জগলুল আসাদের গদ্য ‘অধ্যাপক অসিত কুমার ও তাঁর হাজিরানা’
প্রকাশিত : মে ১০, ২০২৪
নিজেকে যখন একটু পরিশীলিত ক`রে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপনের উদ্যোগ নিই, কিংবা যখন প্রমিত উচ্চারণ দিয়ে কোনো কিছুকে অভিব্যক্ত করতে চাই, সেই উদ্যোগ ও চাওয়াতে অসিত কুমার মিশে থাকেন। ইংরেজি কোনো কাব্যপঙক্তিকে যখন বাংলায় অনুবাদের কথা ভাবি, অথবা পোশাককে যখন ইস্ত্রির তৎপরতায় নিভাঁজ করতে চাই, তখনও অনুরণিত হয়ে ওঠেন অসিত কুমার। যখন তাকাই কোনো বইয়ের আনাড়ি প্রচ্ছদের দিকে কিংবা দেয়ালে আঁটানো কোনো রঙচঙে ব্যানারে, বারবার মনে পড়ে রঙের এই বিন্যাস দেখে অসিত স্যার কী ব`লে উঠতেন!
কোনো ম্যাগাজিনের নাম শুনেই বুঝে যাই, অসিত স্যার এক শোনাতেই বলে দিতেন ‘এটি মফস্বলি নাম’। এইভাবে আমাদের যাপিতজীবনের নানা পরতে পরতে অসিত কুমার তাঁর শিল্পিত রুচি নিয়ে হাজির থাকেন। তাঁর যেন প্রয়াত হওয়ার সুযোগ নেই! বিভাগে বসলে যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই তিনি আছেন। তাঁর পছন্দ করা পর্দাটা ঝুলছে জানালায়, তাঁর বাছাই করা রঙ উজ্জ্বল হয়ে আছে চার দেয়ালে, তাঁরই নির্দেশিত আলোকবিন্যাস দ্বীপ্তি ছড়াচ্ছে সিলিংয়ে। তাঁর দৈহিক তিরোধান আমাদের ঐহিক জীবনে তাঁকে নাই ক`রে দিতে পারেনি মোটেও, পারবেও না।
আমার ডেস্কের মুখোমুখি তাঁর শূন্য চেয়ার এখনও তাঁর উপস্থিতিকেই জানান দেয় তীব্র। এখনও তাঁর চোখে চোখ পড়ে, নৈঃশব্দ্য বিনিময় হয়! চুপ ক`রে সরবে আছেন তিনি। তাঁর ইচ্ছেগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে সবখানে। আমি জানি, অসিত কুমার তাঁর স্বপ্ন ও ভিশন নিয়ে ক্রমপ্রসারমান। এক যুগ ধ`রে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি তাঁকে। তবে সম্পর্কটি সহকর্মীর আনুষ্ঠানিক পরিসর পেরিয়ে আরও ব্যপ্ত ও নানা মাত্রিক হয়ে উঠতে পেরেছিল। তিনি কখনো হয়ে উঠেছিলেন আন্তরিক বন্ধু, সহমর্মী, বড় ভাই, কখনো সহৃদয় পরামর্শক, আর কখনোবা স্নেহময় প্রশ্রয়দাতা।
আমার ছেলে আরাফের স্টুল-সমস্যা নিয়ে একবার পোস্ট দিয়েছিলাম ‘ডাক্তারবাড়ি’ গ্রুপে। তখন করোনা সংক্রমণ তুঙ্গে । ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব, এ সাহস হচ্ছিল না। ‘ডাক্তারবাড়ি’ গ্রুপের পোস্টটি অসিত স্যারের নজরে আসে। তিনি আমার কাছ থেকে আমার ছেলের সমস্যার ডিটেইল জিজ্ঞেস করেন। তারপর তিনি নিজে তাঁর পরিচিত এক বড় ডাক্তারকে সব জানান এবং ডাক্তার কিছু পরীক্ষার পরামর্শ দেন। আমার জানা ছিল না, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হোম সার্ভিস আছে। তিনি নিজ উদ্যোগে ফোন নম্বর যোগার করে টেকনিশিয়ানকে আমার বাসায় এসে স্টুলের নমুনা নেওয়ার ব্যবস্থা করেন ৷
পরে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে ওই পরীক্ষার রিপোর্ট দেখিয়ে প্রেস্ক্রিপশানেরও ব্যবস্থা করেন। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম তাঁর তৎপরতা, মানবিকতা আর মমতাটুকু। অনেক সহকর্মীরই এরকম অভিজ্ঞতা থাকা সম্ভব তাঁকে নিয়ে। তিনি তাঁর ভালোবাসা বা স্নেহ প্রকাশ করতেন নীরবে। জানতেন কীভাবে সহকর্মী বা প্রিয়জনকে অবাক ক`রে দিতে হয়। ২০১২ সালের দিকে একবার তিনি ভিজিটিং কার্ড বানান। অবাক ক`রে দিয়ে আমার জন্যেও বানিয়ে আনেন ৩০০ পিছ। একদিন আমাকে বিস্মিত ক`রে দিয়ে আমার ছেলে জারিফের পোস্টার সাইজের লেমিনেটিং করা বড় তিনটি ছবি নিয়ে হাজির হলেন অসিত স্যার।
আবার, নামাজি সহকর্মীদের অজু করতে অসুবিধা হয় দেখে বিভাগে তিনি নিজ উদ্যোগে ছোট একটা ওজুখানারও ব্যবস্থা করেন। সহকর্মীদের প্রতি এমন রহমদিল আর কাউকে দেখিনি। দেখব যে, এমন আশাও নেই। সিনিয়র সহকর্মী হিসেবে জুনিয়রদের গড়েপিটে তুলবার এমন দায়বোধ অসিত কুমার ছাড়া আর কার আছে! যে কোনো টেক্সটকে শ্রেণিকক্ষে আমি যে ধরে ধরে পড়াই, প্রতিটি শব্দ ও লাইন ব্যাখ্যা ক`রে ক`রে পড়াই মাঝে মধ্যেই, সেটির অনুপ্রেরণা লাভ করেছি অসিত কুমার স্যারের কাছ থেকে। সময় থাকা সত্ত্বেও মূল টেক্সট না পড়িয়ে শ্রেণিকক্ষে শুধু আলোচনা করে দেওয়াকে অসততা মনে করতেন অসিত স্যার।
প্রায় এক দশক আগে বলা তাঁর কথাটি এখনও কানে বাজে: আপনি চিন্তক, আপনার উচিত শিক্ষার্থীদের কীভাবে পাঠ ও ব্যাখ্যা করতে হয় সেটি শেখানো, চিন্তার সৌন্দর্য শেখাবেন ওদের, সাহিত্যের উন্নত রুচি গড়ে তুলুন ওদের মধ্যে। খুব মগ্ন হয়ে আত্মকথনের মতো ক`রে উচ্চারণ করেছিলেন বাক্যগুলো। তাঁর এই পরামর্শ, সময় ও সাধ্যে যতটুকু কুলায়,আমি মেনে চলবার চেষ্টা করি। নবীন ও ভাবি শিক্ষকদের জন্যেও অনুসরণীয় তাঁর এই পরামার্শ।
অসিত কুমার বহুপাঠী মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর ছিল দারুণ অন্তর্দৃষ্টি। তাঁর মতো বুঝবার ক্ষমতা, আমার দেখা, হাতেগোণা দু`চারজন মানুষের আছে। কোনো বিষয়ে কয়েকটা আর্টিকেল আর দু`চারটা বই পড়ার পর আমার যা অধিগম্য হতো, সহজাত ক্ষমতায় খুব অনায়াসে কয়েক মিনিটেই তিনি তা বুঝে যেতেন। নিবিড় আলাপে বোঝা যেত জীবন, জগৎ ও সাহিত্য সম্পর্কে নিজস্ব দার্শনিক উপলব্ধি ছিল তাঁর। চিন্তার দিক থেকে উদারনৈতিক মানবতাবাদী ছিলেন। ছিলেন সৌন্দর্যপিপাসু, শৈল্পিক আনন্দের অন্বেষক! জীবনের আনন্দময় যাপনকে গুরুত্ব দিতেন তিনি। বাঁচতে চাইতেন কর্মমুখর হয়ে, শিল্পমগ্ন হয়ে।
ছন্দ আর ধ্বনিসুষমা খুব ভালো বুঝতেন। ধ্বনিগত গড়বড় তিনি নিমিষেই বুঝে যেতেন, তা হোক কাব্য বা গদ্য-পঙক্তির, বা কারো গায়কীর। অপ্রমিতের প্রতি কোনো বিরাগ ছাড়াই বাংলা বা ইংরেজি ভাষার প্রমিত বা স্ট্যান্ডার্ড উচ্চারণ আয়ত্ত করা উচিত ব`লে তিনি মনে করতেন। এই মনে করার পেছনেও কার্যকর ছিল তাঁর সৌন্দর্য ও শিল্পবোধ।
বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে শিক্ষার্থীরা যখন তাঁর কাছে আবৃত্তি বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসত, কী দারুণভাবে ভেঙে ভেঙে তিনি কবিতা বোঝাতেন, আমি হতবাক হয়ে যেতাম। কোথায় যেয়ে কবিতার একটা বাক্য পূর্ণ হলো, কোন শব্দটা একটু টেনে উচ্চারণ করলে ছন্দ ঠিক থাকে, কবিতার ভাব বুঝে কীভাবে কোথায় কণ্ঠের উঠানামা হবে, কোন অংশটুকু নিরাসক্তভাবে পড়ে যেতে হবে, আর কোথায়ই-বা যুক্ত করতে হবে আবেগের আরেকটু আসক্তি , এ-সব কিছু দুর্দান্ত দক্ষতায় তিনি বোঝাতেন।
সব কিছুতে আতিশায্য এড়িয়ে চলা ও পরিমিতিবোধ ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। সৌন্দর্যের এক ধ্রুপদী রীতি তিনি মেনে চলতেন, চলনে-বলনে-লিখনে, এমনকি ভোজনেও। তাঁর গদ্য আমার প্রিয়। যদিও তিনি লিখেছেন খুব অল্প, কিন্তু সেগুলো অসিতীয় বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। আঞ্চলিক শব্দের চকিত ব্যবহার, শব্দ নিয়ে ক্রীড়া, বীর্যবান বাক্যবিন্যাস, ধ্বনিসুষমা এবং এক অন্ত:সলীলা রসদীপ্তি তাঁর গদ্যের সিগনেচার। আমার মনে হয়েছে, তাঁর গদ্যভঙ্গি এমনই বিশিষ্ট্য যে তা দিয়ে ততটুকুই লেখা যায়, যতটুকু তিনি লিখেছেন। এই গদ্য দিয়ে পাতার পর পাতা ভরে ফেলা যায় না। সংখ্যার স্বল্পতাতেই ধরা থাকে তার সৌন্দর্য।
বাক্যের ভেতরের অন্তর্লীন ছন্দের দিকে থাকত তাঁর সযত্ন মনোযোগ। এমনকি কারো লেখা তাঁকে এডিট করতে দিলে তিনি সাগ্রহে খেয়াল করতেন, কোন বাক্য এলিয়ে পড়ল কিনা, কোন বিশেষণের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বাক্যের ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটালো কিনা, কোন শব্দ বাক্যটিকে নুইয়ে দিল কিনা, ইত্যাদি। চিন্তা, আবেগ ও ধ্বনি সুষমার সম্মিলিত অভিঘাত তিনি দেখতে চাইতেন বাক্যে,লেখায়।
]
অসিত কুমার তাৎক্ষণিকভাবে চমৎকার অনুবাদ করতে পারতেন। আবিষ্কার করতে পারতেন বাংলা কবিতার ভেতরে ইংরেজি কবিতার অনুরণিত মূহুর্তকে। এক আলাপচারিতায় কীটসের ওড টু নাইটিঙ্গেল কবিতার Now more than ever seems it rich to die/To cease upon the midnight with no pain অংশটুকুকে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি সম্পৃক্ত করে ফেললেন ডি এল রায়ের এই পঙক্তির সাথে: এমন চাঁদের আলো– মরি যদি সেও ভালো।
জীবনের সমৃদ্ধ ও সুখদ সময়ই মৃত্যুর উপযোগী। নাইটেনঙ্গেলের পরিপূর্ণ আনন্দের জগতে মধ্যরাত্রীতে বেদনাবিহীন মৃত্যুর কথা বলেছিলেন কীটস। অসিত কুমারও ইহধাম ত্যাগ করেন মধ্যরাত্রি পেরিয়ে সুবেহ-সাদিকে। ভোর ৫:১৩ মিনিটে। সকাল পৌনে সাতটায় আমরা যখন নারায়ণগঞ্জ পৌঁছাই, তখন তিনি অনন্ত ঘুমের দেশে চলে গেছেন। আক্ষরিক অর্থেই তাঁর মুখটাকে এক ঘুমন্ত মানুষের মুখই মনে হয়েছে। গৃহের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে ক্লান্তিহীন, সৌম্য ও শান্ত মুখশ্রী নিয়ে শায়িত ছিলেন তিনি, শ্বেতশুভ্র আভরণে সজ্জিত হয়ে। ভোরের নিস্তব্ধতায় তাঁর মুখটাকে এতো নিষ্পাপ ও আলোময় লাগছিল!
এমিলি ডিকিনসন কথিত জীবনের সমস্ত labour and leisure পেরিয়ে সেই অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্যের ডাকে তিনি যাত্রা করেছেন নিঃসীম অনন্তের পথে, যেখানে মরণেরও মৃত্যু হয়! ব্যক্তিগত কথোপকথনে জানি, মৃত্যু ভয় তাকে তাড়িত করত না তেমন। যখন তিনি শয্যাশায়ী, তখনও সজাগ ছিল তাঁর ভদ্রতা ও শোভনতার বোধ, ওই মূহুর্তেও তিনি নিজেই সান্ত্বনা দিতেন স্ত্রী, মাতা ও পুত্রদ্বয়কে। জীবনে তিনি যেমন সুন্দর ছিলেন, মরণেও তিনি ছিলেন তেমনি সুশ্রী! সারাটা জীবন তাঁর যা আরাধ্য ও প্রার্থিত ছিল, তার নাম সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের সব অর্থকে তিনি ধারণ করেছিলেন জীবনে, ও জীবন পেরিয়েও।
সম্ভবত চিন্তা,তৎপরতা ও ব্যক্তিত্বের বিভায় জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখতে পারেন এমন কর্মকর্তা আমাদের শিক্ষা ক্যাডারে বিরল। ভিশন ও যোগ্যতায় অসিত কুমার ছিলেন সেই বিরলদের মধ্যে একজন। সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে , যেমন,শিল্পকলা একাডেমি কিংবা নজরুল ইন্সটিটিউটে, অধিকর্তার পদে অধিষ্ঠিত হবার সব যোগ্যতা ছিল তাঁর। জীবনানন্দ দাশ কিংবা নজরুল নিয়ে সুপরিসর সংকলন তাঁর উদ্যোগে আমরা সম্পন্ন করেছিলাম। এই উদ্যোগকে সত্যিকার অর্থেই ফলপ্রসূ করবার লক্ষ্যে তিনি পরিকল্পনা করেন চারটি ক`রে ইন্টারেক্টিভ সেমিনার আয়োজনের।
সরকারি কলেজ পরিসরে এই পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অনবদ্যতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টগণ বুঝবেন সহজেই। নজরুল বিষয়ক পুস্তকাদি ও লেখাজোখা নিয়ে ইছামতী নদীর তীরে ক্যাম্পিংয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনিই। আমাদের তৎকালীন উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ শাজাহানের বিরাট বাংলোবাড়িতে,জাহান ফকিরের আস্তানায়। উদ্দেশ্য ছিল প্রুফ্র-রিডিং ও প্রাপ্ত লেখাগুলো নিয়ে নিজেদের বোঝাপড়া পরিচ্ছন্ন করা। খুব আনন্দময় ও শিক্ষাপ্রদ ছিল আমাদের সেই সম্মিলন। একদম ইনোভেটিভ চিন্তা। তাঁর আরেকটা পরিকল্পনা ছিল, বড় পরিসরে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সেমিনার করবার। তিনি বেঁচে থাকলে পরিকল্পনাটি অবশ্যই আলোর মুখ দেখত।
Thinking globally, acting locally এই আপ্তবাক্যের মূর্ত নজির ছিলেন অসিত কুমার। উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের বৃহৎ হৃদয় ও নিপুণ দক্ষতা ছিল তাঁর। স্থানীয়কে জাতীয় ক`রে তুলবার এই স্বপ্নাশার অনিঃশেষ উৎস হয়ে থাকবেন তিনি। ইংরেজি বিভাগকে দৃষ্টিনন্দন ও প্রযুক্তিগতভাবে সমৃদ্ধ করবার জন্যে তিনি তাঁর সবটুকু সামর্থ্য নিয়োগ করেছিলেন। অত্যাধুনিক সুবিধাদি দিয়ে বিভাগকে সজ্জিত করবার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাঁর অসম্পন্ন ওই স্বপ্ন ও পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে। বিভাগীয় প্রধান হয়েও তিনি আদেশের ভঙ্গিতে কথা বলতেন না কখনো।
তিনি যতটা বস ছিলেন, তারও বেশি ছিলেন লিডার। বস বলেন কী করতে হবে; আর, লীডার দেখিয়ে দেন কীভাবে কাজ করতে হয়। অসিত স্যার আপাদমস্তক কর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন, নিজ হাতেই অনেক কিছু করে ফেলতেন। অপেক্ষা করতেন না অন্যে করবে বলে । অপরকে আদেশ দিয়ে কিছু করানার চেয়ে নিজ উদ্যোগেই কাজটি সম্পন্ন করতে পছন্দ করতেন। বিভাগীয় প্রধান হবার পর যতদিন সুস্থ ছিলেন, প্রতিদিন ৯ টার আগেই বিভাগে উপস্থিত হতেন তিনি। প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে। তাঁর এই তৎপর স্বভাব আমাদেরকেও প্রাণিত করতো আলস্যের আড়মোড়া ভেঙে কর্মমুখর হতে।
প্রায় এক যুগের সান্নিধ্যের সৌরভ ভাষায় গেঁথে তোলা অসম্ভবই। তবে বলতে পারি, এক মার্জিত ও উন্নত রুচিবোধ তিনি সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন আমাদের মধ্যে। আমরা যারা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, তাঁরা আর আগের মানুষটি থাকিনি। আমাদের সচেতন ও অচেতন যাপনের অনেক অনুষঙ্গে তাঁর উপস্থিতি এখন আরও প্রাত্যহিক। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর প্রশ্রয়কে মিস করি। তিনি হয়তো আমার শেষ প্রশ্রয়দাতা, যিনি আমাকে বুঝতেন প্রায় সবটুকু,মানে বুঝতেন আমার আলস্য-ঔদাসীন্য ও নির্বিকারত্বের। আমার কাছে তিনি ছিলেন এক সিন্দুক , অর্গল খুলে যাকে বলা যেত মনের সব সুপ্ত কথা, গুপ্ত অনুভব।
আর কেউ থাকলো না যাকে মনের অর্গল খুলে এভাবে বলা যাবে সব। তবুও তিনি যে হাজির থাকেন আমাদের প্রাত্যহিক প্রাতিষ্ঠানিক কর্ম ও পরিকল্পনায়, তাঁর সেই হাজিরানাকে বুকে আগলে রাখি, উদযাপন করি আমি ও আমরা। এখনও। এবং সম্ভবত অনাগত সময়েও।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক