জিয়া হাশানের গল্প ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’
পর্ব ১
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২১
এ্যাই বাজারি মাগী এহানে কি করে? পাগলাচোদা বুড়ি, বাজারের গলিতে গলিতে ঘুইরা বেড়ায়। রাস্তার ধারে শুইয়্যা থাহে। যার তার চোদন খাইয়্যা প্যাড বাজায়। অরে এহানে কাম দিছে কেডা?
গোলাপি ব্রিকফিল্ডে আছিয়ারে কাম করতে দেখে জোগানদাররা বুক সোজা করে খাড়ায়। স্বররে তালগাছের মাথায় চড়ায়, এ্যাই বাজারি মাগীর লগে মোরাকাম করমু না।
ইট ভাটায় চলে আগুনের খেলা, জল ও মাটির কুস্তি লড়াই আর কাস্তে-কোদালের কোলাহল। তাদের সামলায় জোয়ান-মরদশ্রমিক-মজুররা। তবে কেবল মাটিরে ময়দার মতো দলাই মলাইয়ে কাবু করার কাজে আছে কয়েক জন কোমলাঙ্গী। নাজুক দেহী রমণী। খাতা-কলম তাদের নীরবে ডাকে জোগানদার বলে।
এ পদে আজ আছিয়ার অভিষেক। কিন্তু প্রথম দিনে তারে কামে দেখে বাকি জোগানদাররা তেলে-বেগুনে জ্বলে। কেননা, তারা সবাই স্বামীঅলি। আপন আপন মরদের সাথেই তারা ঘুমায় এবং বছর বছর না হলেও দুচারের পরপর পুত্র-কন্যা আমদানি করে। তাদের নিয়া ঘর-সংসারে মাতে। কিন্তু আছিয়া ঠিক তার বিপরীত। তার স্বামী-সোয়ামির ঠিক-ঠিকানা নাই। পুত্র-কন্যাদের হদিস অজানা। তাই বাজারের পোড়োঘরে একলা একলা রাত কাটায়। সুতরাং তার সাথে কী করে বাকিদের মেলে? তেলেজলে খাপ খায়?
তাদের প্রতিবাদ ভাটার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, শ্রমিক-মজুর-জোগানদারগো ভাষায় মাওবাপ— লতিফ কারিগরের কানে ঘা দেয়। তার কোমর সজাগ হয়। সোজা হয়ে খাড়ায়— কেডা, আছিয়ারে কামে বাধ সাধে কোন হউরের ঝি? যার উছিলায় দুই দিন পর ভাটা রক্ষা পাইবে। মরতে বসা গোলাপি ফিল্ড জীবন ফেরত পাবে। তার কামে আগল ফেলে কোন শালি? দ্যাহি...
ভাটার উম্মুক্ত ময়দানজুড়ে কাঁচা ইটের সমাবেশ। তাদের নধর দেহ, নাজুক অঙ্গ। পাজা কিংবা স্তূপের মতো গরিবি আয়োজনে তাদের চলে না। তাই একজনের ঘাড়ে আরেক জন মাথা রেখে শুয়ে জাফরি কাটা জানালার মতো রূপ ধরে আছে তারা। তাদের দু’সারির মাঝখানের গলিপথ দিয়া লতিফ কারিগর ভাটার দক্ষিণ মাথা পানে আগায়। সেখানে মাটির স্তূপ মাথা উঁচা করে খাড়া। তার গতর কেটে পানিতে মিশায়ে ছুঁয়ে-ছেনে খামি তৈরি করায় মশগুল জোগানদারা। তাদের মুখোমুখি হয় লতিফ কারিগর— আছিয়ার কী হাত-পাও নাই? গা-গতরে তাগতে কি কমতি আছে? হ্যায় কাম করলে তোমাগো কী অ্যাঁ? যার রাস্তা হ্যায় মাপো। অরে কাম করতে দাও।
হ, কারিগরের কথায় ক্ষুরধার যুক্তির জোরদার বসত। তারে ঠেলে তোলা যায় না। কেননা আছিয়ার শরীর সুস্থ ও সবল। গা-গতরে তাগতের বহর। তা চালায়ে যদি দুইটা পয়সায় আঁচলের খুটরে তুষ্ট করে, তাহলে কার কী ক্ষতি! সেতো আর কারো বাড়া ভাত কেড়ে নিতে আসে নাই। কাউরে ছাঁটাইয়ের ঘরে ফেলে তো আর তারে বহাল করা হয় নাই। সুতরাং তার কামে বাগড়া দেবার কীআছে! তবে সবচেয়ে বড় কথা লতিফ কারিগরের সায়। আছিয়ার প্রতি মুঠা পাকানো সমর্থন। ফলে আর কোনো পলেস্তরার দরকার পড়ে না। বরং তাতেই মসৃণ হয়ে যায় সব খানাখন্দ। ঢাকা পড়ে সব ওজর-আপত্তি। তাই জোগানদারদের ফনা হাত-পা গুটায়, নামায়ে নিয়া তারা নিজ নিজ কামে থিতু হয়।
লতিফ কারিগর আগেও দু-চারবার আছিয়ারে দেখছে। আসা-যাওয়ার পথে বাজারের পোড়ো ঘরটাতে চোখ পড়ছে। কিন্তু তা তো বাস-ট্রেনে চলার পথে আশপাশ দেখার মতো চোখের আগায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া কেবল। তাতে কী পথ-পাশের গাছপালা ভূঁই-ক্ষেতের সক্ষমতা মাপা সম্ভব? অথচ লতিফ কারিগরের চাই, তা। আছিয়া ঊর্বরক্ষম কতখানি, তার দেহে বীজ রুইলে সে কেমন ফলন দেবে, তার নিখুঁত ও চুলচেরা হিসাবটাই তার দরকার। তাই সে দু’চোখের পুরা ফোকাস মারে আছিয়ার গতর পানে। তারা গজ-ফিতা হাতে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর রূপ নিয়া ছোটাছুটি করে। আছিয়ার দেহের আনাচ-কানাচ মাপঝোপের চেষ্টায় দৌড়ঝাপ জুড়ে দেয়।
শেষে সিদ্ধান্ত নেয়— না, আছিয়া আর তন্বী-তরুণী নাই। পুরাদস্তুর মেয়েমানুষ। গা-গতরের স্থূলতার পথে দু-চার কদম আগানো। একবেলা আধবেলা খেয়ে দিন গুজরান করলেও শরীরের গোস্ত-মাংস বিরূপ না। তারা বেশ যুৎসই মতো বসা। তবে ফর্সা-আলতার উঁকিঝুঁকি নাই গতরের এতগুলা অঙ্গ-প্রতঙ্গের কোনোটায়। আর পুরা দেহরে কাদা-মাটিতে ভেজা শাড়ি-ব্লাউজ প্রাণপণে জাপটে ধরে থাকায় বুকের সাইজ সহজেই চোখ মেলে তাকানো। কারিগর ভালোমতো দেখে নেয়— সুডৌলের ঘরে তার বসত না হলেও আবার জাঙলার কদুর রূপ ধরা নাই।
তবে এরে দিয়াই হবে। লতিফ কারিগর তার সিদ্ধান্তের পাকাখুঁটি গাড়ে। এই গাঁও-গেরামে এরচেয়ে ভালো ফ্যাক্টরি আর কোথায় পাওয়া যাবে? এতেই পেরান প্রোডাক্ট হয়ে যাবে। চিন্তার কোনো কারণ নাই। কেননা চেহারা-সুরত যাই হোক, গতরের প্রোডাকশন কন্ডিশন যুৎসই আছে। বাজার থেকে ডেকে এনে কাজে বহাল করার আগেই ভাটার লেবার সর্দার নজির মিয়া পাকা খবর নিছে— যন্ত্রপাতিতে কোনো ঘুণ নাই। মাসিকের জোয়ার-ভাটা নিয়মিত চলছে। আর তার আগের গোটা চারেক প্রোডাক্টের প্রত্যেকটাই আছিল নিখুঁত। ল্যাংড়া-খোঁড়া, বোবা-কানা আছিল না একটাও। চলবে