জাহিদ জগৎ

জাহিদ জগৎ

জাহিদ জগতের ৬ কবিতা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৫, ২০২৫

শীত ও ফুটপাতের গল্প

এইডা ফুটপাত মিয়াভাই, এইখানে শীত একটা অভিশাপ
পাপ তো ব্যাকেই করে, ব্যাকেই কি আর গঙ্গা চরে!
ধরে শুধু হাড় কঙ্কালে।
এই যে শীত! শীত শীত খেলা, বাড়ি পালানো সন্ধ্যাবেলা
ল্যাপের মইদ্যে, কম্বলের মইদ্যে
ঘষাঘষি খসাখসি, বালিশ লইয়া তাপের স্বপন
শ্যাষ রাইতের ভাঙনদোষে আত্মলেহন
সবই আপনাগো সুসংবাদ।
টিভি-টুভি-খবরঅলা, সবাই আপনাগো রানের যত্নে,
ঠোঁটের যত্নে, ভাতারবিহীন চ্যাটের যত্নে
খালি গরম আর গরম বিলায়া যায়—
আপনারা গরম হইতে হইতে ভিইজ্যা পানি অইয়া যান,
এই শীতের রাইতে, এই শীতের রাইতে
হেই পানি লাগে আমাগো গায়, মধ্যরাইতের
ঝড়ের মতোন, বিরাট দুই ডানাঅলা চিলের মতোন
খাবলায় বুক, সুঁই ফুটায়
হাড়ে-হাড্ডিতে কম্পন ওঠে, বুকের বাচ্চা খইসা পড়ে
পাত্তরে, মাটি নাই কোথাও
এই শহরে মাটি পাইবেন কই, আমার বুক ছাড়া?
সবহারারও যে জীবন আছে, এইডা আপনারা জানবেন কেমনে?
কেমনে জানবেন, জীবন কোথায় জীবনহারা?
সর্বনাশের ব্যাবাক রাইতেই উড়ায়া নেয় শীতের বাও
কেউ জানে না, নাঙ্গের আশায়— সাঙ্গের আশায় না
খালি ইট্টু ওমের আশায়
বুকের মইদ্যে চাইপ্যা ধইরা মাইরা ফেলছি কোলের ছাও।

ফুরিয়ে যাবার আগে

পরিতৃপ্ত হে জন্মভূমি—
মুছে দাও ক্লান্তির চিহ্ন, কাঁধের অগুণতি পরিণয়
অতৃপ্তি নিয়ে যে কবি বৃষ্টির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে থামাও।
মানুষের কান্নাকে আড়াল করো না হে জননী, যেভাবে লুকিয়ে আছে ইয়াজিদের ইতিহাস।
আমাদের কাঁদতে দাও— বলতে দাও
এই নদী কেবল জলের প্রবাহ নয়। আমাদের ভেঙে যাওয়া হৃদয়ের একমাত্র সন্ধান।
এই বনরাজি আর বোস্তামির কুমিরেরা নিঃস্পৃহ ছিল না কখনোই—
আর আমরা আমাদের নির্বাণের অর্থ করেছিলাম, অতৃপ্তির ওপর দাঁড়িয়ে
আমাদের পরিজনেরা যখন হেলে পড়েছিল পশ্চিমের লালিমার দিকে
আমরা কেমন ধূসর হয়ে উঠেছিলাম তাদের চোখে— যেন নরকের দিকে
ধাবমান কুয়াশাঘেরা এক অভিশাপ
প্রচণ্ড ক্লান্তির ভেতর আমরা বারবার আজান দিয়েছি সুবহে সাদিকের সময়
শঙ্খ তুলে নিয়েছি ঠোঁটে
কড়াবদ্ধ ওম ছুঁড়ে দিয়েছি নাভিমূল হতে
আমরা ফুরিয়ে গেছি ধীরে ধীরে— যেমন মুখ খোলা বোতলের কর্পূর উড়ে যায়।

ধরো

আমারে ধরো আমি দুর্বল
হাতে পায়ে ধরা নয়
এই ধরা তুমি বোঝো।
বোঝার মতো ভারি, হৃদয়;
দেখো সেও এক গ্রাম
গ্রাম মানেই কি পাখি?
তেমন জরুরি নয় কিন্তু; তবু
কান পাতা যেতে পারে ভিতরে
এমনকি বাহিরে বোতাম খোলা
অথবা পুরাতন সেলাইয়ের ফোঁকর
ভরাট রেখেও দেখা যেতে পারে
কোথাও কাকলী লুকিয়ে আছে কিনা।
দেখতে চোখ দরকার, আদতে দরকার কি!
এতবার লিখি, আঁকি, দাগাই, জাগাই
মনে মনে; মনে হয় ভালোবাসি,
হয়ে গেলে বিপদ কিনা কে জানে!
যারা জানে খুঁজলে নিশ্চয়ই জানা যেত।
আবার খোঁজ, চিরকাল এই স্বতঃস্ফূর্ত উপাসনা
উপলব্ধির পর ক্লান্ত লাগে, তীব্র আহত
আমারে ধরো, হাতে পায়ে ধরা নয়
হৃদয়, পাখি-পাথর সবকিছু ছাড়িয়ে
দেখো সে এক প্রবল গ্রাম, শীত কাতর, নরম।

প্রেমিকা

যারা খুনি তারা হাত তুলুন
আর যারা আমার মতো শুয়ে আছেন—
মেরুদণ্ডহীন পাথরের মতো— তারা চোখ খুলুন,
দেখুন কিভাবে মায়া সভ্যতায় মানুষ এঁকেছে বন্য হরিণের চিত্র
আমরা গুটিয়ে নিয়েছি সময়ের দারকানাথ— আনন্দ বাজার কিংবা প্রথম আলো
জীবনের পরিসীমায় আমাদের বিকৃত রূপ এঁকে যাচ্ছে,
তুমি অন্ধ কিংবা কেবলই বিনোদনপ্রিয় বিড়াল ছানা— দেখো নাই কিভাবে ওরা
শুয়োরের বাচ্চার মতো মুছলমান বানিয়ে দিয়েছে আমাকে
আর আমার মুণ্ডুতে দশটা মাথা লাগিয়ে, তার ওপর আতজবাজি ফোটাচ্ছে পূজার সংখ্যা
তুমি আমার মাথা খাবে আর আমি তোমার— মাটির শরীর ভেদ করে
আমরা পরস্পর পরস্পরের যোনি কিংবা মগজ কিছুই ছুঁতে পারবো না কোনোদিন
কেবল দুঃখের জীবন কাটিয়ে দেব বটবৃক্ষের ছায়ায়—
ক্লান্ত অথচ প্রশ্নের মুখে দাঁড়াবো জন্ম-জন্মান্তরে,
যে কার্ল মার্ক্স কোনোকালেই ছিল না আমাদের সাথে— যেখানে জীবন মানে শুধুই জীবন
যেখানে, আরও বেশি মূল্যমান ও প্যাকেটজাত হয়েছে আমাদের শিশু
মায়েরা— লুকিয়ে রেখেছে বুকের দুধ
আর পিতার কাধে ক্লান্তিকর বিপ্লব
হতাশায় আত্মহত্যা করেছে আমাদের বোন— আমাদের নারীরা চেয়েছে যেন শাড়ি খুলে রাস্তায় নামা যায়
রাস্তা কেবলই বেদখলে কাতরে মরেছে— কানা গলি জ্যাম আর উন্নয়ন প্রকল্পে
আমি তোমাকে ডেকেছি— খুন হয়ো না প্রিয়তমা
তোমার জন্য এখনো একটা বুক জেগে আছে পথের পরে।

হে হে কবিতা

এসেছে নতুন ফ্যাসিস্ট তারে ছেড়ে দিতে হবে স্থান?
কত নদী রক্তগঙ্গা— নৌকা ভাসে, নৌকা ভাসে
ঘরভাঙা এক নতুন রাজস্থান
গান ধরো— গান ধরো পাখি মিথ্যাবাদীর শহরে
যেখানে মানুষ মানুষ খায় ডেকে নিয়ে তার ঘরে
কণ্ঠে তোলো ডমরু তামুর, গায়ে মাখো শ্মশান
ডাকো ঝিঁঝিপোকা, ডাকো রাজহাঁস
ঘোলা জলে পান করো দুগ্ধ সুবাস
দখল করো চড়ুই, শালিকের ঝাঁক
পল্টন, বাংলামটর মুক্তি বা রূপায়ন টাওয়ার
আমি জানি—
গাড়ির হুইসেল, ধুলোর সাইকেল
সার্জিসের হুঙ্কার, গঙ্গাবুড়ির পাড়
ঠিকানায় খালেদ, সাততলায় শাহেদ
ইংরেজি স্টাটাস, নতুন তথ্য ফাঁস
দায় দরদ, মাগি মরদ
আমি, আমি, আমরা
আমরা সবাই
এক মাদারচোদ, লোভি কুকুর
ক্ষমতা চেটে খাওয়া জিগালো শাউয়ার।

আর আমরা যারা বিপ্লবের নিচে

আমার মেয়েটা কালো— আর ছেলেটা ইটখোলার কাটা শেওড়া গাছ
আমার আব্বা— দাদনের রশি ধরে নেমে গেছে গাঙে
আমার মায়ের অর্ধেক দুধ শুষে নিয়েছে ফ্যাক্টরির তিন নম্বর ফ্লোর
আমার পিঠে মুদ্রাস্ফীতি, হাতে প্রতিবিপ্লবের হাতকড়া
আমাদের বংশায়ু চল্লিশের বেশি নয়, ছাব্বিশে পাকা চুল
ত্রিশে হাঁপানি, বত্রিশে বয়স্ক ভাতার লাইন
চেয়ারে যেই বসে থাক, স্বৈরাচার কিংবা চেতনা
প্রবল যুদ্ধের দিনে হাতের কাঁচি ফিরে আসে নিজের গলায়
আমাদের ফরজ তরফ হয় সামান্য আধহাত কাপড়ের অভাবে।
আমার বউ মাথায় কাপড় দিলে আলগা হয় গোয়া
বুকে আচল টেনে নিলে পেট উদোম
গুদাম ঘরে টিপে দেয়, টিপ দেয় চাঁদের হাত। লম্বা, ফর্সা
শিক্ষিত যুবক, যুদ্ধে যার হাতে বন্ধুক ছিল
চোখ তুলে তাকালেই থাপ্পড় এসে লাগে গালে— শক্ত, সুন্দর দামি ঘড়ি সে হাতে
যে হাতে বিল্পবের প্ল্যাকার্ড ছিল, ছিল দুনিয়া বদলে দেবার মন্ত্র
দুনিয়া বদলে গেল যে স্লোগানে— ইনিই লিখেছিলেন সেই স্লোগান
যে আমার কলার ধরে আছে এই মুহুর্তে
তিনি জানেন— দুনিয়া বদলে গেছে
আগে যে হাত আমার গলা টিপে ধরতো,
আমার বউয়ের বেপর্দা বুক টিপে দিতো
আমার মায়ের অর্ধেক দুধ চুষে নিতো
আমার বাপের হাতে দাদনের দড়ি বেঁধে দিতো
আমার ছেলেটার পাও পুড়িয়ে দিতো ইটের ভাটায়
সেই হাত এখন আর নেই।
তিনি জীবনবাজি রেখে মুছে দিয়েছে সেই অত্যাচারীর চিহ্ন।

আর আমার কালো মেয়েটা?
আমার কালো মেয়েটার খুব অল্প বয়স
যে জানতো না— দুনিয়ার মালিক কারা,
যে জানতো না— ‘ফর্সা; কোন স্কুলে পড়ায়
যে জানতো না— পিতা ছাড়াও পুরুষ আছে দুনিয়ায়
যে জানতো না— আমাদের জন্ম মানে অন্যদের খোরাক
যে জানতো না— কালো মানে ঘৃণার আগুন, যেমন খুশি পোড়াক
সেই মেয়ে আমার
সেই মেয়ে আমার পড়ে আছে পালানের ঘন সবুজ কালোজিরার বনে
ভ্রমর আহ্লাদিত সাদা সাদা ফুল ফুটে আছে তার মুখের ওপর।
দুনিয়া বদলে গেছে। ভেঙে গেছে পুরনো করাত।
অত্যাচারের সব অধিকার এখন এই বিল্পবীর হাতে,
যে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে এসেছে।
জীবনবাজি রেখে সে ছিনিয়ে এনেছে—
আমাদের ওপর অত্যাচারের সব অধিকার।