জাহীদ ইকবালের গল্প ‘ন্যাঙটু’
ছাড়পত্র ডেস্কপ্রকাশিত : নভেম্বর ০৯, ২০২৩
বাবার লিঙ্গে পচন ধরেছে।
পচা ডিমের মতো অণ্ডকোষ দুটো পুরোপুরি ফেটে গেছে। অগণন মাছি তার ওপর ভনভন করছে। তিন চার হাত জায়গাজুড়ে চলছে তাদের মচ্ছব। বাবার সম্মুখস্থলে মুখথুবড়ে পড়ে আছে নতুন পুরাতন টাকার স্তূপ। সবই ভক্তদের দান-খয়রাত। টাকার ওপর রাজ্যের ধুলোবালুর আস্তরণ। এসব অর্থকড়ি বাবার কোনো কর্মে আসে না। মূলত ভক্তরাই সবকিছু ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে বাবা শুধু টাকার পাহাড়ে থুতু ছোড়েন। ভক্তরা যেটাকে আশির্বাদ মনে করে তুষ্ট থাকে। বাবা দুনিয়ার অর্থ-সম্পদকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য জ্ঞান করেন। ভক্তরা এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস ক`রে রুজিরোজগার, ঘর-সংসার ত্যাগ করে বাবার আস্তানায় শিকড় গেড়েছে।
বাবা খানাপিনা ছেড়ে দিয়েছেন। ইদানীং তিনি কোনো ভক্তকে সহ্য করতে পারছেন না। চরম বিরক্ত হয়ে তাদের দিকে বেশি বেশি থুতু ছুড়ছেন। ভক্তরাও নিজেদের মহাপাপী মনে করে কিছুদিন ধরে তার পাশে নিরাপদ দূরত্বে আশ্রয় নিয়েছে। বাবা শীঘ্রই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবেন, এটা তারা বুঝে গেছে এবং তারা মহাচিন্তারোগে আক্রান্ত। বাবা দেহত্যাগ করলে তার মাজারটা কোথায় স্থাপিত হবে! ফুটপাথ! অসম্ভব। সরকার কোনোক্রমে এখানে বরদাস্ত করবে না। সরাসরি বাবাকে আজিমপুর গোরস্থানে চালান করে দেবে। ভক্তরা শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের জীবন চলে যাবে তবুও তারা বাবার লাশ অন্য কোথাও দাফন হতে দেবে না।
বাবার জন্মভূমি খুলনার হরিণটানায়। পরকীয়ায় গা ভাসিয়ে আরম্ভে নিকাহ করেছিলেন চাচাতো বোন মোমেনা বেগমকে। দ্বিতীয় নিকাহ করেন জিঞ্জিরার প্রয়াত ফজর আলীর কন্যা স্বামীপরিত্যক্তা মর্জিনা বিবিকে। বাবার বাবা মতি মিয়া ছিলেন একজন বাউলশিল্পী। চারখানা বিবাহ করেছিলেন। বাবার দাদাজান তিনখানা। বাবা তার বাপ-দাদার খান্দানি ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য পাঁচখানা বিবাহ করার স্বপ্ন পোষণ করেছিলেন। সেই স্বপ্ন তার পূরণ হয় নাই। কালক্রমে তিনি এখন ন্যাঙটু বাবা। পচন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
সাতাশ বছর আগেকার কথা। বাবা থাকতেন মোহাম্মদপুরের এক বস্তিতে। নামমাত্র কখনোসখনো তিনি রিকশা চালাতেন। বড়বিবি থাকে রায়ের বাজার বক্কর বস্তিতে। এক শীতের রাত্তিরে তিনি কামের তাড়নায় মোমেনার কাছে ছুটে আসেন।
বেলাউজের বোতামগুলান ছিঁইড়া ফ্যালাইলা!
হয়, মোন চাইচে ছিড়চি।
আমারে কইলি তো আমিই খুইলে দেতাম।
তর সইছিলো না বোউ...।
তা সবে ক্যান! খাতি-পরতি দিতি পারো না, খালি ওইডা-ই ভালো পারো।
দ্যাক মাগী, মুক চালাবি না কলাম! তালি কিন্তুক আমি...
তালি কী অরবা, মারবা? এইডা ছাড়া তুমি আর পারোডা কী এ্যা?
না, মারবো না নে, তোমারে খালি চুমা খাবো আনে!
বাবা তিরিক্ষি মেজাজে গামছার মতো করে কাঁধে শার্ট চড়ায়। পেঁয়াজ কালার শার্টটি সে চোরাই মার্কেট থেকে খরিদ করেছিল। হুট করে শীত বেশি পড়ায় শার্টটি আর তার গতরে চড়েনি। শীতে এই শার্ট গতরে চড়ানো মুশকিল। শীত যেন আরও বেশি লাগে। তবুও শখের শার্ট বলে কথা! ফেলে তো আর দেয়া যাবে না!
বাবা দরজায় পা বাড়াতে যাবেন, সেই মুহূর্তে মোমেনা তার হাত ধরে বসে। দরদমাখা গলায় ঠোঁট চালায়, এত রাত্তিরে আবার যাতিচো কহানে?
মরতি যাতিচি। যাবি আমার সাতে?
দ্যাহো কইতুরীর বাপ, তুমি কিন্তুক যাবা না!
মোমেনা, লুঙ্গি ছাইড়া দে কইলাম!
ছাড়বো না। মারবা আমারে? মারো। তালিও এত রাত্তিরে তোমারে আমি যাতি দেবো না নে। ম্যালাদিন পর আইছো। দুই- চাইরডা কতা কবা। ভালো-মন্দ জিগাবা। তা না ঘোঁৎ ঘোঁৎ কইরে যাতিছো।
না, আমি তোর এহানে থাকপো না। তুই খালি কতায় কতায় আমারে ইজ্জত মারিস। আমার এট্টা ইজ্জত আছে না!
আহারে আমার ইজ্জতঅলা বেডারে! কাম-কাইজ অরে না। বাদাইম্যার মতন খালি ঘুইরা-ঘাইরা বেড়ায়। বোউ পোলাপানরে খাতি-পরতি দিতি পারে না। হ্যায় আবার ইজ্জতঅলা বেডা!
মোমেনা মুখ ঝামটি মারে। বাবা ঘাড় কাত করে উত্তেজিত ভঙ্গিতে মুখ চালায়, দ্যাক মোমেনা, তুই কিন্তুক আবারো আমার ইজ্জত মারতিছিস!
আর মারবো না নে! তুমি এহানে বও।
মোমেনা হাত ধরে আদর করে বাবাকে মাদুরে বসায়। তাতে করে বাবার অভিমান কিছুটা মাটিতে পড়ে।
কাগজে কইরে এট্টু আগুন দে দিহি, বিড়ি খাবো।
এহোন তোমারে আমি বিড়ি খাতি দেবো না নে! খিলিপান বানায়া দিতিছি। ঠোঁট রাঙাইয়া খাইও।
মোমেনা লাজুক হাসে। বাবা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলে, কইতুরী কহানে গেইছে?
সইন্ধ্যার সোমায় ওর বেডা আইছিলো। ওরে লইয়া গেইছে। ওর বেডা তোমার মতন বাদাইম্যা না। আর বাদাইম্যা অইলিও মাইয়াডারে সাতে সাতে রাহে। বোউ ছাড়া স্যার নাকি এক রাত্তিরও চলে না।
তুই আবারো প্যাঁচাল শুরু অইরে দিলি! এট্টু ঘুমাতিও দিবি না?
বাবা জিদ করে বিছানায় উঠে বসে। মোমেনা সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ধরে ফেলে, কইতুরীর বাপ!
কও শুনতিছি।
আমারে এট্টু জড়াইয়া ধইরা শোও। আমার ম্যালা শীত অরতিছে!
তোরে ধরলি আমার আর ঘুম অবি না নে!
এক রাত্তির আমার জন্যি না ঘুমালি কিছু অবি না!
ঢঙের কতা রাইহে ঘুমা মাগী। তা না হলি আমি কিন্তুক এহনি মর্জিনার কাছে চইলে যাবানি! মর্জিনা তোর মতন কতায় কতায় বায়না ধরে না।
বাবার মুখে মর্জিনার কথা শুনে মোমেনা দাড়াশ সাপের মতো ফুঁসে ওঠে, কী কইলি! আমার চাইতিও ঐ মাগী ভালো? এহনি আমার বিছান দিয়া ওড। ওড কতিচি! আর কোনো সোমায় তুই আমার ধারে আসপি না।
বাবা আবারও শার্ট হ্যাঙারের মতো কাঁধে চড়ায়, কেডা আসে তোর এয়ানে! তুই তো মাগী আমার পা ধইরে টাইনে আনিস!
তুই আমার ঘর দিয়া বাইর অ, চুতমারানির বাচ্চা! তোর মতন বাদাইম্যা ভাতার থাহা না থাহা সোমান কতা। বাসা-বাড়িতে কাম অইরে খাই, সেইডাই ভালো।
আচ্ছা -আচ্ছা, আমিও দ্যাকপানে মাগী। তুই রাইতে কোন ভাতারের সাতে গলা জড়াইয়া শুইয়া থাহিস!
চোট্রা বেডা, আমি তোর মতন লুইচ্চা না।
হ হ দ্যাকপানে মাগী... দুইডা দিন যাউক না!
বাবা লম্বা লম্বা পা ফেলে গালিগালাজ করতে করতে দ্রুত বস্তি থেকে বেরিয়ে যায়। মোমেনা থামে না। সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চড়া গলায় ক্রমাগত খিস্তিখেউড় করতে থাকে।
গুদারাঘাট বস্তির লোকজন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। কয়েকটি নেড়ি কুকুর কিছুদূর বাবার পেছন পেছন হেঁটে এসে হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে যায়। বাবার যে আজ মন খারাপ এটা তারা আরম্ভেই আঁচ করতে পেরেছে। বাবার হাতে কোনো খাবারও নেই। তার মানে বাবার পকেটের অবস্থা রুগ্ন। সে আজ তাদের সঙ্গে ভালো-মন্দ বাত-চিতও করেনি।
তুমি না কইলা আইজ আইবা না! আইলা ক্যালা? অহোন রাইত কয়ডা বাজে? কৈতুরীর নাম কইরা কোন মাগীর কাছে গেছিলা! ওই তুমি কোনো কতা কইতাছো না ক্যান?
মর্জিনার কথা শুনে বাবা চেঁচিয়ে ওঠে, তুই দুয়ার খুলবি না লাত্থি মাইরা ভাঙবো!
ভাঙ্গো, ভাইঙ্গা ফালাও। মাগার আমি দরজা খুলবার পারুম না।
মর্জিনা, শীতের মদ্দি আমার কিন্তুক মেজাজ খারাপ হতিছে!
হউক, তুমি এট্টু দোয়ানে যাও।
এত রাত্তিরে আমি দোয়ানে যাব ক্যান?
যাইবার কইছি যাইবা। আমার বড়ি লাগবো।
আইজ এক রাইত বড়ি না খালি কিছু অবি না নে! আর আইজ আমিও তোরে ছোঁবো না নে!
বাবার কথা শুনে মর্জিনা ইটভাঁটার মতো জ্বলে ওঠে, কী কইলা! আইজ আমারে ছুঁইবা না? যাও তালি, দরজাও আমি খুলবার পারুম না।
মর্জিনার কথাবার্তা সন্দেহজনক। নিশ্চয় ঘরে কোনো পরপুরুষ ঢুকিয়েছে। বস্তির চিকনা, কালাপাঠা ছাগিরকে সে সন্দেহ করে। বাবা টিনের দরজায় সজোরে একের পর এক লাথি বসায়।
তুই এতো বাহানা মারাইতিস ক্যান! ঘরের মইদ্যি কোন নাঙ্গেরে সান্ধাইছিস! মনে অরিছিস তোর এই তালবাহানা আমি ধরতি পারি নাই? আমি ঠিকই ধরতি পারিছি। কতিছি জলদি দুয়ার খোল, মাগী।
তুমি আবার ধরবার পারবা না! তুমি তো এট্টা...
বাবা রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে ওঠে, মুক বোন্ধ অইরে ভালোয় ভালোয় কতিছি চেরাগ ধরা। চেরাগ কহানে রাহিছিস?
চেরাগে ত্যাল নাই। অহন আবার বাত্তি জ্বালাইতে অইবো ক্যান?
দ্যাকপো না, ঘরে কোন নাঙ্গেরে সান্ধাইছিস! আইজ যুদি কালাপাঁঠা ছাগীরারে পাই, তালি কলাম মাগী তোরে খাইছি! এই তোরে আমি দেকতেছি না ক্যান!
আন্ধারের ভিতরে ক্যামতে দ্যাকবা! দুয়ার দিয়া সইরা খাড়াও।
কথাগুলো বলতে বলতে মর্জিনা হাত রাখে বাবার অণ্ডকোষে। বাবা চিৎকার করে ওঠেন, এই, এই মর্জিনা, আমার বীচি ছাইড়ে দে, আমি কলাম মইরে যাবানি!
মরার লাইগা-ই তো তোমার বীচি ধরছি। ছাগীর মিয়া, এই ছাগীর মিয়া, বিড়ালের লাহান পালাইয়া রইছো ক্যান? বাইর অইয়া আহো। মাঙ্গেরপুতরে জবাই করণ লাগবো। জলদি আহো।
মর্জিনা, আমারে তুই মারিস না বোউ। আমি বাঁচতি চাই।
তোমারে যে আর আমি বাঁচবার দিমু না, মফিজ মিয়া!
ক্যান, আমারে তুই বাঁচতি দিবি না ক্যান?
এইডা তুমি বুঝবার পারো না! অহন বুঝবা মফিজ মিয়া।
বোউ গো, এহন বুঝছি। তুই আমার ধর্মের মা, আমার জীবনডারে খয়রাত দে। আমি বাঁচতি চাই, আমি...
হা হা হা মফিজ মিয়া, তুমি পরনের লুঙ্গিখানা নিবা না? ন্যাঙটু অইয়া দৌড় পাড়তাছো!
মর্জিনা কৈ মাছের মতো খলবলিয়ে হাসে। ক্রমাগত হাসতেই থাকে। বাবা শখের শার্ট, ইজ্জতের লুঙ্গির দিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। জীবন বাঁচানোর জন্য রাতের নিকষ অন্ধারের পেটের ভেতর দিয়ে দৌড়াতে থাকে...
লম্বাটে আর ভাঙাচোরা চেহারার বাবা মফিজ মিয়া সেই রাত থেকে ন্যাঙটুই থেকে যায়। কাপড় পরিধানের বাড়তি ঝুট-ঝামেলা থেকে সে মুক্ত হয়। মাথার জটালো চুল, দাড়িগোঁফ এবং নিম্নাংশের আফ্রিকার জঙ্গলেও সে কখনো ব্লেড-কাঁচি চালায় না। দিনে দিনে ওরা বাড়তে থাকে। লজ্জাশরমের আর কোনো বালাই থাকে না। বরং প্রকাশ্যে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সে উত্থিত শিশ্নে বেদম হস্ত চালায় আর তরমুজের বীচির মতো দাঁত কেলিয়ে হাসে। ভেবেছিলো জীবনে আর কোনোদিন কোনো মেয়েমানুষের সান্নিধ্যে যাবে না। কিন্তু সে পারে না। কখনোসখনো শহর ঘুমিয়ে পড়লে বড়বিবির শরণাপন্ন হয়। বড়বিবি মোমেনা যৌনতাড়নায় মাঝে-মধ্যে তাকে বুকে টেনে নেয়। শরীরে শার্ট-লুঙ্গি পরাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। পারে না। বাবা বিকৃত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে ছুটে আসে জনসমুদ্রে...।
চরম উৎকণ্ঠায় আশেকানদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে। কারো চোখে নিদ্রা নাই। ভক্তদের শরীরে থুতু ছোড়া বন্ধ করে বাবা হাত-পা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুঁজেছেন। খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে অন্য ভক্তদের মাঝেও। ভক্তরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে আরম্ভ করায় পথচারীদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে কিছুক্ষণের ভেতরে রাস্তার গাড়ি চলাচলও বন্ধ হয়ে যাবে। থানায় খবরটা পৌঁছাবার আগেই গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। ভক্তরা পুলিশের উপর চড়াও হয়ে সমস্ত পুলিশ এলাকা ছাড়া করে।
গাড়ি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ। রাত এখন দুইটা পঁয়ত্রিশ। বেশিরভাগ ভক্তরা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। দু`চারজন এখনো জেগে আছে। বাবা বেঁচে আছে না মেঘের ওপারে চলে গেছে, এ খবরটা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারে না। কারণ বাবার আশেপাশেও কেউ ভিড়তে সাহস পায় না।
আচানক বিদ্যুৎ চলে যায় এবং পুনরায় ৫/৬ মিনিটের ভেতরে চলেও আসে। চতুর্দিকে দিনের মতো আলো ফোটে। অবাক করা জোছনা ফোটে। অকস্মাৎ ভক্তরা টের পায়, বাবা আর তাদের মাঝে নাই। বাবা যে জায়গায় শুয়েছিলেন, সেখানে এখন অগণন মাছি ভনভন করছে।
বুক চাপড়ে কপাল ফাটিয়ে আশেকানদের কান্নার মাতম চলে তিনদিন। বাবাকে আল্লাহপাক সাত আসমানে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। বাবার রুহের মাগফিরাত কামনা করে ভক্তরা বাবার গায়েবি জানাজা পড়ে। বিশাল মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, বাবার মাজার হবে ঠিক সেখানটায়, যেখানে বাবা দিনরাত্রি শুয়ে-বসে থাকতেন।
যথাসময়ে ইট-বালু, সিমেন্ট, টাইলস আনা হলো। মিস্ত্রি মাজারের নকশা এঁকে যখনই ইট বসাতে যাবেন, সেই মুহূর্তে থানার ওসি বাদল ইবনে মনসুরসহ প্রায় পুরো ফোর্স এসে হাজির।
আপনারা ফুটপাথে ইট বসাচ্ছেন কেন?
ভক্তরা একত্রে সবাই শোর তোলে, এখানে বাবার মাজার হইবো।
কোথায় আপনাদের বাবা?
বাবারে আল্লায় সাত আসমানে উঠাইয়া নিয়া গেছে!
তাহলে এখানে এখন দাফন করবেন কাকে?
কেন, আমাদের বাবারে!
বাবা কোথায়?
উত্তেজিত গলায় একজন ভক্ত বলে ওঠে, কইলাম না, বাবা এখন সাত আসমানে!
তাহলে তো বাবার মাজারটাও সাত আসমানে গিয়ে বানানো উচিত! কী বলেন আপনারা?
বাবারে নিয়া মজা লইতাছেন! এই মজার শাস্তি সময়মতন পাইবেন। বাবা-ই দেহাইবো।
প্লিজ, আপনারা এখানে অযথা ঝামেলা পাকাবেন না। তাহলে আমরা কিন্তু আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।
ওসি বাদল ইবনে মনসুরের কথায় ভক্তরা চটে গেল। শুরু হলো ভক্ত-পুলিশের মাঝে হাতাহাতি, ধস্তাধস্তি।
নিজের জান দিয়ে শহিদ হইয়া যামু, মাগার বাবার মাজার আমরা এইখানেই বানামু।
ভক্তরা এবার অবিশ্যি পুলিশের সঙ্গে পেরে ওঠে না। পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ করে ভক্তদের ছত্রভঙ্গ করে এলাকাছাড়া করে। কিছু ভক্তকে গ্রেপ্তার করে থানায় পোরে। বাবার আস্তানায় কারফিউ জারি করে পুলিশ সমস্ত আস্তানা ঘিরে রাখে। কেউ আস্তানার ধারে-কাছে গেলে পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।
হঠাৎ কিছু উগ্রমেজাজি ভক্ত চড়াও হয়ে পুলিশের দিকে এলোপাথাড়ি ইটপাটকেল ছুড়ে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তোলে। সেই সঙ্গে খাকি পোশাকের সংখ্যা লাল পিঁপড়ার লাইনের মতো ক্রমশ বাড়ে, বাড়তেই থাকে।
পরেরদিন সকালে ভক্ত এবং বাবা-বিষয়ে পুলিশের জরুরি বৈঠক বসে।
প্রথমত বাবাকে আমাদের গুম করা মোটেও উচিত হয়নি। ভক্তরা এখন ভাবছে, সত্যিই বাবা একজন কামেল পীর। প্রকৃতপক্ষে বাবা একজন ভণ্ড।
সেকেন্ড অফিসার কামরান, ওসি বাদল ইবনে মনসুরের কথায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
স্যার, বাবাকে ফেরত দেয়াটা কি এখন আমাদের উচিত হবে?
একদমই না। আর দিলেও কোনো কাজ হবে না। বিরোধীদল হন্যে হয়ে ইস্যু খুঁজছে। এমনিতেই এই সরকারের নামে বদনাম আছে, তারা নাকি কথায় কথায় আলেম ওলামাদের জেলে পোরে! বলা যায় না, বিরোধীদল হুট করে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে পূর্ণদিবস হরতাল ডেকে বসতে পারে। তাহলে তো বুঝতেই পারছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিটা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে!
একজন এসআই বললেন, স্যার, তাহলে এখন আমরা কী করবো? ভক্তরা তো থামছে না। জীবন বাঁচানোর জন্য কোনো পুলিশ যদি হুট করে কোনো ভক্তকে গুলি করে বসে!`
সাবধান! ভুলেও এই ভুল করা যাবে না। কোনো লাশ পড়লেই বিরোধীদলকে আর কোনোক্রমে দাবিয়ে রাখা যাবে না। ওরা জোয়ারের মতো ফুঁসে উঠবে।
বৈঠকে সবাই নড়েচড়ে বসে।
বর্তমানে বাবার খবর কী?
স্যার, বাবা বোধহয় আর বাঁচবে না। তার অবস্থা খুবই নাজুক। তার শরীর থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
বিষয়টা তাহলে এক্ষুণি ডিএইজি স্যারকে জানিয়ে রাখি!
জ্বি স্যার, জ্বি স্যার।
বাবার লাশ যে পুলিশ গুম করেছে, এই খবর গোয়েন্দা মারফতে ভক্ত এবং বিরোধীদলের কাছে ছড়িয়ে পড়তেই রাস্তায় লক্ষ লক্ষ ভক্ত- আশেকানদের ঢ্ল নামে। ঢ্ল এসে থামে থানার সামনে। স্লোগান ওঠে, `খুনি সরকারের পতন চাই/ বাবার লাশ ফেরত চাই...
ডিআইজি স্যার বাবাকে সহিসালামতে ফিরিয়ে দিতে বললেন। কিন্তু বাবা কোথায়! হাসপাতালের কোথাও বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।