জাহিদ সোহাগের গল্প ‘বন্দুকের নল’
প্রকাশিত : মে ৩০, ২০২১
মাও সেতুং বলেছেন, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। এই কথাটা মাওবাদী ছাড়া সবাই চর্চা করে; তবে মাওবাদীরা চর্চা ও স্বীকার দুটোই করে, এজন্য আমি নিজেকে মাওবাদী মনে করি। আমি মনে করি, আমি নিরস্ত্র আছি বলেই সামান্য কোলাহলেই গলে যাই। আমার কণ্ঠ তারায় ওঠে না। উদারা থেকে নেমে আরো নত হতে চায়। আমি নত ওই শব্দাবলিকে লাত্থি দিলে অসুস্থ নেড়ি কুকুরের মতো কুঁই কুঁই করলেও মাথা তুলতে পারে না। তুললেও ধ্বনিগুলো ফেভিকলের কৌটার মধ্যে পড়ে যায়। না বলে, প্রতিবাদ না করে, মেনে নিতে নিতে, এই যেমন ক্ষমতাসীন একটা বদমাশ দেখেও কেমন জানি সম্ভ্রম জাগে। কিন্তু মানুষের রক্তে স্থিতি নেই। সেক্স আর বন্দুক দুটোই নিজের রাগ মোচন করে বাইরে। অন্যের সঙ্গে। এই অন্য বা অপর আমার সামনে থেকে মুছে গেছে। বা যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করলেই একটি একনলা বন্দুক চোখে দেখি। পুরাতন কিন্তু মসৃণ। মাথায় বারুদের গন্ধ। আমি প্রতিদিন তাতে তেল মর্দন করি। সাদা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করি। নল ভেঙে গুলি ঢুকিয়ে ট্রিগার চাপি। নলের মাছিতে কোনো দ্বিধা নাই। চোখ বন্ধ করেও গুলি ছুড়লে যে কয়টা মরবে, তাদের মরবার যথেষ্ট কারণ অবশ্যই থাকবে। আমি আমার বন্দুক সেনাপতির কাঁধে দিয়ে ঘুমাই। সেনাপতি সারারাত জেগে থাকে। সকাল বেলা আমি হাতে নেই। আবার রাত হলে তার হাতে দিয়ে ঘুমাই। আমি মনে করি, সেনাপতি বন্দুকের আনুগত্য করতে করতে বাটের মতো কাঠ হয়ে গেছে। আমি ওর ইউনিফর্মে ব্যাচ পরিয়ে দিই, পয়সাকড়ি দিই, বিদেশ ভ্রমণ দিই, বউবাচ্চাশালীদের সুখ দিই। কিন্তু সেনাপতির শরীর যেহেতু কাঠ না, রক্ত চলাচল করে, সে আমার দিকে রাতে, বেশিরভাগ হত্যা রাতেই হয়, গুলি ছুড়ে দেয়। লোকে আমার ছবি মাথার উপর টাঙিয়ে রাখে। সেনাপতিকে গালাগাল দেয়। আমি জানি, আমার ক্ষমতা সবটুকুই ওই সেনাপতির। বন্দুকের মাছিতে যে চোখ সেটা আমার, ট্রিগারের আঙুল আমার। ওই বাঞ্চোতের পোশাকও নেই। জাইঙ্গাও নেই। আমার পয়সার কেনা কনডম বিছানায় দুই হাঁটুর উপর ভর দিয়ে সে পরে নেয় দ্রুত। তাই গুলি খেলেও আমি কিছু বলি না। আমি জানি ও ভুল করেনি। ক্ষমতা সবসময়ই নতুন সঙ্গী চায়। সে পঙ্গু হোক আর কুস্তিগীর হোক। বন্দুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমি কোনো আইন মানি না। আমার ইচ্ছাই আমার আইন। বা না থাকলে সেরকম করে লিখে নাও। আমি যখন সদর দফতরের সামনে দিয়ে ঘেমে ঘেমে হেঁটে যাই তখনও আমি কোনো আইন মানি না। আমার বন্দুক একেকটা খুলি তরমুজের মতো উড়িয়ে দিতে থাকে। যখন আমরা মুখোমুখি হই তখন বলি, আচ্ছা আসো ডুয়েল লড়ি। ডুয়েল লড়া খুবই রিস্কি। একে তো নিজেদের মরার চান্স বেশি, তারচেয়ে আমার মধুচক্রে যারা যারা আছে, বা পাবলিক, ওরা মরুক। ওরা মরবে বারবার। আমি মরবো একবার। তাই আমার বেঁচে থাকা দরকার। আমি চাই ওরা একটা সুরারোপিত কবিতা গেয়ে গেয়ে কাঁদুক; কেনো কেতাবের কালো অক্ষরের জন্য রক্ত ছিটাক। যেভাবেই হোক ওরা ব্যস্ত থাক পরস্পরকে কামড় দিতে।
আমার কথাবার্তা শুনে ভূত বলে আমি নাকি এনার্কিস্ট, মাওবাদী না। তাতে আমার বাল ছেঁড়া।
১৫ টাকার একটা সিরাপের জন্য আমি এইমাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মুখ কল্পনা করে ১২/১৩ টা দোকানদারের খুলি উড়িয়েছি। আমি খুচরা দিতে পারবো কি পারবো না এই ভেবে প্রত্যেক দোকানদার আমাকে ‘না’ বলে দিয়েছে। সন্ধ্যায়, চারদিকে মাগরিবের আযান হতে থাকা বিষণ্ন সময় ‘না’ আমাকে পাঁকে পাঁকে ঘিরে ফেলে। একজন দিশেহারা আমাকে দেখে বলে, ১৫ টাকা খুচরা থাকলে দিতে পারি। আমি চেপে ধরি, সবাই ‘না’ বলছে কেন? সামান্য লাভ এজন্য কেউ রাখে না। রাখলেও খুচরা নিয়ে ঝামেলা তাই না বলে দেয়। এক ছিপি শিশুকে খাওয়ানোর পর প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দেখি ভেজাল ওষুধ। বমি করলে ভালো। নইলে যা হয় হোক। এসময় আমার মনে ভাসতে থাকে ১৯৮৯ সালে ভেজাল প্যারাসিটামল খেয়ে তিন বছরে দু’হাজার সাতশো শিশু মারা গেছে। আবার ১৯৯২-৯৩ সালে ২২টি শিশু মারা যায় কিডনির সমস্যায়।
ভূত বলে, ‘আইন?’
আমি বলি, ‘ওই দাড়িপাল্লামাগী কি বিচার করেতে পারে?’
তদন্ত কমিটি: মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় সুদৃষ্টি দিলে... বা তদন্ত কমিটির লোকজন আদর্শবাদী = শূন্য।
পুলিশ: ওই বন্দুকওয়ালার সবচেয়ে নিকৃষ্ট পদলেহী... কবর থেকেও পুলিশ ঘুষের বখরা পায় = শূন্য।
ওষুধ প্রসাশন: চাটতে চাটতে অন্য কাজ করার বা কথা বলার অভ্যাস হারিয়েছে = শূন্য।
দৃশ্যপটের বাইরে আছেন মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়। তার আছে পিএস। আছে তার দল। আছে তার বল। আছে তার হুঙ্কার। আছে তার আদর্শ। আমি মনে মনে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের একটি সাক্ষাৎকার নিই। তিনি পাঁচতারা হোটেলের একটি ভিআইপি লাউঞ্জে বসে আছেন স্বচ্ছ কাচের ওপাড়ে সুইমিংপুলের টলটলে পানির দিয়ে তাকিয়ে।
মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়: এক লক্ষ তিরিশ হাজার, নয় লক্ষ বিশ হাজার, ছয় কোটি তিরিশ লক্ষ... হাজার টাকায় এক্সরে কিনেছি, সিরিঞ্জ কিনেছি... এক লক্ষ তিরিশ হাজার, নয় লক্ষ বিশ হাজার, ছয় কোটি তিরিশ লক্ষ... হাজার হাসপাতালে ১০ টি বিছানা উঁচু করেছি... এক লক্ষ তিরিশ হাজার, নয় লক্ষ বিশ হাজার, ছয় কোটি তিরিশ লক্ষ... হাজার ডাক্তার নিয়োগ দিয়েছি, এক লক্ষ তিরিশ হাজার, নয় লক্ষ বিশ হাজার, ছয় কোটি তিরিশ লক্ষ... হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছি, এক লক্ষ তিরিশ হাজার, নয় লক্ষ বিশ হাজার, ছয় কোটি তিরিশ লক্ষ... হাজার মানুষের দোরগোড়ায়...মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়...
মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় সুগার ফ্রি জুসে চুমুক দেন।
আমি: স্যার, ওষুধ প্রশাসন গাফলতি করেছে। ঠিকমতো রির্পোট দেয়নি। আপনি জানেন?
মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়: ওই লর্ড ক্লাইভ যখন ক্ষমতায় এলো, আপনারা জানেন, বিষ আর ওষুধের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। আমরা ইনশাআল্লাহ জনগণের সহযোগিতায় মানুষের মুখে ওষুধ তুলে দিয়েছি। কিন্তু লর্ড ক্লাইভ বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে...মার্কায় ভোট দিয়ে...হাতকে শক্তিশালী করুন। ইনশাআল্লাহ আপনারা আছেন...
এসময় লর্ড ক্লাইভ হাজির। ‘নারী লোলুপ সিরাজ আর মিত্ররা এদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করতে যে ফরমান জারি করেছে তাতে মানুষের বেঁচে থাকাই কঠিন ছিল। তাই জনগণের সহযোগিতা নিয়ে, রাজদরবারের বিচক্ষণ ব্যক্তিদের নিয়ে... তার কথা শেষ না হতেই সিরাজ এসে হাজির। এদিক ওদিক তাকিয়ে ‘নবাব আলিবর্দি খাঁ আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। কিন্তু কতিপয় লোক...
আদম ও হাওয়া হাজির। আদম হাওয়াকে লক্ষ্য করে বলে, ‘মাগী তোর লেইগা গন্দম খাইছি। এখন গুয়ের পৃথিবীতে ডুইব্যা মরি।’ হাওয়া ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, ‘সব দোষ আমার? শয়তানে কুমন্ত্রণা দিছে ক্যান?’ এবার ঈশ্বর ও শয়তান মুখোমুখি।
আমি মাননীয় মন্ত্রীর ঠোঁটের কষ টিস্যু দিয়ে মুছিয়ে বলি, ‘স্যার আপনার সঙ্গে আমি ডুয়েল লড়তে চাই।’ মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় এবং আমি ডুয়েল লড়তে শুরু করলাম। সেনাপতি বললো, দাঁড়ান স্যার, আমার কাঁধে বন্দুক রাখুন। রাখা হলো। সেনাপতি বললো, দাঁড়ান স্যার, আমার আঙুল ট্রিগারে রাখি, আপনি আঙুল দিয়ে নির্দেশ দিন। নির্দেশ দেয়া হলো।
ভূত বললো, এভাবে আমরা ক্ষমতাতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করি।
আমি আমার বন্দুক আঁকড়ে ধরেছি। বন্দুক আমার প্রাণভ্রমরা। আমি এখন বন্দুকের নল চাটি। চুষি। যেভাবে সানি লিওন চাটেন। চোষেন।