জগলুল আসাদের প্রবন্ধ ‘ক্রিটিকের ধারণা ও মুমিনের বিচারশীলতা’

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৬, ২০২১

সাধারণত ক্রিটিক ধারণাটি  ভালো-মন্দ বা ভুল-ত্রুটি নির্দেশ অর্থে ব্যবহার করা হয়। ক্রিটিক নামক ধারণার এই অর্থ-সংকোচন নিয়ে রেমন্ড উইলিয়ামস উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তার Key Words এ। থিয়োডর এডোর্নো  ক্রিটিক বলতে যেকোনো চিন্তা ও চর্চার ভেতরে যে Constellation of power থাকে, সেটির উন্মোচনকে বুঝিয়েছেন। হেবারমাস ক্রিটিক বলতে যেকোনো চিন্তার ভিত্তিমূলকে প্রশ্ন করা বুঝিয়েছেন। ক্রিটিকাল এটিচুডকে ফুকো একটা ভার্চু বা গুণ হিসেবে বর্ণনা করতে চান। ফুকোর মতে, ক্রিটিক শুরুই হয় নিরঙ্কুশ আনুগত্যের দাবিকে প্রশ্ন কোরে এবং প্রশাসনিক সমস্ত বাধ্যবাধকতাকে একটা যুক্তিমূলক ও চিন্তাশীল মূল্যায়নের অধীন করার মধ্য দিয়ে। ক্রিটিক ফুকোর কাছে Desubjugation of the subject বা কর্তার বন্ধনমুক্তি।

ক্রিটিসিজম শব্দের উৎপত্তি গ্রীক ক্রিয়াপদ krino থেকে। এর অর্থ আলাদা করা, যাচাই করা বা সিদ্ধান্ত নেয়া ইত্যাদি। প্রথম শব্দটি ব্যবহৃত হয় আইনি পরিসরে অভিযুক্ত করা ও রায় দেয়া, দুটো অর্থই বোঝাতে। রাইনহার্ট কোজেলাক তার Crisis and critique গ্রন্থ অনুসরণে বলা যায়, ক্রিটিক ব্যাপারটার আদি অর্থের ভেতরে সর্বজনীন কোনো সত্য জয়ের দাবি ছিল না, বরঞ্চ বিশেষ কোনো সংকটকে যযথার্থভাবে খোলাসা করা অর্থে এবং একটা বিশেষ জীবনপ্রণালির ভেতরে বিশেষ বিশেষ গুণের শোধন বোঝাতে এই ক্রিটিক পদ ব্যবহৃত হতো। ক্রিটিক বা বিচারের ধারণা ইতিহাসের সব পর্বে এক ছিল না। পশ্চিমে ক্রিটিক বলতে বর্তমানে যে ক্রিটিকাল এটিচুডকে বোঝায়, তার সাথে এনলাইটেনমেন্ট পিরিয়ডের যোগ আছে। আলোকিত হওয়া মানেই একটা ক্রিটিকাল এটিচুড অবলম্বন করা।

তালালা আসাদ মিশেল ফুকোর ক্রিটিক কী প্রবন্ধের সূত্র ধরে বলেন, ক্রিটিক কি পশ্চিমেরই একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য নাকি অন্যান্য চিন্তা-ঐতিহ্যেও ক্রিটিক ব্যাপারটা আছে, সে ব্যাপারে ফুকোর প্রবন্ধটি সুস্পষ্ট দিশা দেয় না। ফুকো নিজে চিন্তার ক্ষেত্রে জিনিওলোজিস্ট হলেও এই প্রবন্ধে জিনিওলজিকাল পদ্ধতিতে ক্রিটিক ধারণার বিবর্তন আলোচনা করেননি বলে তালাল আসাদ যুক্তি দেন। ইরফান হাবিব অবশ্য প্রবন্ধটি পাঠ করেছেব এইভাবে যে, ফুকোর কাছে ক্রিটিক ব্যাপারটা মূলত আধুনিক পশ্চিমেরই বৈশিষ্ট্য। অপশ্চিমা সমাজ  যে ক্রিটিক করতে সক্ষম, এই প্রসঙ্গ ঘূণাক্ষরেও তোলেননি ফুকো। ফুকোর মতে, প্রোটেস্টান্ট মুভমেন্ট হচ্ছে প্রথম ক্রিটিকাল মুভমেন্ট। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ক্রিটিক বলতে বোঝানো হতো ফ্রী স্পীচকে, যাকে বলে পারেশিয়া। পলিটির পরিসরে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও সত্যকে সরাসরি, অলংকারবিহীনভাবে প্রকাশ করাকেই পারেশিয়া বলা হতো।

লেইট মেডিয়েভল পিরিয়ডে কীভাবে জীবনযাপন করতে হয়, এটা শিখানোও ক্রিটিকের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মূলত ধর্মগ্রন্থ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন ছিল এই সময়ের ক্রিটিক। সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত সন্দেহবাদী পিয়ের বেইলি মনে করেন, ক্রিটিক হচ্ছে যুক্তিকে ওয়াহি থেকে আলাদা করার কাজ। এই সময় হিস্টোরিকাল ক্রিটিসিজম বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গ্রিক ক্লাসিকাল টেক্সট ও স্ক্রিপচারগুলো নিয়ে ব্যস্ততা এই সময়ে বেড়ে যায় বেশ। বেইলি সমস্ত তত্ত্বের ব্যাখ্যায় যুক্তি দাবি করেন এবং মনে করেন যে, যা কিছু যুক্তিশীল বলে এরই মধ্যে গৃহীত তাকে ক্রিটিকাল রিজনিংয়ের মাধ্যমে নস্যাৎ করা যেতে পারে। কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে নত হওয়া ছাড়াই  সবাই সমতার ভিত্তিতে একে অপরের সাথে যুক্ত হতে পারে। বেইলি একটা Republic of letters এ আস্থা রাখতেন। এই সতের শতকীয় জ্ঞান উৎপাদনের সংস্কৃতিতে বিচার ও সাক্ষ্যের ভিত্তি ছিল সামাজিক আস্থা আর ভদ্রোচিত কোনো কর্তৃপক্ষ।

ফুকোর What is critique প্রবন্ধের দুর্দান্ত পাঠ হাজির করেছেন জুডিথ বাটলার। জুডিথ বাটলার বলেন,  যা বা যেটিকে ক্রিটক করা হচ্ছে তা থেকে সম্পুর্ণ আলাদা কোরে বিমূর্ত ও জেনারালাইজড প্র‍্যাকটিস হিসেবে ক্রিটিককে বিবেচনা করলে ক্রিটিক তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। ক্রিটিক সবসময়ই ডীল করে বিশেষ কোনো চর্চা, প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠিত চিন্তা বা ব্যবস্থা কিংবা বিশেষ কোনো জ্ঞানখণ্ডকে। জুডিথ বাটলার ফুকোর ক্রিটিকের ধারণার কেন্দ্রীয় প্রণোদনাকে চিহ্নিত করেন How not to govern এই প্রশ্নের মধ্যে। ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে এই প্রশ্নটিই আরো সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করে এই প্রশ্নে যে, What are the limits of the right to govern? ফুকোর সূত্র ধরে জুডিথ বাটলার বলেন, ক্রিটিকের দুটো কাজ। এক. কিভাবে জ্ঞান ও ক্ষমতা মিলে জগতের শৃঙ্খলা গঠন করে এবং সেটি নিজের শর্তেই কী কোরে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে সেটি দেখানো। দুই. সেই ব্রেকিং পয়েন্টও নির্দেশ করা যেটি এই ব্যবস্থার অভ্যুদয় ঘটায় এবং বিলয়ও ঘটাতে পারে।

ক্রিটিকের কোনো একক সংজ্ঞা সম্ভব না। এটি একটি ফ্যামিলি কনসেপ্ট। রিলিজিয়াস ক্রিটিক আর সেকুলার ক্রিটিক এই দুইভাগে বিভক্ত হয়ে ক্রিটিকের ইতিহাস প্রবাহিত নয়। ক্রিটিক নিজেকে হাজির করতে পারে নানা ফর্মে, নানা সুরত ও হালে। প্যারোডি, স্যাটায়ারের মাধ্যমেও ক্রিটিক করা সম্ভব, নিজের পাপের স্বীকারক্তিও ক্রিটিক, তাওবাও এক প্রকার ক্রিটিক, মুহাসাবা বা নিজের হিসাব নিজে নেয়াকেও ক্রিটিক বলা যাবে, ইসলাহ-প্রচেষ্টাও তো ক্রিটিক। ইসলামের হিসবা বা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকেও ক্রিটিকের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক লেখালেখির অন্যতম কাজ ক্রিটিক করা। এই ক্রিটিকও করা হয় একাডেমিক ও প্রফেশনাল নানাবিধ শর্তাবলি মেনে নিয়েই। ক্রিটিকের একক কোনো অধিক্ষেত্র নেই।

মুসলিম মাত্রই বিচারশীল। তাকে আত্মবিচার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রবিচারও করতে হয়। প্র‍্যাকটিসিং মুসলিমের জন্যে ব্যাপারটা প্রায় প্রাত্যহিকই। সে কতটা ইবাদত করলো, কোনো অন্যায় করলো কিনা, কারো হক মারলো কিনা, কোনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলো কিনা, নামাজ কাজা হলো কিনা, ইলমের পথে সে কতটুকু অগ্রসর হলো, কোনো ইলমি বা আমলি ভুল হলো কিনা—নিজেকে নিয়ে এই বিচারটুকু একজন মুমিন মুসলমানকে নিয়মিত করবার কথা বা করতেই হয়। এই যে চর্চা এটাকে মুহাসাবা বলে, অর্থাৎ হিসাব নেয়া, নিজেকে নিজে নিরীক্ষণের আওতায় রাখা। এই আত্মনিরীক্ষণ একটা সেল্ফ-ক্রিটিক, নিজেকে আরো বেশি শুদ্ধ বা কামেল কোরে তুলবার প্রক্রিয়া এটি। এটা তার সাবজেক্টিভিটিরও (আবদিয়াত) চর্চা।  একজন মুসলিমের দায়িত্বই হক কথা বলা। সে নিজ বা অপর, যার ক্ষেত্রেই হোক। আইডিয়ালি তাকে হকের ওপরেই থাকতে হবে। নিজের বা নিজ গোত্রের বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গেলেও তাকে আদল বা ইনসাফই করতে হবে। আদল বা ইনসাফ হকেরই একটা পার্ট বলা যায়। কখনোই অন্যের যে অধিকার, তা নষ্ট করা যাবে না।

মুসলিমের যে বাক-স্বাধীনতা এইটা রেস্ট্রিকটেড হয় এই বিধি দ্বারা যে, সে গিবত করবে না, নামীমাহ করবে না, কিযব বলবে না। তার হক কথা অপর ব্যক্তির তরে গিবত, নামীমাহ বা কিযব মুক্ত হবে। হক কথা বলা নিজেই একটা ক্রিটিক বা বিচার। Speaking truth/embarrassing truth to the power এর নমুনা ও নকীব, মুসলমান ব`লে দাবিদারকে হয়ে উঠতে হয়। অত্যাচারীর সামনে হক কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ ব`লে যে নববি বাণী আছে, তা কিন্তু ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে সত্যকে সমুন্নত ও সত্যের পক্ষাবলম্বনের দায় ও দায়িত্বের কথাই মনে করিয়ে দেয়। নবি (সা.) একবার বললেন, (মর্মার্থ) তোমরা নিজেকে ছোট করো না। সাহাবিরা নিজেকে ছোট করার অর্থ কি জানতে চাইলেন। নবিজি জানালেন, যেখানে যে কথাটি বলা উচিত সেখানে সে কথা না বলা। সুতরাং, মুসলিমের দায়িত্ব নিজেকে ছোট না করা! আর, সেই বিখ্যাত হাদিস সবার জানা, যেখানে অন্যায়ের প্রতিবাদের সামর্থ অনুসারে ঈমানের তিনটি স্তরের কথা বলা হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্তত কথা দিয়ে প্রতিবাদ ঈমানের দ্বিতীয় স্তরের মধ্যে পরে। প্রথম স্তর হাত বা ক্ষমতা দিয়ে প্রতিহত করা, আর ন্যুনতম স্তর অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা, তারপর আর ঈমানের অস্তিত্ব নাই।

সামষ্টিক ও ব্যক্তিগতভাবেও মুসলিমদেরকে হিসবার দায়িত্ব পালন করতে হয়। অর্থাৎ, আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার বা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের দায়িত্ব। এই দায়িত্বকে আপনাদের পরিভাষায় ক্রিটিকও বলা যাবে, আবার মহাত্মা তালালের সূত্রানুসারে (মাইকেল কুক ও মিশরি এক শাইখের বরাতে), অপর ভাই বা বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব হিসেবে, এমনকি ফুকোর পরিভাষায় Care of the self হিসেবেও এই হিসবাকে পাঠ করতে পারেন, আর রাষ্ট্রীয় পরিসরে এইটাকে জুডিশাল সিস্টেমেও ইনকরপোরেটে করা যায়৷ ওয়ায়েল হাল্লাক জানান দেন। আধুনিক-পূর্ব জমানায় হিসবাহ কোনো ‘ল’ ছিল না। ছিল ট্র‍্যাডিশন বা নরম্যাটিভ প্র‍্যাকটিস। অর্থাৎ, ব্যক্তি মুমিন এইটাকে দায়িত্ব মনে করতো যে, অন্যায়কে তার নিষেধ করতে হইবো। আর, নসিহাও কিন্তু a form of critique।

যাক, সাঈদের বা ফুকোর সংজ্ঞা ধইরা যদি ক্ষমতার সামনে সত্য/বিব্রতকর সত্য বলাই যদি ইন্টেলেকচুয়ালিটি হয়, তাইলে কিন্তু মুমিন-মুসলামান মাত্রই ইন্টেলেকচুয়াল। এভরি ট্রুলি প্র‍্যাকটিসিং মুসলিম ইস এন ইন্টেলেকচুয়াল। এইটা না মানলেও কোনো অসুবিধা নাই। একজন মুসলিম যথার্থ আব্দুল্লাহ হলেই সে সফল, আর সব কিছুই তার কাছে নিম্নতম স্তরের।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক