জমির আলীর একদুপুর
রহিমা আক্তার কল্পনাপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৭, ২০১৯
দুর্বল পা দুটো যখন প্রত্যেক মুহূর্তে বিদ্রোহ করছে, গলার ভেতর থেকে বারবার দলা পাকিয়ে উঠে আসছে কিছু একটা, তখন হাড় জিরজিরে শীর্ণ লোকটি প্রায় মনস্থ করে ফেলে যে, সে এই রাস্তার উপরেই শুয়ে পড়বে। শারীরিক অবস্থাটা তার এরকম, এখানে কিংবা যেখানেই হোক এক্ষুণি তার শুয়ে পড়া জরুরি। নতুবা, সে বুঝতে পারে, হয়তো অচিরেই তাকে প্রাণহীন শুয়ে পড়তে হবে চিরদিনের জন্যে।
বাস্তবে কিন্তু সে আরো কয়েক পা এগোয়। মাথার ভেতর মগজ সমেত চক্কর খেয়ে ওঠে তার। হাতের বাঁ পাশের নিচু দেয়ালটাতে পিঠ ঠেকিয়ে কুঁজো মানুষের ভঙ্গিতে অল্পক্ষণ দাঁড়ায় সে। দেয়ালটা খানিক এগিয়ে থেমে গেছে। আবার শুরু হয়েছে আট-দশ হাত দূরে থেকে। মাঝের দেয়ালহীন ফাঁকা জায়গাটাতে একটা মজবুত লোহার জ্যামিতিক আল্পনা করা দেয়াল, বাড়ির গেট। গেটটা লোহার এবং সে অনুমান করে অবশ্যই ওতে তালা লাগানো, তবু একটা দৃঢ় প্রত্যাশা তাকে আরো কয়েক পা এগুতে উদ্বুদ্ধ করে। তবে দেয়ালের সাহায্য ছাড়া এবার সে হাঁটতে অসমর্থ হয়। কেউ তাকে দেখে না, কারণ পুরানা পল্টন লেনের আবছায়া রাস্তাগুলোতে আজ এই উত্তীর্ণ-সন্ধ্যায় লোক চলাচল প্রায় নেই। দূরে মোড়ের কাছে দু’চারজনের আসা যাওয়া, তাদেরকে ছায়ার মতো লাগে। আর তার মলিন অস্তিত্ব তো অস্পষ্টতার মধ্যে অস্পষ্টতর।
গেটটা তার হাতের নাগালের মধ্যে এলে সে অর্থাৎ জমির আলী ওতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আবার হাঁপাতে শুরু করে। একটা বিচিত্র অনুভূতি হয় তার, বুঝি সে তীর্থে পৌঁছে গেছে, এটাই বুঝি তার শেষ গন্তব্য। পরমুহূর্তে একরকম বোধহীনতা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সে যেন ভুলে যায়, কেন সে সন্ধ্যার আগে থেকে দুর্বল রুগ্ন শরীর নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরছে, সাহস করে অনেকের কলিং বেলেও চাপ দিয়েছে, কড়া নেড়েছে। গেট খুলে দেয়া মানুষদের বেশির ভাগেরই বিরক্ত মুখ দেখেছে। কোনো কোনো সময় ঠাস করে দরোজা বন্ধ করে দেয়ায় সে কিছু চাওয়ার সাহসই করেনি, কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে ধমকেও তাড়িয়েছে। কিন্তু এ বাড়িতে এসে কেন যেন তার ভেতর একটা প্রত্যাশা দৃঢ় হতে থাকে— এখানে কিছু মিলে যাবে।
এ পাড়ায় ঢোকার পর থেকে দু’চারটে ছাড়া কোনো বাড়ির গেটের কাছেও সে ঘেঁষতে পারেনি কঠিন চোয়াল তীক্ষ্ণকণ্ঠ দারোয়ানদের জন্যে কিংবা নাদুসনুদুস হিংস্রমুখ কুকুরের তাড়ায়, আরেকটু চলার শক্তিও তার শেষ হয়ে এসেছে এবং খানিক আগে অতিরিক্ত দুর্বলতার জন্যে তার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল— এসব কারণেই এ বাড়িতে দাঁড়াতে পেরে তার মধ্যে এ প্রত্যাশা জেগেছে কিনা, সেই জটিল মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা জমির আলীর অগোচর। সে শুধু অবুঝের মতো একটা মরিয়া আশা নিয়ে গেটের ফাঁক দিয়ে ঝাপসা চোখে ইতিউতি কিছু একটা খুঁজতে থাকে। বিল্ডিংটা বেশ দূরে, সামনে অনেকটা অংশ খোলা, তার বাঁ দিকে বাগান, ডানের আঙিনায় বিরাট চৌকোণা দাগ দেয়া এলাকার চার ভাগে চারটে অংশের ঘাস মরা। প্রবল জ্বরের রোগীর চোখের মতো লাল টিমটিমে আলোর নিচে ছাল ওঠা কুকুরের পিঠের মতো জায়গাগুলো তাদের মলিন শরীরে মানুষের অবিরাম পদপাতের সাক্ষ্য বহন করছে, আশেপাশে কোনো মানুষের সাড়া নেই। দাগ দেয়া চৌকোণা জায়গাটা একটা ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট, সে চিনতে পারে।
যে সতর্ক প্রহরা নেই বলে সে এখানে দাঁড়াতে পেরেছিল, যে শব্দহীনতা কিংবা বলা চলে, রুক্ষ কণ্ঠের অনুপস্থিতি তাকে আশ্বস্ত করেছিল, তা-ই এবার তার ভেতর ক্রমশ নিরাশার জন্ম দিতে থাকে। কারো ক্ষীণ সাড়াও মেলে না। অনেকক্ষণ পরে সবটুকু সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে গেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে সে। এবার কী করবে। এসময় পেটের ভেতরকার মোচড়ানো যেন হঠাৎ করেই বেড়ে ওঠে, ক্রমাগত গা গুলিয়ে আসে। গলার কাছে আটকে থাকা জমাট কিছু একটা বুঝি বেরিয়ে আসবে এক্ষুণি। ওটা কী সে জানে না— কিন্তু ওটাকে উগলে দিতে পারলে সে বেঁচে যায়। পেটের ভেতর থেকে দমকে দমকে নাড়িভুঁড়ি খিঁচে উল্টে বের হয়ে আসতে চায়। কান্না পায় জমির আলীর, সারামুখ বিকৃত হয়ে যায়, কিন্তু চোখ খটখটে শুকনো। সে তার কাঁধে রাখা ছেঁড়া গামছার টুকরোটি হাতে নেয় বুঝি বা অশ্রুশূন্য চোখ দুটো মোছার জন্যেই। এভাবেই সে শক্তিহীন দেহটি আবার পথের দিকে ফেরালে ওপাশের তিনতলাটা দেখতে পায়। ফ্ল্যাট বাড়ি। নিচতলার প্রধান গেটে পরপর তিনটে সুইচ। কলিংবেলের হতে পারে। জমির আলী কোনো প্রত্যাশা আর করে না, তবে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে গেটটা পর্যন্ত পৌঁছায়। সবচেয়ে নিচের বোতামটায় ময়লা হাতটি রাখে সে। বাসার ভিতরে কোথাও তীব্র স্বরে একটি পাখি ডেকে ওঠে, বাইরে দাঁড়িয়ে সে চমকে উঠেও আশ্বস্ত হয়, কারণ প্রায় সাথে সাথে একটি তরুণীর কোমল মুখ দেখা যায় জানালার পর্দার ফাঁকে, ‘কে?’
‘মাগো, আমি...’ এটুকু বলে তার গলায় শব্দ আটকে যায়। হাঁপাতে থাকে সে। তরুণী একটু সহানুভূতির সাথে ‘কী’ জিজ্ঞেস করলে সে কোনো ভূমিকা না করেই (যদিও বলতে চেয়েছিল প্রায় তিন দিন সে কিছু খায়নি এবং ভয়ানক অসুস্থ, কিন্তু এ মুহূর্তে ব্যাখ্যা দেয়া তার সাধ্যাতীত) বলে, ‘দুইডা খাইবার দিবেন?’ তরুণী কোনো জবাব না দিয়ে চলে যায়। ঝুঁকে থাকা বুভুক্ষু জমির আলীর চোখের সামনে গ্রীলের ওপাশে ভারি পর্দা ঝুলতে থাকে। আশ্বাসহীন জমির আলী নড়তে পারে না। একটু পরে ‘দেখি চলে গেছে কি না’ বলতে বলতে তরুণীটি ফের জানালার পর্দা তুলে ধরে পেছনে ফিরে বলে, ‘না দাদি, চলে যায় নাই। আছে। এই যে, আপনি দাঁড়ান।’ শেষের কথাগুলো জমির আলীকে লক্ষ্য করে বলা।
অচিরেই জমির আলীর সামনে বাইরের বন্ধ গেটটি খুলে যায়। ভেতরে ঢুকে, উপরে উঠে যাওয়া সিঁড়ির নিচের ফাঁকা ঘুপচি জায়গাটিতে সে বসে। ছোট একটি মেয়ের বাঁ হাতে তরকারিসহ একথালা ভাত, ডানহাতে একটি নীল প্লাস্টিকের গ্লাসে পানি— দেখে কেমন অবিশ্বাস্য লাগতে থাকে তার। ভাত খেতে শুরু করে সে একবার সামনে তাকায়। দরজার কাছে দাঁড়ানো তরুণী কিংবা ছোট মেয়েটি, কেউ নেই। নিবিষ্ট হয়ে খেতে খেতে অনেক কথা মনে পড়ে তার। ফেলে আসা ভিটাবাড়ি, পানির তলায় চাল পর্যন্ত ডুবে যাওয়া ছোট-বড় তিনটা ছনের ঘর আর কয়েকটা ক্ষুধার্ত মুখ। টাঙ্গাইলের বাসাইল এলাকায় তার জীর্ণ বাড়ির উঠান থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু সে ওখানে ফিরে গিয়ে কী করবে! তার এই অশক্ত অক্ষম রুগ্ন শরীর, কানাকড়ির সম্বলহীন হাত তার পরিবারের কোন কাজে আসবে?
শহরেও সে কোনো কাজ করতে পারছে না। চাষাবাদ ছাড়া, গেরস্থালির কাজ ছাড়া তেমন কোনো কাজ তো জানে না জমির আলী। সে খুব ভালো নিড়ানি দেয়। কয়বার লাঙল টানার পরে কতখানি ‘জো’ এলে জমিতে নির্ভুল সময়ে বীজ বুনলে ভালো চারা গজাবে, সে জানে। জানে মলন দেয়ার সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম খুঁটিনাটি। এমনকি ধান সিদ্ধ দেবার পর কয় রোদে ঠিকমতো ‘ল্যাচা’ লাগে ধান, কি অবস্থায় তা থেকে গোটা গোটা পুষ্ট চাল বের করতে হয় সে কাজেও স্ত্রী সালেহাকে সে সাহায্য করেছে। গরু ছাগলের যত্নে তার ত্রুটি পায়নি কেউ। জমির আলী ভালো ঘরামির কাজও জানে। তার হাতে ছাওয়া খড়ের বা ছনের চাল হয় নিখুঁত, অনেক ঝড় ঝাপটাতে নিপাট থাকে, টেকসই হয় বহুদিন। সেই সাথে মাছের জালবোনা, মাছ ধরার ফাঁদ তৈরি, ডালা-কুলা মেরামতি— কোন কাজটা সে নিপুণভাবে করতে জানে না?
‘জনমনিষ্যির’ এই বিশাল হাটের মতো ঢাকা শহরে তার এসব কর্মদক্ষতার কোনো দাম নেই। বাড়ি ফিরে যাবার কথা ভাবলেও অধিকাংশ সময় যে বাস্তবতার আশংকা তাকে দমিয়ে দেয় তা হচ্ছে, এসব কাজ কি গ্রামেও আর করবার পরিস্থিতি আছে! অন্তত এসব কাজ করে সে পাঁচ পাঁচটা পেট কি চালাতে পারবে আর কোনোদিন? অভাবের কী রাক্ষুসে চেহারাই না দেখে এসেছে সে এবার। তিনটি সন্তান নিয়ে তার সম্বলহীন বউটা কিভাবে দিন কাটাচ্ছে, কথাটা ভাবতেও তার ভয় হয়। নিজেকে অপরাধী লাগে। কিন্তু কী-ই বা সে করতে পারে। তার চেয়ে এই ভালো। আল্লাহর রহমতের ভরসায় সে ছেড়ে দিয়ে এসেছে ওদেরকে। এখন তো নিজেকেই জমির আলী টানতে পারে না। ওদের উপরে গিয়ে বোঝা হওয়া ছাড়া আর কী উপকারে লাগবে সে।
জমির আলী ভাবে, কোন পাপে তার এমন শাস্তি হলো। সে লক্ষ্য করেছে, যতবার সে নানান ঝড় ঝাপটা সামলে সুমলে একটু থিতু হয়ে বসতে চায় সংসারে, তখনই একটা না একটা বালা মুসিবত তাকে উলোট পালোট করে দেয়। এ কিসের আলামত। কোন পাপের শাস্তি সে পায়। মনের মধ্যে আতিপাতি করে খুঁজেও নিজের জানামতে করা তেমন কোনো বড় অপরাধ সে বের করতে পারে না। অপরাধই তো পাপ, গুণাহ— নাকি? তার সরল মগজ এরকম সোজা সাপটাই চিন্তা করে। তো, মারাত্মক কোনো গুণাহর তো প্রশ্নই ওঠে না, যেসব ছোটখাট গুণাহর কাজ তার বন্ধু বান্ধব হেসে খেলে করেছে, সেসবেরও ধারে কাছে সে যায়নি। ঠাণ্ডু ব্যাপারীর ছেলে আলম, যে এখন ‘আলম ব্যাপারী’ নামে আশেকপুরে খুব নামি ব্যবসাদার, যুবক বয়সে জমিরের বন্ধু ছিল, মাত্র সতেরো বছর বয়স থেকেই সে পাড়ায় মেয়েদের কাছে রাত কাটাতো। ওটা ছিল তার কাছে ডালভাত। যেদিন সন্ধ্যায় জুয়ায় তার মন বসতো না, দানের পর দান হারতো, সেদিন সে অবশ্যই সর্বস্বান্ত হওয়ার আগে, সকলের ছিঃছিক্কারের ভেতরেই বেরিয়ে যেত— ‘পট্টি থেইকা ঘুইরা আই গা। গাও ম্যাজ ম্যাজ করে।’
সকলেই জানতো সে বাজারে ‘পট্টি’ নামের ঝুপড়িতে কার কাছে যাচ্ছে। জমিরের না ছিল জুয়া, না ছিলো বদ মেয়েমানুষের নেশা। বিড়ি সিগারেট কচিৎ খেতো, কারো কাছে ফাউ পেলে। সাদুল্লা মুন্সি নামে জমিরের এক বন্ধু, যে ইলেকশনের সময় কোনো না কোনো পার্টির নেতার সঙ্গে জুটে যেত, সে এখন নিজেই মাঝারি গোছের নেতা। শ্রমিক নেতা। অথচ কোনো সময় সে শ্রমিক ছিল বলে জমির আলী মনে করতে পারে না। এই সাদুল্লা মুন্সি যখন যে নেতার কাজ করতো, ওই অল্প বয়সেই সেই নেতার হয়ে অন্যদলের অনেক কর্মীকে অমানুষিক নির্যাতন করতো। একবার তো এক প্রতিপক্ষকে কিছুতেই ঠেকানো যাবে না দেখে নিজের দলের এক নিরীহ কর্মীকে পায়ে গুলি করে দিতে যেয়ে কোমরে গুলি লাগিয়ে দিয়েছিল সে।
বাঁচেনি ছেলেটি। ফলে সাদুল্লার নেতার জন্য ঘটনাটা খুব কাজে দিয়েছিল। সেই খুনের দায় প্রতিপক্ষের প্রার্থীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে, তাকে খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে নিশ্চিত ভরাডুবি থেকে ইলেকশনে জয়ী হয়েছিলেন তিনি, সাদুল্লা মুন্সির সেই মহান নেতা ‘আমার নেতা তোমার নেতা অমুক ভাই অমুক ভাই।’ আর সাদুল্লা মুন্সি পুরস্কার হিসেবে কোনোদিন শ্রমিকের কাজ না করেই শ্রমিক-নেতার পদ বাগিয়ে ছিল। নিহত সেই ছেলেটির বিধবা মা এখন কুমুদিনী হাসপাতালের গেটে বসে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে। ভিক্ষা করে।
আচ্ছা, আলম ব্যাপারী, সাদুল্লা মুন্সি, হেরোইনচি কদম, ডাইলখোর বাদইল্যা, গরুচোর গফুর, এরা কেউ কি পাপী না? কই, এদের তো শাস্তি হয় না। জমির আলী খুব অসহায় বোধ করে। ভাবনা চিন্তার কোনো থই পায় না। কিন্তু তার বিপন্ন মস্তিষ্কের কোনো একটি কোষ থেকে হঠাৎ যেন এক চিলতে আলো ঝলসে ওঠে। পাপ প্রসঙ্গে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা তার মনে পড়ে— সালেহার সঙ্গে তার বিয়ে যখন হয় তখন সালেহা বছর ষোলো সতেরোর মেয়ে। পানপাতার মতো মুখ। দেখলেই মনে হয়, এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসেছে। চুল ছিল, ঘন গোছার চুল। সাধারণত বিয়ের কনের চুলে নানা রঙঢঙের খোঁপা করা হয়। কিন্তু সালেহার চুলে দুটো বেণী করে একটার গোড়ায় আরেকটার ডগা বেঁধে কমলা রঙের ফিতায় ফুল তোলা ছিল। চোখে মোটা কাজল আর সামান্য লিপস্টিক, লাল। আর কোনো সাজ নেই, তেমন করে চুল বাঁধার বা সাজিয়ে দেবার মতো পারঙ্গম আপনজন বা সখী সালেহার ছিল না। বিয়ের রাতের সাজ হিসেবে সালেহার সাজসজ্জা ছিলে খুবই সাদামাটা। হলে কী হবে, এটুকুই জমিরকে পাগল করে দিয়েছিল। চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়স তার, সে সময় বিয়ে করার পক্ষে যথেষ্টই বেশি। বন্ধুরা প্রায় সবাই বিবাহিত, তাদের দাম্পত্যের রসালো বর্ণনা শুনে অনভিজ্ঞ কিন্তু উপোসী যুবক দেহে কতবার উথাল পাথাল ঝড় বয়ে যেত নীরবে। বাইরে সে শান্ত থাকবার চেষ্টাই করতো। থাকতোও। কিন্তু তার জীবনে সত্যিই যখন রাতটা এলো, সে পাগল পাগল বোধ করছিল। আর সালেহা তো ছিলো অঘ্রাণের পাকা ধানের মতোই পুষ্ট। পুষ্ট আর টানটান। জমির কী করবে বুঝতে না পেরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। বসে থেকে ঘামছিল। নিজের শরীরের মধ্যেকার অস্থিরতাকে সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। সালেহা কী বুঝেছে কে জানে, সে তার লজ্জাভরা চোখ তুলে বলেছিল, ‘মাইঝ রাইত, ঘুম পাড়বেন না?’
চমকে উঠেছিল জমির। তার বুকে হাতুড়ির ঘা। তড়বড় করে বলে, ‘না না। ঘুম পাড়বো ক্যা। ঘুম পাড়বো না।’ সালেহার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। খুব অস্ফুটে বলল, ‘তয়?’ সালেহা তাকিয়ে আছে নতচোখে। জমির তার মুখের দিকে এবার তাকায় স্পষ্ট দৃষ্টিতে, ‘তয় আসো একটু কথাবার্তা কই, তোমার নাম কি?’ এইবার সালেহা যেন অল্প একটু চাপা হেসেই ফেলে, ‘কী-ই মানুষ! আমার নাম য্যান্ তাইন জানে না।’
জমির এলোমেলো বোধ করে, মুহূর্তমাত্র, কারণ সে সালেহার মুখে চোখ ফেলতেই দেখে, ঘোমটা খসে পড়া অল্প-সাজানো মুখটা উঁচু করে মায়াভরা চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সালেহা। সে তার রক্তের ভেতরে বুঝি খই ফুটছে বলে টের পায়। যেন ওই মুহূর্তেই সে প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে, সামনে বসা ওই আঁটসাট দেহের, মায়াবী মুখের, গভীর চোখের মালিক এই মেয়েটি কে? কেন সে এই প্রথমবারের মতো একটি ঘরে গভীর রাতে একটি তরতাজা মেয়ের গা ঘেঁষে বসে আছে। তার গায়ের ভেতরে টগবগ করে ফুটছে রক্ত, শিরায় শিরায় দাপাচ্ছে আগুন। সেই সঙ্গে তার নিজের ভেতর থেকে সতেজে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এক অচেনা অস্তিত্ব। অল্পশিক্ষিত জমির শিল্প কিংবা কামকলার ধার ধারে না। সে প্রথমেই হাত রেখেছিল তার সবচাইতে গভীর কৌতূহলের বস্তু, সালেহার বুকে। তার হাত কি কাঁপছিল? আজ সে আর মনে করতে পারে না। কিন্তু পরিষ্কার মনে পড়ে, সালেহা কেঁপে উঠেছিল। যে জন্য জমির তার বাম বাহু দিয়ে অনেকটা অভয় দেয়ার মতো ঘের দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল সালেহার বাম কাঁধ আর ডান হাতে খুব আদরের সঙ্গে ব্লাউজের ভেতরে স্পর্শ করেছিল তার বাম স্তন। ঠিক একটা পেয়ারা কিংবা ডালিম যত্ন করে ধরবার মতোই। কিন্তু আর হাতের তালুতে খুব দ্রুত খাড়া হয়ে ওঠা একটি ছোট্ট বোঁটার চাপ লাগতে না লাগতেই সালেহা অভয় পাওয়ার বদলে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে দ্রুত জমিরের হাতটা সরিয়ে নিজের দু’হাত আড়াআড়ি চেপে ধরেছিল বুকে। আর হাঁপাচ্ছিল। এমনভাবে বুকে হাত চেপে ধরেছিল যেন ওখানে সে খুব মূল্যবান কিছু লুকিয়ে রেখেছে। কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেবে না।
হ্যাঁ, মূল্যবান তো বটেই, জমির বুঝেছিল খানিক পরেই। খুব খুবই মূল্যবান রত্ন সেখানে। আর সেই রত্ন ডাকাতির সময় সালেহা হঠাৎ বলে ওঠে, ‘ছাড়েন দেহি, গুণাহ অবো না?’
জমির তখন সাহসী হয়ে উঠেছে। বলে, গুণা অবো ক্যা? আল্লায় তোমার নিগা আমারে আর আমার নিগা তোমারে মিলাইয়া দুনিয়াত পাডাইছে।’ তবু সালেহার ধন্ধ কাটে না, সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘না ছাড়েন, ছাড়েন দেহি। মানষে যে কয়...’ জমির ছাড়ে না, আরো আঁটো করে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মানষে কি কয়?’
‘হগলে কয় বলে...’ সালেহার কথা পুরো হবার আগেই জমির তার ঠোঁট বন্ধ করে দিয়েছে চুম্বনে। ক্ষুধার্ত শিশুর মতো সালেহার ঠোঁট থেকে অমৃত শুষে নিয়ে নিজের উপোসী যৌবনকে যেন তৃপ্ত করতে চায় জমির। ঠোঁটে ঠোঁটে এভাবে ‘চুমা খাওন’ জমির বাস্তবে কখনো দেখেনি। বাজারে ভাড়া করা ভিসিআর-এ ফিলিম দেখায়। টিকেট লাগে। সে টিকেট কেটে অনেকবার দেখেছে। দেখে শিখেছে। কিছুক্ষণ পর ঠোঁট মুক্ত হলে সালেহা আবার মৃদুকণ্ঠে বলে, ‘মানুষে হুনছি কয়...’
‘কী কয়?’
‘কয় বলে মাইয়া মানুষের স্বামী তার ইজ্জত রক্ষা করে।’
‘হ, তা তো করেই।’
তাইলে অহন আমার ইজ্জত গেতাছে কার কাছে।’
জমির অবাক হয়, ‘তোমার ইজ্জত গেতাছে গা?’
‘গেতাছে না তয়? আপনেই তো পয়লা...’
জমির আলীর গলা ফাটিয়ে হাসতে ইচ্ছে করে। কী বলে পাগলী! এবার আর বাঁধ মানে না জমিরের পৌরুষ, সে তীব্র আবেগে নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ যুক্ত করে ফেলে সালেহাকে, তার সর্বাঙ্গের আগুন বুঝি গলিয়ে ফেলে সালেহার লজ্জা, ভয়, দ্বিধা জড়তা। অনেক সময় ধরে খুব ভারি আর অস্পষ্ট গলায় থেমে থেমে বলে জমির, ‘হ... আমিই পয়লা... আমিই শেষ... আমি সবসময়, সারাজীবন বউ, সারাজীবন।’
সেই গভীর রাতে সালেহার সাত রাজার ধন ‘ইজ্জত’ খুব আদরের সঙ্গে সম্পূর্ণ দখল করেছিল জমির। পরে এই নিয়ে দুজনার মধ্যে কত যে নিবিড় রসিকতা হয়েছে।
জমির আলীর মুখে আশ্চর্য সুখের আলো। আজ, সময়ের এই দীর্ঘ দূরত্বের কথা বুঝি ভুলে যায় সে, তার মনের মধ্যে দ্রুত শ্বাসের সঙ্গে গুনগুনিয়ে ওঠে রমণক্লান্ত, পরিতৃপ্ত যুবক জমির আলীর কণ্ঠস্বর। বুকের সঙ্গে লেপ্টে আছে পুরুষ্ট রমণী, তার নয়া বউ। সে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘হ, সারাজীবন বউ, আমিই সারাজীবন। হ।’
‘আর কিছু লাগবে?’ চমকে ওঠে জমির আলী। দরোজায় আবার তরুণীর উপস্থিতি। তার প্রশ্নটা বুঝি জমির আলীর মগজে পৌঁছায় না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সে।
‘আর কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করছি। আপনি তো কিছু খাচ্ছেনই না।’
এতখানি অযাচিত সৌহার্দ্য জমির আলীকে কাতর করে ফেলে। চোখ ভিজে ওঠে অকারণে, ‘না না মা, আর কিছু লাগবো না। এই ঢের।’
একথালা ভাত খেতে অনেকক্ষণ লাগে তার। ঢোক গিলতে গলায় ব্যথা হয়, মুখটাও তেতো। জীবনের জন্য, বাঁচবার জন্য অপরিহার্য আর এই মুহূর্তে ভীষণ দামি এই খাবারটুকু দ্রুত খাওয়াও তার পক্ষে কষ্টকর। যদিও পেটে রাক্ষসের মতো খিদা, তবু একটা প্রবল ভয়ও তাকে দ্রুত খাওয়া থেকে বিরত রাখে। সে ভীত হয় বা তেমন একটা না ভেবেই অবচেতন একটি সতর্কতা তার মধ্যে এসে যায়, খুব আস্তে না খেলে তার পাকস্থলী অনেক কষ্টে পাওয়া এই জীবন-বাঁচানো অন্নের গ্রাস নির্মমভাবে উগলে দিতে পারে। ঘটনাটি ঘটলে তার অবস্থা কী হতে পারে তা ভাবতে পারার আগেই তার হাত শ্লথগতি হয়ে আসে। এ সময় সিঁড়িঘরের নিচে পরিত্যক্ত একটি ফুলের টবে আচমকা দৃষ্টি পড়ে তার, একপাশ ভাঙা কালো মাটির টবটিতে এখনো অল্প মাটি আছে। শুকনো। রুখু। কিন্তু এ মাটিতেই আধমরা একটি মানিপ্লান্টের ডালে দুটি রুগ্ন কচিপাতা। ফ্যাকাশে সবুজ। জমির আলী তার ভীষণ ক্লান্ত ঘোলাটে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে ভাতের থালায়।
কাজের মেয়েটা কয়বার এসে উঁকি মেরে যায়, দেখে কেমন একটি সংকোচ তাকে সর্বাঙ্গে ঘিরে ধরে। মেয়েটির চোখে সন্দেহ। মেয়েটি কি ভেবেছে জমির আলী এই থালা গ্লাস নিয়ে পালাবে? কথাটা মনে এলে সে নিজের ভেতরে কুঁকড়ে আসে, একটা হীন দীনতায় দীর্ণ নিজেকে তার মনে হয় ক্ষুধার্ত একটি কুকুর, যাকে খাবার দিয়ে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনিব, যাতে প্রাপ্যটুকু খেয়ে আর কিছুতে মুখ না দিয়ে ফেলে।
‘এই ব্যাডা, থালাডা ধুইয়া পানিডা বাইরে ফালায়া দিয়ো।’
জমির আলী কিছু বলে না। খাওয়া শেষ হলে থালাটা ধুয়ে বাইরে পানি ফেলতে গেলে ভেতর থেকে কে একজন খুব ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে ধমকের গলায় বলে, ‘কিরে রাবি, তুই এতক্ষণ কি করিস দরজা খুলে রেখে?’
‘ব্যাডার খাওয়া তো মোডে শ্যাষ অইল আম্মা। দাদিজানে কইলো...’
‘আয় শিগগির। গেট লাগা।’
খুব আস্তে বাইরে পা বাড়ায় জমির আলী। তার মুখের ওপর খটাস করে বন্ধ হয়ে যায় অন্নদাত্রীর বাড়ির দরোজা। সেদিকে তাকিয়ে আবার সেই পুরানো বিবমিষায় গা গুলিয়ে ওঠে তার, নিজেকে মনে হতে থাকে ঘোলা পানিতে ভাসতে থাকা কীট। দীর্ঘদিনের অভাব অনাহার আর অসুস্থতা তার মধ্যে আত্মসম্মান বলতে কিছু অবশিষ্ট রাখেনি, তবু নিজেকে তার বড় অপমানিত মনে হয়। কিন্তু এরই মধ্যে তার সমস্ত মন মানুষের প্রতি, জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে, কারণ এখন সে হাঁটতে পারছে। মাথা ঝিমঝিম করছে করুক, রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে ঘুমিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে করুক, কিন্তু সে হেঁটে এগিয়ে যেতে পারছে তার বস্তির আস্তানাটির দিকে।