‘জার্মান দেশের কৃষকযুদ্ধ’ অসাধারণ বিশ্লেষণাত্মক বই
মিনহাজুল ইসলামপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২২
জার্মান দার্শনিক হেগেলের সাথে এবং তার লেখা বইপুস্তকের সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই ইতিহাসের প্রতি এক অবাধ্য অথচ আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলো যখন বুঝলাম আসলে চিন্তা ও মতবাদের রাজ্যে কোনো কিছুই জ্ঞান আকারে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, যদি সেই চিন্তা বা মতবাদের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও পরিবর্তন সম্পর্কে অবগতি না থাকে। মানুষ এবং তার মানবিক আত্মোপলব্ধি, হেগেলের ভাষায় যাকে বলে self-consciousness, তা টিকে থাকেই ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে এবং তার সকল সম্ভাবনার বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ঐতিহাসিক যাত্রার মধ্যেই।
সেই হিসেবে যে কোনো চিন্তা বা মতবাদ বোঝার জন্য তার উৎস যা এরই মধ্যে ইতিহাসের খাটিয়ার ওপরে শায়িত আছে, সেই খাটিয়ার ওপর উঠে বসা। ইউরোপের তথা পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক চিন্তা, অর্থনৈতিক বিকাশ ও জ্ঞানতাত্ত্বিক যে ঐতিহ্য তার ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ মূলত সেই জায়গা থেকেই। সেক্ষেত্রে হাল আমলে ‘জাতির’ ইতিহাস মানেই অনেকটা উক্ত জাতির কর্তৃক নির্মিত জাতিরাষ্ট্রের Nation state ইতিহাস হিসেবেই অনেকাংশেই বিবেচিত। সেই হিসেবে পাশ্চাত্যের জাতিরাষ্ট্রসমূহের ইতিহাস পাঠে নিজেকে নিমজ্জিত রাখতে বিন্দুমাত্র কৃপণতা করলাম না। তবে ঝামেলা হলো যখন দেখলাম, ইংরেজ জাতিরাষ্ট্র, ফরাসি জাতিরাষ্ট্রের মতো জার্মান জাতিরাষ্ট্রের ইতিহাস ‘জাতি কর্তৃক নির্মিত জাতিরাষ্ট্র’ যে তত্ত্ব সেই তত্ত্ব অনুযায়ী পাচ্ছি না, তখন চিন্তা করলাম, জার্মান জাতির ইতিহাস তাহলে কি? অবশ্যই ইতিহাস আছে, যেহেতু আধুনিক ইউরোপের বিকাশের (সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক) পেছনে জার্মান দেশের মানুষের অবদান কম নয়, তাহলে সেই জাতির ইতিহাস কোথায়?
তখন বুঝলাম, ‘জাতি কর্তৃক নির্মিত জাতিরাষ্ট্র’ এই তত্ত্ব ইতিহাসকে বোঝার ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব সর্বজনীন নয়, এর বাইরে বহু কিছুই আছে। খোদ ইউরোপেই বেশ কিছু জাতিরাষ্ট্র রয়েছে, যেগুলোর উদ্ভব, গঠন, আকরণ, নির্মাণ ওই চিন্তা বা আদর্শের ভিত্তিতে নয়, অন্যভাবে, তার একটি হচ্ছে জার্মান দেশ। ফরাসি বিপ্লবের একটি বড় ধারাবাহিকতা হচ্ছে বুর্জোয়া গণতন্ত্র, যা নেপোলিয়োনের বরাতে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্র যা পরবর্তীতে সমগ্র ইউরোপের বিস্তৃত হয়। কিন্তু ফরাসি বিপ্লব সমগ্র ইউরোপীয় ইতিহাসের এমন একটি পর্যায় যার আগে এক ধরনের ইউরোপীয় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং চিন্তাধারা এবং ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী আরেক ইউরোপীয় রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও চিন্তাধারার বিকাশ। কিন্তু বুর্জোয়া গণতন্ত্রের যে আদর্শিক ভিত্তি তার উৎস কি? তার উৎসের যে কাঠামোগত রূপ তার বিবর্তন হয়েছে মোটামুটি খ্রিষ্টীয় চৌদ্দ শতকের গোড়া থেকে ফরাসি বিপ্লবের আগপর্যন্ত। যার মধ্যে একটি বড় অধ্যায় ছিল প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশ (রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে)।
তো সেই প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদের উদ্ভব এবং সেটার রাজনৈতিক রূপের উৎস জার্মান দেশে কিন্তু সেই মঞ্চ কিভাবে তৈরি হয়েছিল? ফ্রিদরিখ এঙ্গেলসের মতে, বিদ্যমান এবং ভবিতব্য বৈপ্লবিক পরিস্থিতিকে বুঝতে হলে অতীতের সকল বৈপ্লবিক পরিস্থিতি এবং তার পরিণতিকে ব্যাখ্যা করা জরুরি। অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আমলে বা পুঁজিবাদী জামানায় (এঙ্গেলসের মতে তার সময়ে আর কি) যে কোনো বিপ্লবী পরিস্থিতি বা বিপ্লবী চিন্তার সম্ভাবনাকে বুঝতে হলে এমনকি তাকে এগিয়ে নিতে হলে সামন্তবাদী অভিজাত এবং রাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে সকল বিপ্লব পরিগণিত হয়েছে তার ঐতিহাসিক আদর্শিক এবং বস্তুতান্ত্রিক জায়গা থেকে বিশ্লেষণ করা জরুরি। এঙ্গেলসের মতে জার্মান দেশে পনেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে ষোলো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্যাপক ভাবে বিভিন্ন জায়গায় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে, যা কিনা প্রথম দিকে তৎকালীন জার্মান দেশে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সেই বিদ্রোহের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে ঠিক প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদের মতোই।
মনে রাখা জরুরি, সেটা খ্রিষ্ট ধর্মের রিফর্মেশন বা সংস্কারের যুগও যেখানে খ্রিষ্ট ধর্মকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হচ্ছিল। মধ্যযুগের ওই সময়ে জার্মান দেশে সংঘটিত হওয়া সেই কৃষক বিদ্রোহ এবং সেগুলোর ধরণ ও আদর্শগত ভিত্তি একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এঙ্গেলস করেন তার ‘জার্মানদেশের কৃষক যুদ্ধ’ Der Deutsche Bauernkrieg বইতে। মজার বিষয় হলো, এই বইটি এঙ্গেলস লিখেছেন কয়েকটা প্রধান উদ্দেশ্য, কিন্তু আমি এই বইটি পড়ে আমার যে ‘জার্মান দেশের ইতিহাস’ জানবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তা অনেকটাই পূর্ণ হয়েছে। তবে মূলত বইটি ‘প্রলেতারিয়ান সংগ্রাম’ অর্থাৎ শ্রেণিসংগ্রাম যা সেই সময়ের ইউরোপের ‘রাজনৈতিক যে প্যারাডাইম’ সেই প্যারাডাইম মোতাবেক ধর্মীয় আদর্শের অন্তরালে হাজির ছিল এবং যার বিকাশের সাথে প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদের বিকাশ হয়েছিল। যা কিনা সেই বিদ্রোহগুলোকে আরও বেশি পরিমাণে ত্বরান্বিত করেছিল। তারই ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ যা জার্মানদের সামনেও হাজির করা উচিত বলে এঙ্গেলস মনে করতেন। যা হোক, আমি কি জেনেছি তা বড় বিষয় নয়, তবে বইটার তাৎপর্য কি তা বইটা কেউ যখন পড়বে সে তখনই উপলব্ধি করতে পারবে।
আমি মনে করি, এঙ্গেলস নিজেও হয়তো জানতেন না যে, এই বইটি লেখার মাধ্যমে সে এক প্রকার মধ্যযুগের ইউরোপ কিংবা সামন্তযুগীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ইতিহাস এবং সেই ব্যবস্থার ভেতর থেকে তার বিরুদ্ধে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহ যা রীতিমতো যুদ্ধে পরিণত হয়, তার ইতিহাস ও লিখে ফেলেছিলেন। নেহাৎ ‘জার্মান জাতি’ এই ধারণাটি সেই সময়ের সমসাময়িক অন্যান্য জাতির মতো জার্মান দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নাহলে এটাকে ‘জার্মান গৃহযুদ্ধ’ নামে ইতিহাসের বইতে প্রচার করা হতো এবং সেক্ষেত্রে এঙ্গেলসেরও হয়তো তখন বেগ পেতে হতো এই বিষয়ের ওপর এরকম একটি অসাধারণ বিশ্লেষণাত্মক বই রচনা করতে।
বইটি আমি দুই বার পড়েছি। গত বছর পড়েছিলাম এবং এই বছর আবারও পড়েছি। বইটি আরো একবার পড়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষাও আছে আমার। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই অসাধারণ বইটি বাংলা ভাষায় মূল জার্মান থেকে সরাসরি অনূদিত হয়েছে। তানিম নওশাদ বইটি মূল জার্মান থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। বইটি পাওয়া যাবে আদর্শ প্রকাশনীর স্টলে। স্টল নং ৩৩৩-৩৩৬
অনুবাদের কোনো বিকল্প নাই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও মহৎ কর্মগুলো বাংলা ভাষায় মোটামুটি অনূদিত হওয়ার যে ঐতিহ্য নির্মাণ, সেই নির্মাণে শরিক হওয়ার ক্ষেত্রে তানিম অনন্য ও অনবদ্য।