হেগেল
জগলুল আসাদের প্রবন্ধ ‘খ্রিস্টানিটির হেগেলীয় ব্যাখ্যা’
প্রকাশিত : জুন ১৮, ২০২০
হেগেল খ্রিস্টানিটির যে ব্যাখ্যা করেছেন তা নানা অর্থেই বেশ আগ্রহোদ্দীপক। খ্রিস্টানিটির অনেক প্রতিপাদ্যের দার্শনিক বিচারের ফলাফল হিসেবে পশ্চিমের অনেক তত্ত্বের জন্ম। খ্রিস্টানিটি ভেতরকার সংকট ও খ্রিস্টানিটির বিচারের মধ্য থেকে যেসব ভাবের জন্ম, সেগুলোকে সেকুলার চিন্তার ফল হিসেবে ইউনিভার্সাল রূপে হাজির করা হয়, প্রায়শই। হেগেলের মতে, স্বাধীনতার ধারণা পূর্ণতা পেয়েছে খ্রিস্টানিটির ভেতরে। মানুষ যে পাপ করেছে, এটা তার স্বাধীনতার স্মারক। সে পাপ করেছে এটা প্রমাণ করে, সে স্বাধীন। আবার, পাপ না করার ব্যাপারেও সে স্বাধীন। সে ইচ্ছে করলে খোদাকে মানতে পারে আবার নাও মানতে পারে। সুতরাং, স্বাধীনতা মানুষের অন্তর্গত স্বভাব। গড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে দুটো জিনিস লাভ করলো: একটা হলো স্বাধীনতা, আরেকটা হলো যুক্তি। যুক্তিপ্রয়োগ মানুষের স্বাধীনতার চূড়ামনি।
আবার, মানুষের স্বর্গচ্যুতি ও খোদা থেকে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া হেগেলের মতে, একটি প্রতীকী ব্যাপার। কিসের প্রতীক? Divide between Individuality and universal reason এর প্রতীক। গড থেকে আলাদা হয়েই মানুষ ব্যক্তি হয়ে উঠলো। আবার, খোদার পুত্র (নাউজুবিল্লাহ) হিসেবে জেসাসের পৃথিবীতে আগমন অসীম বা পরমের সাথে সসীম ও মূর্তের সংযোগ প্রকাশ করে। মানুষের পাপী হওয়া আর জেসাসের খোদার পুত্র হওয়ার মধ্যে সংযোগ রয়েছে। মানুষ যদি আদিতে পাপ করে থাকে ও খোদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আরো অধঃপতিত হয়, তাহলে মানুষের ‘মুক্তি’র উপায় কি? কিন্তু প্রশ্ন হলো, এক মানুষ তো আরেক মানুষকে মুক্তি দিতে পারবে না। কারণ প্রতিটি মানুষই সত্তাগতভাবে আদি পাপের অংশীদার তাই এক মানুষ আরেক মানুষের মুক্তিদাতা হতে পারবে না। কিন্তু যদি এমন কেউ হয়, যিনি একই সাথে মানুষের রূপপ্রাপ্ত ও একই সাথে খোদায়ীসত্তার অংশীদার, সে কিন্তু মুক্তিদাতার ভূমিকা পালন করতে পারবে। কারণ মানুষের পাপীসত্তা তার থাকছে না, আর যেহেতু মুক্তির কারণ হতে হবে মানুষের জন্যে, তাই মুক্তিদাতাকে মানুষও হতে হবে।
তো, এইভাবে ‘জেসাস’ এর ধারণার ভেতরে মানুষীরূপসম্পন্ন হওয়া ও খোদার পুত্র হওয়া ছাড়া খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্বের সংকট মোচন হতো না। জেসাস তাঁর আত্মহুতির মধ্য দিয়ে মানবসত্তাকে পাপমুক্ত করেন, এবং জেসাসের এই আত্মহুতিকে Universal Concept of Freedom এর উদাহরণ মানছেন হেগেল। হেগেল খ্রিস্টানিটির একটা রেশনালিস্ট ভার্সন এভাবে হাজির করেন। খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্বকে তিনি দর্শনের অধীন করেন, এবং খ্রিস্টিয় নীতিগুলোকে ‘চিন্তার নির্ণয়’ হিসেবে উপস্থাপন করেন, যেটা দর্শনের অন্যতম কাজ। হেগেলের মতে, রিজনই পারে ইউনিভার্সাল হতে। তো, গড হচ্ছে এবসোলিউট রিজন। আর রাষ্ট্র হচ্ছে Reason Personified। রাষ্ট্রের উদ্ভবের শিকড় ধর্মের ভেতর। অবজেকটিভ রিজনের চূড়ান্ত রূপ রাষ্ট্র। আনুগত্যের প্রশ্ন ছাড়া ধর্ম ও রাষ্ট্র কোনোটাই হয় না। এরিস্টটলের অনুসরণে হেগেল বলেন, ব্যক্তি তার পূর্ণবিকাশ ঘটাতে পারে একমাত্র রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন হলেই। হেগেল তার ডায়ালেকটিক পদ্ধতিতে দেখান, মানুষ সত্যিকারভাবে স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে আইনহীন প্রাকৃতিক অবস্থা (থিসিস) বা অতিনিয়ন্ত্রিত হায়ারার্কিকাল স্টেটে (এন্টিথিসিস) না, গণতান্ত্রিক ও জাতিরাষ্ট্রে (সিনথেসিস)। যদিও, হেগেলের কাছে জাতি রাষ্ট্রই ইতিহাসের সমাপ্তি নয়। পরমের পরিকল্পনা নানাভাবেই ইতিহাসে পরিদৃষ্ট হয়।
এথেন্সবাসীর কাছে এথেন্সের দুটো অর্থ ছিল: এথেন্স রাষ্ট্র হলো এর প্রতিষ্ঠানসমূহের সমষ্টি, আরেক অর্থ হলো, দেবি এথেনীয় জনগণের জাতি হওয়ার প্রতীক। এভাবে এথেন্সের রাষ্ট্র হওয়ার পেছনে প্যাগানিজমের ভূমিকা ছিল। হেগেলের মতে, রাজার আয়নায় রাজার চেহারা দেখা যায় না, দেখা যায় প্রজার চেহারা। প্রজারা যেমন হয়, রাষ্ট্র ও রাজারা তেমনই হয়। হেগেল কিন্তু জার্মান জাত্যাভিমানী ও অরিয়েন্টালিস্টও ছিলেন। তার মতে, প্রাচ্যে শুধু একজনই স্বাধীন যাকে তিনি ওরিয়েন্টাল ডেসপট বলেন। গ্রীক ও রোমে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণি ছিল স্বাধীন। ইতিহাস পরিক্রমায় একমাত্র খ্রিস্টানিটির আগমনের ফলেই এই অন্তর্দৃষ্টি জন্মে যে, মানুষ তার মানবসত্তার কারণেই স্বাধীন। চৈতন্যের স্বাধীনতাই, হেগেলের মতে, মানবসত্তাকে গড়ে তোলে। মানবজাতি ও খোদার মাঝখানে জেসাস খ্রিস্টের অবস্থান নির্ধারিত করায় তত্ত্বীয়ভাবে ক্যাথলিক খ্রিস্টানিটিতে পাপাসি বা পোপতন্ত্রের জন্ম। পোপদেরকে জেসাস ক্রাইস্টের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার মনে করা হয়। সুতরাং অনুসারীদের আধ্যাত্মিক দেখভালের দায়িত্ব পোপ ও সেইন্টদের।
এই পোপতন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ডক্ট্রিন হচ্ছে, মধ্যস্থতা বা ইন্টারমিডিয়ারির ধারণা। এই ডক্ট্রিন অনুসারে, ক্ষমালাভের জন্যে যাজকের দ্বারস্থ হতে হবে, ব্যক্তি যাজকের মধ্যস্ততা ছাড়া সরাসরি খোদার কাছ থেকে ক্ষমা লাভের যোগ্য হয় না। পোপতন্ত্রের আরেকটা দিক হচ্ছে, ইন্ডালজেন্সের Indulgence প্রসঙ্গ। অর্থাৎ কেউ কোনও পাপ করে ফেললে সেটির শাস্তি কমানোর ব্যবস্থা। এইটার নানা অপব্যবহার হয়েছে খ্রিস্টধর্মে। Pardoner বলে এক অফিসিয়াল থাকত যে চার্চের ক্ষমা বিক্রি করতো। মানে, চার্চ এমন হয়ে উঠেছিল যে, তারা বেহেস্তের টিকিট বিক্রিও শুরু করে। টাকার বিনিময়ে পাপের ক্ষমার ঘোষণা দেয়া হতো। সে অর্থগুলো চার্চ তার প্রভাব ও যাজকগণ নিজেদের ভোগ-বিলাসে ব্যয় করতো।
পোপতন্ত্রের আরেকটি দিক হচ্ছে, বাইবেলের প্রাথমিকতা ও অগ্রাধিকারের পরিবর্তে চার্চ বা পোপের ব্যাখ্যাই গ্রহণ করতে হতো। যেটাকে papal authority বলে। পোপতন্ত্রে, পোপ বা যাজকদের বা চার্চের অভ্রান্ততায় infallibility বিশ্বাস করতে বলা হয়। পোপতন্ত্রে ব্যাখ্যা অনেকটাই নির্বিচার ও যাজকশ্রেণির স্বার্থলগ্ন হতো।
অবশ্য মার্টিন লুথারের যে রিফরমেশন বা সংস্কার আন্দোলন তা ক্যাথলিক চার্চের উপরোক্ত সংকট থেকে জন্ম। প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন নামেও এটা পরিচিত। লুথারের ডক্ট্রিন অব টু কিংডম বলে একটি ধারণা আছে যেখানে তিনি কিংডম অব ল এবং কিংডম অব গ্রেস অথবা বলা যায়, ল এবং গোসপেলের পার্থক্য করেন। যেটাকে সম্প্রসারিত করে চার্চ ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ বলে অভিহিত করা হয়। রিফর্মেশন আন্দোলন প্রতিষ্ঠানের শক্তিকে Deemphasize করে এবং ধর্মগ্রন্থের সাথে প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের যে বন্ধন, এটাকে শক্তিশালী করতে বলে। প্রোটেস্টান্টানিজম এক অর্থে ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বানায়। ফলে, চার্চের সাথে রাষ্ট্রের বন্ধন ছিন্নর প্রসংগ আসে। আর, প্রোটেস্টান্টানিজম একধরনের ইনভিজিবল চার্চের কথা বলে। সংস্কারবাদীদের মতে, রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধর্মপালনে কোনও অসুবিধা নাই। জেমস মেডিসন (দার্শনিক কূটনীতিক, আমেরিকার চতুর্থ প্রেসিডেন্ট ) লুথারের ডক্ট্রিনকে আধুনিক কালের চার্চ ও স্টেটের সেপারেশনের সূত্রপাত বলে অভিহিত করেছেন।
হেগেল তার Philosophy of History বইয়ের The German World চ্যাপ্টারে খ্রিস্টিয় জগৎকে তিন পর্যায়ে ভাগ করেন: Kingdom of Father, Kingdom of Son ও Kingdom of Spirit। হেগেল মনে করতেন, সংস্কার আন্দোলনের ফলে জার্মান প্রবেশ করেছে কিংডম অব স্পিরিটে। যে জগতে চিন্তা পায় তার নিজের জীবন ও সংস্কৃতি, যেখানে রাজনৈতিক জীবনের ভিত্তি হবে র্যাশনাল প্রিন্সিপাল। হেগেল রাজনৈতিক আলোকায়ন, মানবমুক্তি, যুক্তি ইত্যাদি বিষয়কে খ্রিস্টানিটির কনসেপ্টের সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবেন। অবশ্য পরবর্তীতে কার্ল মার্ক্স হেগেলকে উল্টিয়ে ‘পায়ের উপর’ দাঁড় করানোর কথা বলবেন। তো, এইভাবে পশ্চিমা সভ্যতার অনেক ধ্যান-ধারণার উৎস খ্রিস্টান ধর্মের (বিশেষত, সাধু পলের খ্রিস্টানিটি) দার্শনিক বিচার, নানা বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা ও সংস্কার আন্দোলন। পশ্চিমবাহিত যেসব ধারণা বিশ্বময় প্রচার পেয়েছে ও ফেরি করা হচ্ছে তার আদি উৎস রেনেসাঁস, রিফরমেশন, এনলাইটেনমেন্টের দর্শন, তাদের মানুষ সম্পর্কিত ধারণা, পশ্চিমে সংঘঠিত নানা বিদ্রোহ-যুদ্ধ, এবং পশ্চিমের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যে নিহিত। জাস্ট, খসড়া আকারে কিছু চিন্তা এখানে টুকে রাখলাম। স্বাধীনতা, যুক্তি, সমতা, মানবিক মর্যাদা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, জাগতিকতা ইত্যাদি নানা গালভরা শব্দ ও ধারণার ইতিহাস আছে, যে ধারণাগুলোকে পশ্চিম সবার জন্যে পালনীয় বুদ্ধির বা চিন্তার নির্ণয় হিসেবে উপস্থাপন করে। এইসব নানা ধারণার ইতিহাস নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করা দরকার।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক