জাতীয়তাবাদের সঠিক উত্তর আন্তর্জাতিকতা
অনুশ ঘোষপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২০
লেনিন বলে গেছেন, জাতীয়তাবাদকে অস্ত্র বানিয়ে এক ঔপনিবেশিক দেশের মানুষ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ অত্যন্ত প্রগতিশীল আর সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে একটি অন্যতম ভূমিকা পালন করে। তবে একটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজে জাতীয়তাবাদের ও দুই প্রকার রূপ আমরা দেখতে পাই।
প্রথম প্রকারের জাতীয়তাবাদকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ বলা হয়। এই নামকরণের কারণ এটাই যে, এমন জাতীয়তাবাদ কেবল মাত্র বুর্জোয়া অথবা মধ্যভিত্ত শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর ভাবনা-চিন্তা থেকে প্রকট হয়। এই দেশের প্রেক্ষিতে যেটাকে আমরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলি, সেটার উৎস কয়েক শিক্ষিত, ধনী এবং বিশেষাধিকারী ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক অনুশীলন থেকে হয়।
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাথমিক পর্বে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ একটি প্রগতিশীল শক্তি ছিল। কারণ এটার ব্যবহারে দেশের মানুষ প্রথমবার বিস্তারিতভাবে সংগঠিত হয়ে ওঠে। কিছু দশকের জন্য এই প্রকার জাতীয়তাবাদ দেশের জনগণকে অনুপ্রেরিত করতে সফল হয়। তবে যখন শ্রমিক শ্রেণি আর কৃষিদেরকে সংগঠিত করার প্রশ্ন ওঠে, তখন নেহরু আর গান্ধী দুজনেই এই দুই শ্রেণির মানুষকে শামিল করতে চায়নি। এর বর্ণনা আর কারণ ভগৎ সিং খুব সংক্ষেপে আর খুব সুন্দরভাবে লিখেছে ‘যব রাজনৈতিক কর্মীর হিতে’ নামক এক চিঠিতে।
দ্বিতীয় রকমের জাতীয়তাবাদ হচ্ছে, বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের উৎস প্রথমবার আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নে দেখতে পাই, যেটা পরবর্তীতে গিয়ে চীন আর কিউবা মতো দেশেও প্রদর্শিত হয়েছে। তবে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার ভাবনাকে বাতিল করে না; বরং নিজের দেশকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি থেকে বাঁচানো আর অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের পাশে দাঁড়িতে সংহতি দেখানো হচ্ছে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের বিশেষ অংশ। বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ বর্তমান কালের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতার জন্য একটি উপযোগী বিকল্প, যা দিয়ে সারা পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষ একত্রিত হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করে মানব ইতিহাসের একটি নতুন পাতা খুলে দেবে।
বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের অনেক ক্ষতি আর সীমাবদ্ধতা আছে। আর সেটার মধ্যে একটা ক্ষতি হচ্ছে, জাতীয়-ফ্যাসিবাদ। যেটার ভয়াবহ রূপ আমরা আজ হিন্দুত্ববাদের মধ্যে দেখতে পারছি। কিন্তু এই বিশেষ ক্ষতি কেবল হিন্দুত্ববাদ অবধি সীমিত নয়, বরং বহু রকমের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের মধ্যে প্রকাশ পায়। বাড়ির কাছে দেখতে গেলে, আমরা দেখতে পারছি কেমন ভাবে বাংলা জাতীয়তাবাদ আর আসমীয়া জাতীয়তাবাদ গিয়ে আজ একটি ফ্যাসিবাদী আন্দোলনে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এই দুই জাতীয়তাবাদের উৎস, ইতিহাস আর বর্তমানের পরিকাঠামো অত্যন্ত জটিল। এই দুই রকমের জাতীয়তাবাদই ফ্যাসিবাদ বিদ্বেষ, শোষণ আর অত্যাচারকে প্রশ্রয় দেয়।
জাতীয়তাবাদকে একটি প্রগতিশীল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতেই পারে, কিন্তু কোনও প্রকার জাতীয়তাবাদকে আমরা ব্যবহার করছি, সেটা ভীষণ গুরুত্বের। নতুন সমাজকে তৈরি করতে গেলে আমাদেরকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ, জাতীয়-ফ্যাসিবাদ আর জাতি-বিদ্বেষকে ত্যাগ করে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ আর আন্তর্জাতিকতাকে আপন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জাতীয়তাবাদের উত্তর জাতীয়তাবাদ নয়, জাতীয়তাবাদের সঠিক উত্তর আন্তর্জাতিকতা।