জাহাঙ্গীরনগর নিজেই একটা ক্রিয়েটিভ লিটারেচার বিভাগ

পর্ব ৫

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৯, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:

সরফরাজ: আমরা যেমনটি জানি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ লেখালেখির জন্যে খুবই উপযোগী। আপনার ক্ষেত্রে কি অভিজ্ঞতা?

মেহেদী: আবেগতাড়িত হওয়ার মতো প্রশ্ন। আমি জাহাঙ্গীরনগরের বাংলা বিভাগে ভর্তি হই ২০০৮ সালে। ভর্তি হওয়ার পর খোঁজ করতে থাকি লেখকদের। নিজ বিভাগেই পেয়ে গেলাম দুজনকে। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কবি খালেদ হোসাইন ও কবি সুমন সাজ্জাদকে। সুমন সাজ্জাদ আমাকে পরামর্শ দিতেন কীভাবে পড়ব। তিনিই প্রথম তার পিএইচডি থিসিসের ভূমিকায় আমার নামের আগে `গল্পকার` শব্দটি বসান। এতে আমি ব্যাপক অণুপ্রেরণা অনুভব করি। বিভাগে গেলে স্যারের রুমেই আড্ডা হতো। প্রায়ই স্যারের রুমে আড্ডার সূত্রে নাস্তা করতাম। খালেদ স্যার বিভাগে আসতেন দুপুরের দিকে। এলে স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হতো। তবে অত না। কম। খালেদ স্যারকে শ্রদ্ধা মেশানো ভয় পেতাম। এখনো তাই। সেসময়ই প্রদায়ক হিসাবে কাজ শুরু করেছিলাম সমকাল পত্রিকায়। কবি অশোক দাশগুপ্তের সাথে। বিভাগ থেকে আড্ডা শেষে সমকালে গিয়েও সেই সাহিত্যেরই আড্ডা! রাতে ক্যাম্পাসে ফিরে আড্ডা দিতাম কয়েকজন বড় ভাইয়ের সাথে। আমাদের ছিল সুবিশাল সার্কেল। নিজ উদ্যোগে তাদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। তারা সবাই জাহাঙ্গীরনগরের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী। লেখালেখি করেন। ফলে লেখালেখির সূত্রে সহজেই অন্তরঙ্গ অবস্থানে পৌঁছে যাই। কবি নওশাদ জামিল, কবি পিয়াস মজিদ, কবি শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন, তাত্ত্বিক তৈমুর রেজা, কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ (সেকালের নির্লিপ্ত নয়ন), কবি রাহেল রাজিব, কবি সাদিকা রুমনসহ আরো অনেকের সাথে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আড্ডা হতো। আড্ডায় কবিতা পড়া হতো। আমার কাছারি গল্পটাও তাদের আড্ডায় পড়েছিলাম। তারা `ভালো হয়েছে` বলে মন্তব্য করেছিলেন। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে আমি কালের কণ্ঠে সহ-সম্পাদক হিসাবে জয়েন করি। দিনে চাকরি করতাম আর রাতে ক্যাম্পাসে গিয়ে আড্ডা দিতাম। পিয়াস ভাই ছাড়া অধিকাংশই বটতলায় রাতের খাবার খেতে আসতেন। অনেক রাত ধরে আড্ডা হতো। সাহিত্যের বোধ সেখানেই তৈরি হয়েছিল। কবি মোহাম্মদ রফিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক রায়হান রাইন, কবি শামীম রেজার সঙ্গ পেয়েছিলাম ক্যাম্পাসে থাকতে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দুই বছর কবি শামীম রেজার ছায়া হয়ে গেছিলাম। স্যার যেদিকে আমিও সেদিকে। আমাকে একাডেমিক পড়াশোনায় মনোযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান পুরোটাই। তিনি ভালো রেজাল্ট করার জন্য প্রেশার দিলেন। এছাড়া বন্ধু নায়মা পারভীন লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করে দিত দুষ্প্রাপ বই। যেগুলো পড়ে ফেলছিলাম সব। পাঠে আগ্রহী করে তোলার ব্যাপারে অর্থাৎ প্রতিদিন কমপক্ষে একশো পৃষ্ঠা পড়ি, এমনটি চাইতেন নওশাদ জামিল। সেসময় তিনি প্রথম আলোতে কাজ করতেন। উনি একদিন খুব চটলেন। প্রায় মারমুখি হয়ে বললেন, `সারাদিন ঘুরো, পড়াশোনা ছাড়া লেখক হওয়া যায় না। মূর্খ থাকবা।` নওশাদ ভাই গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের তালিকা করে দিছিলেন। সেগুলো পড়তে শুরু করায় তিনি বুকে স্থান দিলেন। আর কখনো আশ্রয়হীন করেননি আমাকে। তৈমুর ভাইয়ের কাছে শিখেছি কীভানে থিওরি পড়তে হয়। একটা সাধারণ বিষয়কে ক্রিটিক্যালি দেখতে হয়। কী লিখব না, সেই বোধ পেয়েছি তৈমুর রেজার কাছ থেকে। রাতে নয়ন ভাইয়ের আল বেরুনী হলে চলে যেতাম তাকে গল্প পড়ে শোনাতে। `তিরোধানের মুসাবিদা`র পাণ্ডুলিপির প্রতিটা গল্পটা লেখার পরপরই তাকে পড়ে শুনিয়ে ছিলাম। তিনি ছিলেন আমার মনযোগী শ্রোতা। লেখার ব্যাপারে তিনি যতটা আস্কারা দিয়েছিলেন অন্য কেউ দেয়নি, সবাই শুধু পড়ার জন্য প্রেশার দিতেন। আগে পড়া, পরে লেখা। নওশাদ ভাই আর তৈমুর ভাই চাইতেন যেন আমি প্রচুর পড়ি। অন্যদিকে নয়ন ভাই বুঝতেন, এ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে লিখতেও চায়। তাই তিনি শুনতেন। অন্যরা আমার গল্পকে অত পাত্তা দিতেন না। এমন কি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হলেও না। পরে বুঝেছি, প্রশংসা করলে যদি চেষ্টা কমিয়ে দিই সেজন্য হয়তো। আলাদা আলাদা বিভাগে সবাই পড়লেও আমাদের জন্য জাহাঙ্গীরনগর নিজেই একটা ক্রিয়েটিভ লিটারেচার বিভাগ। আমি সেই বিভাগের সফল শিক্ষার্থী।

চলবে