফেলে দেয়া কিংবা গঙ্গাজলে বিসর্জন দেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া খোলা খালি করার বিষয় আছে। আছে তাতে আবার নতুন করে কাঁচা ইট সাজায়ে তাদের পাকা করার উদ্যোগ আয়োজনে নামা। তাই কারিগর ইট তুলে খোলা খালি করার অর্ডার দিয়া এসেছে। ঘরে ফিরে জানালা পথে চোখ রেখে দেখে, মজুররা খোলা থেকে তুলে ঝুড়ি বোঝাই করে গাঙপাড়ে নিয়া রাখছে চৌকোনা মাটির ঢেলা। তারা একটার উপর আরেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্তূপ দিয়া উঠছে।

মহাজন মুখ ফুটে না বললেও, ভদ্রতায় মুখ এঁটে থাকলেও কারিগর বোঝে, ঘাসপাতা খেয়ে তো আর নয়, ভাত-মাছ খেয়েই তো বড়ো হওয়া, তাই না বোঝার কী আছে, ইটের এই প্রতিবন্ধী দশার দায়ভার পুরাটাই তার। আবার তারে সারিয়ে তোলা, আগামী খোলার গুলাকে সুস্থ-সবল করার উদ্যোগ-আয়োজনের পথে হাঁটাহাঁটি কিংবা দৌড়াদৌড়ি সবটা তারই করতে হবে। তবে সে পথে পা দেবার আগে বোঝা দরকার, পুরা এক খোলা, প্রায় হাজার পাঁচেক ইট কোন দুঃখ-কষ্টে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিলো? অর্টিস্টিক হয়ে জগতে এলো ক্যান? তার কীর্তিস্তম্ভের মাথায়, একেবারে শুরুতেই এমন আজদাহা ঘায়ের কারণ কী?

কারিগর তার হিসাব মেলাতে গিয়া উৎসে হাত দেয়, তাহলে কী মূলেই, মানে বীর্যেই ঘুণ ছিল? মাটিতে কোনো দূষণ? কিন্তু তা কী করে হয়? মাটি তো পরীক্ষা করা। গা-গতরজুড়ে সরকারি অফিসের সিলমোহর আঁকা। মনে আছে, ভাটার গোড়াপত্তনের পর মাটি দেখে সে মাথা নেড়েছে, এ্যাই চরের মাটিতে বালুর আধিক্য। তারা গায়ে গায়ে মেশে না। ছাড়াছাড়া ভাব নিয়া জীবন পার করে দেয়। এ দিয়া জাতের ইট হবে না। তার জন্য চাই আঁঠালো, সদ্য বিয়া করা বউ-জামাইয়ের মতো গায়ে গায়ে জাড়াজড়ি ধরে থাকা মাটি।

তখন দূর থেকে ট্রলার বোঝাই করে মাটি আনা হয়। তারা ভাটার দক্ষিণ মাথায় ঢিপ দিয়া ওঠে। পাহাড়ের রূপ নিয়া খাড়ায়। তারে নিজ হাতে ছেনেছুনে দেখেও তার মন পোষে নাই। তাই দুই ঝুড়ি জেলা সদরের অফিসে পাঠায়। তারা তারে উল্টেপাল্টে দেখে, গা-গতর টিপে যাচাই-বাছাই করে। মেশিনে ফেলে অন্তরের খোঁজ-খবর নেয়। তার পরে গিয়া সার্টিফিকেট বানায়, নো অবজেকশন। ইটের জন্য পারফেক্ট।

সে মাটিই তো ছেনেছুনে খামি বানায়ে কাঠের বাক্সে ভরে সাইজ করা। ইটের আকার-আকৃতি দেয়া। তারপর পোড়ানো। তাহলে তার মধ্যে ঘুণ থাকে কী করে? এতটুকু দুষণের সম্ভাবনা কোথায়? কারিগরের হিসাব মেলে না। তাকে তাই নতুন পাতা খুলতে হয়, তাহলে কী গর্ভে থাকতে পুষ্টিকর খাবার-দাবারের ঘাটতি আছিল? খোলার ভেতরে আগুনের তাপ-উত্তাপে কমতি? তাই ল্যাংড়া-খোড়া হয়ে জন্ম?

কারিগর কর গোনে, গর্ভাবস্থায়, ইট পোড়ানোর সময়কালে কখন কী খাবার লাগে, কত টুকু তাপ-উত্তাপের দরকার হয় তা কী আর তার অজানা? বরং এত বছর ধরে হাজারো গর্ভাবস্থার সেবাযত্ন, তত্ত্ব-তালাফির করায় এখন তা তার নখের আগায় খোদাই করা। হাতের তালুর রেখায় রেখায় আঁকা। তা দেখে দেখেই তো ব্যবস্থাপত্র দেয়া। আগুনের তাপ-উত্তাপ বাড়ানো কিংবা কমানো। আর তাতে কোনো ঘাটতি না পড়ে, কোনো গাফলতি দেখা না দেয় তাই নিজে টানা সাত দিন ভাটায় কাটানো।

এমনিতে কারিগরের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা মহাজনের বাড়িতে। দীঘলকাঠি হাটের পুব মাথায় দোতলা ভবনের একরুমে। সেখান থেকে সকালে ভাটায় আসে, আবার সন্ধ্যায় ফিরে যায়। কিন্তু খোলায় আগুন জ্বালানো, ইট পোড়ানোর পালা শুরু হলে সে আর সন্ধ্যায় ফিরে নাই। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টাই ভাটায় কাটাইছে। নিজে আগুনের তাপ-উত্তাপ মাপছে। কখনো কোথাও এতটুকু ঘাটতি দেখলে সাথে সাথে পূরণ করে দিছে। সুতরাং খাবার-দাবারে কোনো কমতি, পুষ্টিতে কমতি হবার কথা নয়। বরং গর্ভে বসে পেট পুরে খাবার জোগান, আগুনের উত্তাপ পাইছে। কিন্তু তারপরও কেন তেরা-বাঁকা শরীর, মুখ জুড়ে কালশিটে দাগ নিয়া জন্ম নেয়া, অ্যাঁ?

একটা দুই টানা, শুধু আগাটুকু কিংবা গোড়া মূল নয় বরং পুরা ঝাড়রে, খোলার এ মাথা থেকে ও মাথারে নিজের আয়ত্বে নিয়া ইচ্ছামতো বাঁকা-তেরা করার ক্ষমতা আর কার থাকতে পারে? কারিগরের গালের হাত আর সরে না। তাহলে কী কোনো দুষ্টগ্রহ, অশুভ আত্মা অসুচির ছিদ্রপথে, অযত্ন-অবহেলার সুযোগে ঢুকে পড়ে ওদের মুখ-চোখ গা-গতর বিকৃত করে দিছে? কারিগর এদেশে নতুন, এখানকার মানুষজন, আত্মা-প্রেত্মাদের মতিগতি হাব-ভাব তার অজানা। তাই সে বড় হুজুর, দীঘলকাঠি হাটের তিন তলা মসজিদের ইমাম সাহেব পানে ছোটে।

যদি অশুভ আত্মাই ভর দেয়, তার কারসাজিতে ইটেরা বাঁকা-তেরা রূপ নেয়। তাহলে তো সে আগামীতেও হানা দেবে। ধারালো নখ-দাঁতে হামলা চালাবে। ভাটার একটা ইটরেও রেহাই দেবে না। সুস্থ-সবল হয়ে জন্মাতে পারবে না একটা আধলাও। এমন কি যারা বানায়, শ্রমিক-মজুর কারিগর তাদের উপরও চড়াও হতে পারে। পাশের গাঙে তাদের চুবাইয়্যা জান নিতেও কসুর করবে না তখন। কারিগর তাই জোর কদম চালায়। বড় হুজুর কামেল লোক। শুক্কুরবার শুক্কুরবার এমন বয়ান দেন, মুসল্লি গো চোখে পানি থৈথৈ করে ওঠে। কারিগর নিজেও দুই দিন অশ্রুজলে সামিল হইছে। রোজগারের ধান্দায় বউ-বাচ্চা রেখে এত দূর দেশে এসে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারে নাই। হুজুরের সাথে মোনাজাতে ফোঁপায়ে উঠছে। এমন জবরদস্ত হুজুর হাত বাড়ায়ে এক হাউডি দিলে ইসব আত্মা-প্রেত্মারা ধরা পড়ে যাবে। তাই তার পায়ের কাছে কারিগর হুমড়ি খায়, হুজুর মোগো বাঁচান। ভাডারে রক্ষা করেন। তার এ্যাকটা ইডও সোজা দেহে, রঙিলা মুহে জনমায় নাই। তারে দুষ্ট আত্মায় পাইছে। শয়তানের ফেরে পড়ছে। তারে আটকান।

কারিগররে ইমাম সাহেব পদ তল থেকে তুলে পাশে বসান, শোনো মিয়া, তুমি তো এ্যাই দ্যাশে নতুন। কয়দিন অয় আইছো। ওই চরের ইতিহাস তোমার জানার কথা নয়। মোরা জানি। নিজের চোহে দ্যাহা। তারে দখলে নিয়া বগল তলায় রাখতে কত জনের জান গ্যাছে? বল্লমের ঘায়ে রামদার কোপে কতজন পেরান হারাইছে? চলবে