জলপরী

পাপিয়া জেরীন

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৪, ২০১৮

আনু মিয়া একগাল পান চাবাইয়া বিড়িতে টান দিতেই নন্দুবাবু বেসুরা গলা ছাইড়া দিলো— কাঞ্চা বাঁশে আগুন দিয়া বাড়াইলি ধোঁয়াইলি রে...

ধুর, হয় না। আনু ভাই, আপনে একটু ধরায়া দেন। নন্দুদা, বউ ফোন দিছে। গান থামান মিয়া।

হ্যলো... ফোন ধরতে দেরি হয় কেন? কই তুমি? আমি তো দোকানে, বউ। তুমি ভালো আছো? মাইয়ারা কী করে? তোমার মুখে কী? পান? বিড়িও ধরাইছো? সবই বুঝি আমি, বউ বাড়িতে না থাকলে তুমি কী কী করবার পারো...

মুখে তো বুট, বুট চাবাই।

তোমার বউ বাড়িত নাই। তুমি ছোলা খাইয়া কার লগে দৌঁড়াইবা?অ্যা!

ছিহ্ বউ! তোমার মুখে কিছুই আটকায় না। তুমি চিনো না আমারে?

তোমারে তো আমিই ভালো চিনি। মনে নাই নদীর পানিতে আমারে কী করছিলা!

বউগো আর কত কইবা সেই কথা। আল্লার কসম আমার কোনো খারাপ মতলব আছিলো না। বিশ্বাস করো।

বুঝছি। আপনের বাপে গাঙপাড়ে চাইরটা দোকান দিয়া শেষ দোকানডা আপনের আড্ডাবাজির লাইগা থোয় নাই। বাপের নামডা ডুবায়েন না। আপনে কী হোমিও চিকিৎসা দেন তা বুঝি আমি। লঞ্চ থিকা নামন-উডনের সময় মাইয়াগো দিকে চাইয়া চাইয়া আপ্নের দিন কাটে...

ইশ্ বউ! আর কইও না। কী কও তুমি!

আইচ্ছা এহন রাখি। তাতাড়ি বাড়িত যাইবা। গিয়া টান হইয়া শুইয়া ঘুম দিবা। রাইতে আরেক বার ফোন দিমুনি। আনু মিয়া ফোন রাইখা বড় বড় শ্বাস নেয়। নন্দু চায়া চায়া হাসে।

আনু ভাই, ভাবিজান কী কয়? রঙ্গ করে, না! ভাবিরে ওই গানটা শুনায়া দিতেন— আমি ফুল... বন্ধু ফুলের ভ্রমরা, সখিলো...

আনু মিয়ার মন ভার। বউডা কথায় কথায় খোঁচা মারে। পনরো বছর আগে এই লঞ্চঘাটেই শিল্পীর লগে দেখা তার, আচানক এক অদ্ভুত ঘটনায়। লঞ্চ থিকা নামতে গিয়া কাঠের সিঁড়িতে পা ফসকায়া নদীতে। মানুষ ভিড় হয়া গেল কিন্তু সবতে তামশা দেখতে আছে কিন্তু আনু মিয়া দিলো ঝাঁপ, ওরে কান্ধে নিয়া অনেক খানি সাঁতরায়া যখন তীরে আইনা উদ্ধা মারে... তহন শিল্পীরে দেখাইতেছিল জলপরীর মতো। সারা শরীর ভিজা আর পাও দুইটা ডুইবা আছে পানির মইধ্যে। শিল্পী কোনো মতে নিজেরে সামলাইয়া আনুর গালে ঠাঁটাইয়া চড়— হারামজাদা, লুচ্চা! তোর এত সাহস! আমার বুকে হাত দেস! তোরে চাবাইয়া খায়া ফালামু।

আপা! এসব কী কন? আমি তো আপনারে বাঁচাইলাম!

তরে কে কইছে বাঁচাইতে? তোর কী ঠেকা? ওহ্! ভাবতে ভাবতে আনু মিয়ার চোখে জল আসে। কেমনে ভাগ্য একজন আরেকজনরে মিলায়া দেয়। কেমনে এই শিল্পীই তার ঘরে বউ হয়া আসে, ভাবতে ভাবতে সে হারায়া যায়।

 

এ দিকে নন্দুবাবুর সাথে খালেক যোগ দিছে, বেসুরা গলায়। আনু ভাই, হইতাছে না, আপনে ধরেন। আনু মিয়া দরদি গলায় গাইয়া উঠলো— আউট্টাতে কদম্ব গাছ তার উপর সহস্রৈক ডাল তাহার উপর বক্ষিলার বাসা...

 

এমন গলা! মনে হইলো নদীর বুকে হু হু ঝড়। একের পর এক বিড়ি আর পান, গান জইমা উঠছে। এমন সময় আনু মিয়া দেখে, আধাভিজা আঁচল ঝাড়তে ঝাড়তে এক রূপের কইন্যা তার দোকানে আইসা উপস্থিত। চুলের গোছাটা হাতে ধইরা বারবার সামনে আননের সময় শাড়ি কোমর থিকা পিছলায়া যাইতেছে, চিকন একটা চেইন নাভির উপর দিয়া ঝিকমিক করতেছে। এমন একটা জিনিস যে মানুষ কোমরে পরতে পারে তা ভাইবা কোনো কূলকিনারা পাইলো না আনু মিয়া। নিশ্বাস ফেইলা সে ভাবতে লাগলো, মেয়েছেলের গোপণ রোগ নিয়া হয়তো আসছে.. এত পুরুষের সামনে কইতে পারবো না।

 

নন্দুদা আপনেরা একটু বাইরে যান। ক্যান? ভাবিরে ফোন দিবেন নাকি? আরে মিয়া, একটু যান তো।

সবাই বের হয়ে গেলে তিনি ভিতরে আইসা চেয়ারে বসলেন। আনু মিয়ার মাথায় চিলিক দিয়া উঠলো... মাইয়ার পায়ে আলতা আর নুপুর। এই কালে যে এসব পরে নাকি মাইয়ারা?

আপা, আপনার কি সমস্যা কন দেহি!

হিহিহি! আমার তো কোনো সমস্যা নাই!

আনু মিয়া বুঝতে পারলো না, হাতের চুড়ি বাইজা উঠলো নাকি মাইয়াটা হাসতাছে। আবার বউ এর ফোন আসছে।

কী বিষয় আনু মিয়া? কুনো আকাম করতাছো নাকি? নাকি লঞ্চে উঠনের সময় মাইয়াগো পাওয়ের কাপড় উইঠা যায়... সেগুলান দেখতাছো?

আহ্ বউ!

আহ্...দাও কে? এখনও দোকানে কী করো? বাড়িত যাও। নাকি আইজ দোকানেই থাকবা? মেয়েছেলে ভাড়া করছো?

বউ, মোবাইল রাখতেছি। আজেবাজে কথা কম কও, এহনি বাসায় যাইতেছি। আনু মিয়া ফোন রাইখা দেখে মাইয়াটা উধাও। দূরে নন্দু বাবু ইশারায় চা খাইতে ডাকতেছে। মনটা আন্দার কইরা সে দোকানে তালা দিয়া একদম বাসায়।

 

রাইত বারোটা... একটা... দুইটা... ঘুমের লক্ষণ নাই। নাভি বরাবর চিকন সোনার চেইনটা মাথাটা নষ্ট কইরা দিতেছে। একটা সময় ঘুম আসলো ঠিকই, কিন্তু এমন স্বপ্নও যে জীবনে দেখতে হইবো, তা কে জানতো! পিপাসায় গলা কাঠ হইয়া গেছে। খাট থিকা পা নামাইতে যাইবো অমনি একটা হাত মুখের সামনে, নীল চুড়ি, হাতে পানির গ্লাস। আনু মিয়ার শরীর কাঁপতেছে স্বপ্ন না বাস্তব! কী হইতেছে এইসব? আজ সকাল নয়টায় বরিশালের লঞ্চে কইরা যাইতে হইবো ভায়রা বাড়ি... বউরে আনতে। কয়টা বাজে কে জানে।

এই যে শুনছেন, একটা গান শোনান না।

আপনি ঘরে ঢুকলেন কেমনে?

আপনিই তো নিয়ে আসলেন, মনে নাই?

কী কন এইসব! হিহিহি হিহিহি! আনু মিয়ার মাথা ভার হয়া আসতেছে। ছোটবেলায় পড়ার টেবিলের সামনের জানালা দিয়া ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ আসতো। পড়তে গিয়া পেটে পাক মারতো আনুর। পাশের ঘর থিকা মায় কেমনে জানি বুইঝা ফেলতো, চাপা গলায় কইতো— বাপজান জানালাটা বন্ধ কইরা দাও, মন দিয়া পড়ো। আইজ ছাব্বিশ বছর পর অবিকল সেই সুবাস।

কী হইলো, শোনান। ওই গানটা শুনান... সোনাবন্দের গান শুনিয়া... হুমম।

আনু মিয়া কী করবো বুঝতাছে না। শিল্পী মানে তার বউ এই ঘরে গান গাইতে নিষেধ করছে, তাও কসম কাইটা। বউটার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি... গান চলবো না, পান-বিড়ি চলবো না, এই বন্ধু ওই বন্ধু বাদ। মেয়েটা আনু মিয়ার হাত টাইনা ধরছে। মনে হইতেছে ঠাণ্ডা দরিয়ায় শরীরে কাল নাইমা আসতেছে।

এই শোনো, বারান্দায় চলো। গান শুনবো।

আনু মিয়া ঘোরের মইধ্যে পাগলের মতো গাইয়া উঠলো— আইজ আমারে আনিয়া দেওরে আসমানেরি চান্দ সোনা বন্দের গান শুনিয়া বিনা সুতায় মারছে টান...

 

সকাল নয়টা বাইজা চল্লিশ মিনিট, লঞ্চ মাঝনদীতে। আনু মিয়া একশো তিন জ্বর নিয়া লঞ্চের কেবিনে। নন্দু আাইসা তুইলা দিয়া গেছে, বারবার কইতেছিলো— ভাই আইজ যাইয়েন না। শইলডা খারাপ, ভাবিরা ফোন দিয়া কন। আনু মিয়া শোনে নাই। নন্দু বিদায় দেয়ার পরেই মাইয়াটা কেবিনে ঢুকছে। পায়ের কাছে বইসা আনন্দে পা দুলাইতেছে। শাড়ির ফাঁক দিয়া চেইনডা দেখা যাইতেছে।

এই শুনছো? তুমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছ ক্যান? মাথা কি খুব ব্যথা? আসো আমার কোলে মাথা রাখো, আসো বলছি! মেয়েটা আগায়া আসতেছে। আনু মিয়ার মাথায় বিলি দিয়া হিহিহি কইরা হাসতে হাসতে মুখের উপর ঢইলা পড়তেছে। আনু মিয়া চোখ বুইজা আছে লজ্জায়। একটা সময় আনু মিয়া গভীর ঘুমে তলায়া গেল... স্বপ্নে মনে হইলো সে পইড়া যাইতেছে। ঘুমের ঘোরে সে মেয়েটার কোমরের চেইনটা টাইনা ধরলো। সে কানে কিছুই শুনতেছে না... শুধু শরীর দুইলা দুইলা উঠতাছে।