জাহীদ ইকবালের গল্প ‘সুন্দরী ও গুড্ডু কাঠুরে’
প্রকাশিত : মার্চ ১৩, ২০২৩
ভাঙাচোরা কঙ্কালসার মানুষটার কাঠ চেরাই করা আদত পেশা হলেও কাঠঠোঁকরার মতো প্রায় রাত্তিরেই সে সুন্দরীর নাভির নীচে ঠোঁকরায়। সুন্দরীকে চেরে। চিরে চিরে রক্তাক্ত করে। সুন্দরী অবিশ্যি গড়ান, আম, শিরিষ, চাম্বুল, মেহগনি, তেঁতুল বা সুন্দরী কাঠ নয়; সে নিতান্তই রক্তমাংসেগড়া একজন মেয়ে মানুষ। সহজেই তাকে চিরে ফেলা যায়। বয়সেও সে তার থেকে ম্যালা কুট্টি। সুন্দরী তার শক্তির সঙ্গে কোনোদিনও পেরে ওঠে নি। আর পারবে বলেও মনে হয়না। ঠোকরাঠুকরির কর্মটি সে দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে। তীব্র ঘৃণা,অনিচ্ছা প্রকাশ করে বা বিষাক্ত ফণা তুলেও কোনো কাজ হয়নি।
চল্লিশোর্ধ্ব গুড্ডু কাঠুরে আটকে-পড়া পাকিস্তানি।
বিহারি ক্যাম্পেই সে বেড়ে উঠেছে। শৈশবে তার মা`র গতায়ু হলে জনক চিড়কুটুয়া তাকে নানির কাছে রেখে চোরাইপথে পাকিস্তানে গা-ঢাকা দেয়। ওখানে গিয়েও সে পুনরায় নতুন করে সংসারের তাঁবু গাড়ে। কোনোদিন আর এমুখো হয় নি। একমাত্র পুত্রেরও কোনো খবরতালাশ নেয় নি। জনকের অবয়ব গুড্ডু কাঠুরের একদমই সরণে আসে না। তার নানি ময়নাপুড়ি ছিল একজন ভিক্ষুক। তার সঙ্গে সে-ও ভিক্ষায় সামিল হতো। সারাক্ষণ বুড়ির আঁচল ধরে ঝুলে থাকত। তিন কূলে বুড়িরও কেউ ছিল না। গণ্ডগোলের বছরে মুক্তিযোদ্ধারা তার বাবা-মা`কে কচুকাটা করে তার সামনেই জবাই করে মেরে ফেলে। তার বাবাও অনেক নিরীহ বাঙালীকে ধরে ধরে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করেছে। গুড্ডু কাঠুরের শেষ আশ্রয় সেই নানিটাও নাই। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেন সে নিরুদ্দেশ হয়েছে। হাজার তালাশেও কোথাও তার হদিস মেলেনি।
গুড্ডু কাঠুরে অনেকটা মাল। অচল মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তাকে মনে ধরার মতো সুন্দরীর কিছু নাই। ভয়ঙ্কর খবিশ কিসিমে’র একটা মানুষ। অন্ধকারে সে দারুণ এক লড়াকু খবিশ খেলুড়ে। তার চেহারা-সুরাত খুবই বিদঘুটে। মুখে বিষফোঁড়ার মতো বড় বড় ব্রণ আর মেশতার কালো দাগে সয়লাব। এত বিশ্রী যে মানুষের চেহারা হতে পারে, আগেপিছে সুন্দরীর জানা ছিল না। তার গায়ের চামড়া সাক্ষাৎ গুঁইসাপ। প্রথম যেদিন সে এ বাড়িতে আসে, সেদিনই মানুষটাকে তার বিরক্তিকর মনে হয়েছে। তার বিবি-বালবাচ্চা থাকে ঢাকা জেনেভা ক্যাম্পে। তাদের বনিবনা, মুখের ভাষা___ একদমই যাচ্ছেতাই। সেখানে সে বছরেও একদিন মুখ দেখায় না। তাদের ভরনপোষণ দেয় না। তারা তাকে আপদ ঠাহর করে। একদমই সহ্য করতে পারে না। যদিও ভুলচুকে কখনও যায়, তাকে বেড়াল-কুকুরের মতো ঝেঁটিয়ে বিদায় করে।
গুড্ডু কাঠুরে বারান্দায় সুন্দরীর বাবার সঙ্গে ঘুমায়।
সে তার বাবার শিস্য। তার বাবা মঈন পাগলা একজন দক্ষ কাঠুরে। প্রতিদিন একা-ই সে ২৫/৩০ মণ কাঠ চেরাই করত। এখন আর সেই দিন তার নাই। শ্বাসকষ্টে দম তার ভিতর-বাড়ি আসা-যাওয়া করে। ৪/৫ মণের বেশি সে চেরাই করতে পারে না। সে আদতে পাগল নয়। সাদাসিধা কিসিমে’র একজন মানুষ। তবুও মানুষ কেন যেন তাকে পাগলা খেতাব দিয়ে সবার থেকে পৃথক করে দিয়েছিল। সে-ও কারো সাতেপাঁচে নাই। নিজের মতো করে শামুকের মতো গুঁটিয়ে থাকে। অথচ গণ্ডগোলের সময় এই মঈন পাগলা ছিল আস্তা একটা জুম্মন কসাই। কত মানুষ যে সে নিজের হাতে জবাই করেছে তার কোনো ইয়াত্তা নাই। একটুর জন্য সে প্রাণে বেঁচে গেছে। তার এক বাঙালী বন্ধু রফিক তাকে বাঁচিয়ে নেয়। তা না হলে সে ওখানেই জবাই হয়ে যেত। অবিশ্যি তার বন্ধু ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আগেই তার বাঁ পায়ের রগ মুক্তিযোদ্ধারা কেটে দিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার কদিন আগেই মঈন পাগলা নিজের এলাকা ছেড়ে এই বিহারি ক্যাম্পে এসে আত্নগোপন করেছিল। তা না হলে নিজের এলাকার লোকজন তাকে নির্ঘাৎ কচুকাটা করে ভাগা বসাত।
সুন্দরী মাটিতে গুঁটিশুটি মেরে শোয়।
পারলে সে শরীরটাকে সিন্দুকে তুলে রাখে। সিন্দুক তো দূরে থাক! ঘরে একটি সামান্য কাঠ বা টিনের দরজা বানাবার সামর্থ্যও তাদের নাই। পুরাতন গোলপাতার ঘর। গোলপাতার বেড়া। বর্ষার মৌসুমে সমস্ত ঘর বৃষ্টির পানিতে নদী হয়ে যায়। কোনো হাঁড়িপাতিল, থালাবাসন পেতেও পানি ঠেকানো যায় না। রাতভর পানির ভিতরে বসে থাকতে হয়। ঘরে কোনো দরজা নেই। কোনোরকম দরজায় একটি চটের পর্দা ঝুলিয়ে রাখে। একটি সিঙ্গেল পুরাতন লক্করঝক্কর ভাঙা চৌকিতে তার অসুস্থ প্যারালাইজড আক্রান্ত মা থাকে। চৌকিটা বড়োই নড়বড়ে। দু`জন সেখানে কোনোক্রমেই ঘুমানো যায় না। উঠলেই যেন চৌকিটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে।
একবার না, বেশ কয়েকবারই এই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। শীতের ক`মাস তার খবর হয়ে যায়। পিঠের নিচ দিয়ে যেন পানির তুফান ওঠে। সমস্ত রাত্তির পিঠ বরফের মতো ঠাণ্ডায় জমে থাকে। ঘুম হয় না। শীতে কিছুক্ষণ পরপর তার ঘুম ভেঙে যায়। শতছিদ্র ছেঁড়া চটকাঁথায় তার শীত যায় না। কোনো কোনো রাত্তিরে সে কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে শোয়। কখনো বা হাঁটু মুড়িয়ে ভোর পর্যন্ত বসে থেকেছে।
মঈন পাগলা একটু চোখ বুঁজলে, কোনোরকম একটু রাত্তির বাড়লেই গুড্ডু কাঠুরে সুন্দরীর পায়ের কাছে গিয়ে আসন গাড়ে। রাতভর চলতে থাকে তার পা ধরাধরি। দলাইমলাই। বেশিরভাগই সুন্দরী তার সঙ্গে শক্তিতে পেরে ওঠে না। গুড্ডু কাঠুরের সারা শরীরে কামড় আর খামচির দাগ। দুটি আঙুলও তার মচকে দিয়েছে। তবুও বেহায়ার মতো রোজ রাতে পিঁপড়ার মতো তার কাছে ছুটে আসে। চড় লাত্থি খায়।
ঠিকঠাক মতো পানিতেও নামে না সে। গোসল তো দূরে থাক। দিনকে দিন নোংরা শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বছরে একদিন চুল কাটায় কি-না সন্দেহ। চুলে জট পাকিয়েছে। মুখ দিয়ে শরীর দিয়ে ভুরভুর করে দুর্গন্ধ বেরোয়। গুল আর পানের উপরেই তার দিন চলে। কোনো অর্থ-কড়ি ডানেবামে মজুদ থাকে না। অসুখ-বিসুখ হলে দিনকে দিন বিছানা কামড়ে পড়ে থাকে। ডাক্তার দেখানোর মুরোদ থাকে না। তার এসব খাছলৎ দেখতে দেখতে সুন্দরীর সবকিছু গা সোয়া হয়ে গেছে।
গুড্ডু কাঠুরে খাওয়াথাকা বাবদ দৈনিক সুন্দরীদের ত্রিশ টাকা দেয়ার চুক্তি থাকলেও আদতে সে সবদিন টাকাটা পরিশোধ করে না। নামমাত্র কখনোসখোনো ১৫/২০ টাকা দিয়ে থাকে। তা-ও অনিয়মিত। বেশিরভাগ সে শুধু মধ্যাহ্নেই খায়। তিনবেলা তার খাওয়ার কথা থাকলেও সে কখনো খায় না। বাহিরে কোথাও খায় বলেও তার মনে হয় না। পানখোর গুলখোর লোকগুলোর বরাবরই ক্ষুধা একটু কম থাকে। সারাদিন কোথায় থাকে, না থাকে ! কী করে বেড়ায় বোঝা মুশকিল। বেশিরভাগই সে গভীর রাত করে ঘরে ফেরে। সুন্দরীর সঙ্গে তার কখনও কথাও হয় না। তাকে দেখলে সুন্দরীর মেজাজ বিগড়ে যায়। তাকে গালিগালাজ করে। গুড্ডু কাঠুরে সেই সময়টা চুপ থাকে। কাঠগোলা থেকে প্রায়শই মালিকের লোকজন তাকে খুঁজতে আসে। কখনোই তাকে কেউ ঘরে পায় না। তবে মধ্যাহ্নে তার জঠরে চর জাগে। সেই মুহূর্তে সে আর না এসে পারে না। চিলের মতো উড়ে আসে। কোনো রকম নাকেমুখে দুটো গিলে আবারও বেরিয়ে পড়ে। ফেরে গভীর রাত্তিরে।
ভাইবোনের ভিতরে সুন্দরীই সবার বড়।
দুই বোনের বিয়ে হয়েছে সৈয়দপুর। তারা অসুস্থ বাবা-মা কে বছরে একবার দেখতে আসে___ তা-ও মহররম মাসে। বেড়িয়ে যায় দু-তিন দিন। বাবা-মা`র মতো তাদের নিজেদের সংসারেও অনেক টানাপোড়েন। অভাবের কারণে তারা বেশিদিন বেড়াতে পারে না। দুএকদিন থেকে চলে যায়। সুন্দরীর বাইতুলফালাহ ক্যাম্পে বিয়ে হয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন বছরের মতো সে ঘর-সংসারও করেছে। সন্তানাদি হয় না। স্বামীর চরম অবাধ্য। নানান অজুহাত দাড় করিয়ে তাকে তার বাবার বাড়িতে ফেলে গেছে। কোনোদিন আর খোঁজখবর নেয় নাই। প্রায় ৫/৬ বছর ধরে সুন্দরী তার বাবার বাড়িতেই পড়ে আছে।
স্বামী মুরাদ আবারও বিয়ে করেছে। সেই ঘরে তার সন্তাদিও হয়েছে। ভাগ্যিস তার নিজের কোনো সন্তানাদি জন্মায় নাই। কোনোদিন আর জন্মাবে বলেও তার মনে হয় না। না হলেই ভালো। গুড্ডু কাঠুরে কোনোদিনও তাকে বিয়ে করবে না। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বছরের পর বছর তার নিষিদ্ধ চোরাকুঠুরিতে কুঠার চালাচ্ছে। সমানে তাকে চিরে যাচ্ছে। সে-ও নিরুপায়। প্রতিদিন চলা কাঠের মতো ফালি হচ্ছে। রক্তাক্ত হচ্ছে। ভালো না লাগলেও কিচ্ছুটি করার নাই। বস্তির লোকজন তাকে জড়িয়ে বিশ্রী সব কথা রটাচ্ছে। সবকিছু সহ্য করে নিচ্ছে শুধুমাত্র তার অসুস্থ বাবা-মা`র কারণে। তাদের ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। গেলে অনেক আগেই যেতে পার তো। স্বামীর ঘরে সবকিছু মুখবুঁজে সহ্য করে হলেও থেকে যেতে পার তো। তা সে থাকে নি।
ক`দিন ধরে গুড্ডু কাঠুরে নিখোঁজ।
একদমই তালাশহীন। কোথাও গেলে সে কাউকে কিছু বলে-কয়ে যায় না। এটা তার বড় একটা খাছলৎ। সুন্দরীর ধারণা তাকে পুলিশে ধরেছে। কারণ মাঝেমধ্যে কাঠগোলায় বসে সে গহীন রাত্রিতক তাস পিটায়। পুলিশ যদিও তাকে ধরে থাকে___ তাহলে তাকে ছাড়াবার কেউ নাই। কাঠগোলার মালিক ইদ্রিস খাঁ কোনোদিন তাকে ছাড়াবে না। এর আগে প্রায় ৩/৪ বার সুন্দরীর বাবা তাকে ছাড়িয়ে এনেছে। এখন আর সে যাবে না। পয়সা ছাড়া থানার মানুষজন কথা শোনে না। কম করে হলেও পঞ্চাশটি টাকা তাদের হাতের মধ্যে গুঁজে দিতে হবে। তা না হলে তাদের সঙ্গে কথা বলার কোনো জো নাই। মান্নান দারোগা আস্তা একটা কুত্তার বাচ্চা। মনুষত্ব কি জিনিস ___এইটা তার ভিতরে নাই। সারাক্ষণ মানুষ পিটাতেই তার হাত নিশপিশ করে। আর পাকিস্তানি বিহারি হলে তো কোনো কথাই নাই। পিটা মারুয়ার বাচ্চাদের!
দুই.
সৈয়দপুর থেকে সুন্দরীর মেজবোন রেশমি আর তার স্বামী নিয়াজ এসেছে। বড় বোনের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তার নিজের ভাসুর চুন্নু মিয়াকে। চুন্নুও বিহারি। সে সেলুনের একজন দক্ষ কারিগর। বর্তমানে সেলুনের কাজে পয়সা বেশি। সেলুন মালিক শমসের আলী রোজকার টাকা রোজই পরিশোধ করেন। ঘরে বাবা-মা ছাড়াও চুন্নুর শুধুমাত্র একটি বোন আছে। গুড়িয়া। বিবাহযোগ্য। যদিও চুন্নু এর আগেও দু`দুটি বিয়ে করেছিল। বর্তমানে তার দুই স্ত্রীর একটিও নেই। একজন তার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে গলায় ফাঁস নিয়েছে। অন্যজন তারই এক ঘনিষ্ট বন্ধু ফুয়াদের সঙ্গে ইটিসপিটিস করে এলাকা ছেড়েছে। এতকিছুর পরেও এলাকায় চুন্নু মিয়ার কদর নেহাৎ কম নয়। চুন্নু মিশুক। দ্রুতই সবার সঙ্গে আলু-পোটলের মতো মিশে যেতে পারে। সে শুধু একটু বয়সেই বুড়িয়েছে___কমতি শুধু এটুকুই। বাকি সব ঠিক আছে। অবিশ্যি এসব ইদানীংকার মেয়েরা দেখে না। তারা দেখে তার বর্তমান আর্থিক সচ্ছলতা, রঙচঙ আর ঝলমলে পোশাক-পরিচ্ছদ।
চুন্নু মিয়ার শুধু চুলে, পোশাক-আশাকে ফ্যাশন নেই__ তার হাঁটার স্টাইলও চোখে পড়ার মতো। সে সিনেমার হিরোদের মতো সানগ্লাস কপালে তুলে হাঁটে। চুন্নুর চিলের স্বভাব। চিলের মতো ছো মেরে সুন্দরীকে উড়িয়ে নিতে এসেছে। প্রথম দর্শনেই তাকে তার মনে ধরেছে। সুন্দরীর শরীর যুতসই। আঁটসাঁট। অতিরিক্ত মেদ নেই। বয়স যেমনই হোক সুন্দরীকে বালিকার মতোই লাগে। এমন একটি মেয়েকেই সে দীর্ঘদিন ধরে তালাশ করছিল। বিবাহের কথাবার্তাও অনেকটা পাকাপোক্ত। কিন্তু বেঁকে বসেছে সুন্দরী নিজেই। অসুস্থ মা-বাবাকে ফেলে সে কোথাও যেতে নারাজ। ঘরজামাই থাকতে চাইলে চুন্নুর বিষয়টি নিয়ে সে ভেবে দেখবে। তার বাবা মঈন কাঠুরে অচল হয়ে পড়েছে। কাঠচেরাই করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি তার শরীরে নেই। অসুখ তাকে ঘুণপোকার মতো খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে। তার একার রোজগারে চুলায় হাঁড়ি চড়ে না। ওষুধপথ্য কেনা তো দূরের কথা। সুন্দরী দুই বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করে যা পায় তা দিয়ে কোনো রকমে তাদের দিন চলে যায়।
চুন্নু মিয়াকে সুন্দরীর মনে ধরলেও তার ভিতরে গুড্ডু কাঠুরেকে নিয়ে একটা বড় ধরনের খচখচানি থেকে যাচ্ছে। শেষে যদি সে তার সর্বনাশের মহাকারণ হয়ে দাঁড়ায়! কোনো ঝামেলা পাকিয়ে বসে! এই ভুল কিছুতেই করা যাবে না। তার আগেই ঘরে একটি মজবুত দরজা বানাবে। এই দরজাটাই হবে তার প্রথম প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের ঢাল। এটা দিয়েই সে গুড্ডু কাঠুরেকে দমন করবে। তার আগে কোনোক্রমেই সে বিয়েশাদির পিঁড়িতে বসবে না।
চুন্নু মিয়া শুধু ঘরজামাই না, বারান্দা জামাই রাখতে চাইলেও সে থেকে যাবে। কারণ তার রূপ-যৌবন দেখে সে উন্মাদ হয়ে গেছে। এমন সুন্দরী একটি মেয়ে সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না।
তিন.
`সুন্দরী! এই সুন্দরী!`
`চিল্লাও মাত! আভি রাত কেতনা হুয়া?`
সুন্দরী চাপা আর ঝাঁঝালো কন্ঠে খেঁকিয়ে ওঠে।
`বহত দিন হো গেয়া তেকো দেখা নেহি। জারাছা দারওয়াজা খোল দোও।`
`কাহে! কাহু দূর মে যাকে মার। আভি দারওয়াজা নেহি খোলেঙ্গে। এতনা দিন কাহা থা?`
`পেহেলে দারওয়াজা খোল উচকা বাত কাহেঙ্গে।`
`নেহি। ছুবা মে খোলেঙ্গে। মেরা ছাদি হো গেয়া হে।`
`জান, তে জুট কিউ বোল রেহে হো?`
`নেহি, ছাচ ছাচ মেরা ছাদি হো গায়া।`
`ম্যায় নেহি মানতা।`
`না মান্নেচে মেরা কা? আভি রাত জানে দো। ঘরমে মেরা পাতি হে।`
`নেহি। বোল ছব জুট হে!`
`জুট কাহে কাহেঙ্গে? ছুবে মে দেখে গা ছাচ হে না জুট হে!`
গুড্ডু কাঠুরে কিছু একটা ভেবে আচানক চুপসে যায়। পরক্ষণে সে বারান্দায় সুন্দরীর বাবার পাশে বালিশ-কাঁথা ছাড়া-ই জীবন্ত লাশ হয়ে যায়। আজ সে ছাইপাঁশ কিছু একটা গিলে এসেছে।
প্রত্যুষে ঘুম ভেঙে সুন্দরী তাকে খুঁজে পায় না। পেলে ইচ্ছেমতো বকে দিত। মধ্যাহ্নেও গুড্ডু কাঠুরে খেতে আসে না। সুন্দরী ভাবনায় পড়ে যায়। কৃষ্ণপক্ষের রাত গভীর হয়। তবুও সে আসে না। তাকে তার অনেক কিছুই বলার ছিল। প্রয়োজন হলে সে তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে। সবকিছু তাকে বুঝিয়ে বলবে। চুন্নু মিয়া লোকটা একটু বয়স্ক হলেও মন্দ না। ভালো। এতটা-ই ভালো যে, বাকি জীবন তার সঙ্গে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেয়া সম্ভব। কারণ এই লোক চরম বউপাগল। পরপর দুটি বউ হারিয়েছে। আর না। এবার সে প্রয়োজনে সারাক্ষণ বউয়ের আঁচল ধরে ঝুলে থাকবে। ডানে যেতে বললে ডানেই যাবে, বামে যাবে না।
কিন্তু গুড্ডু কি তার কথা শুনবে! মোটেও না। এই লোক অন্য দু-দশটা পুরুষের মতো না। এই ভাবনায় সুন্দরীর চোখ থেকে ঘুম উড়ে যায়। সারারাত্তির আর ঘুমাতে পারে না। সে অসুস্থ বাবা-মাকে ফেলে পালাবার কথা ভাবে। গুড্ডু কাঠুরের হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়।
মাত্র ন-দিন আগে তারা বিয়ে করেছে।
চার.
বস্তির ভিতরে কে যেন খুন হয়েছে।
শোরগোল শুনে খুব ভোরেই সুন্দরীর ঘুম ভেঙে যায়। প্রকৃতি রাতে এক পশলা বৃষ্টির সঙ্গে মিহি ঠাণ্ডা বাতাস নামিয়ে মন্দ করে নি। ভালো একটা ঘুমের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে রাত্তিরে তার ঘুমটা হয়েছে ভীষণ আরামদায়ক আর নিদ্রাকুসুম। কিন্তু ক্যাম্পের ভিতরে খুনটা কে হলো! সুন্দরী উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে চোখ রগড়ে তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে। তার চোখভর্তি দুনিয়ার ঘুম। স্বামীকে জাগাতে গিয়ে অকস্মাৎ সে ভুত দেখার মতো আঁতকে ওঠে। চুন্নুর পরিবর্তে তার বিছানায় বেঁহুশের মতো ঘুমাচ্ছে গুড্ডু কাঠুরে। তার শরীর থেকে ভুরভুর করে তাড়ির ঘ্রাণ আসছে। তাড়ি খাওয়া লোক গুড্ডু কাঠুরে নয়। কোথায় পেল সে এতো টাকা! না কেউ তাকে খাইয়ে দিয়েছে! তাড়ি তো দূরের কথা সে তাকে কখনো একটা বিড়িও ফুকতে দেখে নি। আর এখানে সে এলোই-বা কী করে!
নিশ্চয়ই চুন্নু মিয়া মধ্যরাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দরজা খুলে বাইরে গিয়েছিল! আর সেই মোক্ষম সুযোগটা সে কায়দা মতো কাজে লাগিয়েছে। সুন্দরীর ইচ্ছে করছে তার গলা টিপে ধরতে। কিন্তু খবিশটার গলা টিপে কী হবে! তাকে তো সে মারতে পারবে না!
চুন্নুর তালাশে সুন্দরী অস্থির হয়ে বারান্দায় উড়ে আসে। রক্ত মাথায় চড়িয়ে গুড্ডু কাঠুরের কুঠারটা খোঁজে। হারামির বাচ্চাটাকে আজ পাঁঠাবলির মতো এক কোপে দুভাগ করে দেবে। সে মঈন কাঠুরের মেয়ে। সে-ও জানে কিভাবে কুঠার চালাতে হয়! কাঠ চেরাই করতে হয়। কিন্তু প্রয়োজনের সময় কুঠারটা গা-ঢাকা দিয়েছে! গতকাল সন্ধ্যায়ও বারান্দার একদম শেষ মাথায় কুঠারটা সে দেখেছে। এখন গায়েব। গায়েব মানে একদমই নাই। আর এত ভোরে চুন্নু মিয়াই বা গেল কোথায়?
সুন্দরী দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার গলিতে এসে থমকে দাঁড়ায় এবং মুহূর্তেই শুনতে পায় দু`জন মহিলা বলাবলি করছে___বাথরুমের সামনে কে যেন খুন হয়ে পড়ে আছে।
`ইয়ে আদমি সুন্দরীকা নায়া পাতি হেয় কি নেহি?`
`মুজে তো লাগতা হ্যায় এ আদমিই সুন্দারীকা নায়া পাতি হে।`
`পাতা লাগা। সুন্দরী ঘারমে হেয় কি নেহি?`
`ছুবামে ঘারমেই ছো রাহা হোগা আওর কাহা যায়গা!`
সুন্দরী স্পষ্টই শুনতে পেল কিন্তু কথাগুলো তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। উন্মাদের মতো সে এক দৌড়ে জটলা পাকানো লোকগুলো ঠেলে বাথরুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। চুন্নুর পেট চিরে গরুর ভুড়ির মতো নাড়িভুঁড়ি মাটিতে পড়ে আছে। তার মুখের অর্ধেকটা নেই। চলা কাঠের মতো তাকে চেরাই করতে চেয়েছিল গুড্ডু কাঠুরে। কিন্তু তার আগেই চুন্নুর দমের বেলুন ফেটে গেছে। তাকে আর লম্বালম্বি ভাবে দু-ভাগ করে নাই। কুঠারটা বুকের মধ্যখানেই গেঁথে থাকে।
সুন্দরী শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে কুঠারটা টেনে বের করার চেষ্টা করে। পারে না। জটলার কিছু লোক তাকে পেছন থেকে টেনে ধরে।