জগলুল আসাদের কলাম ‘রাষ্ট্রের ধর্মভাব’
প্রকাশিত : মে ৩১, ২০২০
আমাদের প্রচলিত আলোচনায় রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সম্পর্কহীনতা বা সকল ধর্মের প্রতি সমান আচরণ বা সমান উদাসীনতা বোঝাতে ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু প্রায়শই আমাদের আলোচনা ভুলে থাকে যে, রাষ্ট্রের চরিত্রও ধর্মীয়। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কাছ থেকে যে অখণ্ড ও নিরবিচ্ছিন্ন আনুগত্য দাবি করে থাকে, ধর্মও তা-ই করে। রাষ্ট্র পবিত্রতার কতগুলো সিম্বল নির্মাণ করে। যেমন পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, শহিদ মিনার, জাতির স্থপতি ইত্যাদি। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় দাঁড়ানো, শহিদ মিনারে খালি পায়ে যাওয়া এগুলো রাষ্ট্রীয় সিম্বলে পবিত্রতা আরোপ করে। রাষ্ট্রীয় নানা দপ্তরে ছবি টাঙ্গিয়ে রাখার প্রতীকী ব্যাঞ্জনা আছে, রাষ্ট্রীয় তরফের রাজনীতি আছে। কেউ পতাকাকে লাঞ্ছনা করলে বা ছবি নামিয়ে ফেললে, এমনকি জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করার কথা বললেও সেটা রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে ফেলা হয়। ঠিক যেমনটা ধর্ম ধর্মদ্রোহীতাকে অনেক সময় রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে শাস্তির কথা বলে। কেউ যদি রাষ্ট্রের স্থপতির বিরুদ্ধে বা সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে কিছু বলে সে প্রায়শই শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। আবার ধর্মের পরিসরে যেমন ইসলামে, কেউ যদি রাসুলের নিন্দামন্দ করে, সেই ‘শাতিমে রাসুল’ শাস্তিযোগ্য হয়। তথকথিত সেকুলার রাষ্ট্রে আদালতের কোনও সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করলে বা বিরোধিতা করলে আদালত অবমাননার মামলা হয়। পবিত্রতা তখন শুধু ধর্মের জগতেরই বোধ নয়, রাষ্ট্র ও রাজনীতির ইহপরিমণ্ডলেরও উপলব্ধি।
রাষ্ট্রের জাতীয় উৎসবগুলো ধর্মের আচার অনুষ্ঠানেরই সদৃশ। ধর্মের আছে দোজখ/নরক আর রাষ্ট্রের আছে কারাগার, পাইক-বরকন্দাজ ও শাস্তির নানা কারিগরি। রাষ্ট্রের কাছে সংবিধান ‘বিধান’ এর মর্যাদা পায়, যেমন ধর্মও বিধান দেয়। ধার্মিক বরাত দেয় ধর্মগ্রন্থের, আর রাষ্ট্র দেয় সংবিধানের। শহিদ মিনারে খালি পায়ে উঠবার যে পবিত্রানুভূতির নির্মাণ চলে, তা-ও সেকুলারিজমের ধর্ম হয়ে উঠবার নজির, রাষ্ট্রের ধর্ম হয়ে উঠবার বাসনার প্রতীক। রাষ্ট্রভাষাকে সেকুলারিজম ডিফেন্ড করে, কিন্তু যখনি রাষ্ট্রধর্মের প্রসঙ্গ আসে তখন সেকুলার রাষ্ট্র গাইগুই শুরু করে। সুতরাং রাষ্ট্র নিজেও একটা ধর্মতাত্তিক প্রকল্প; রাজনীতিও জগতে ধর্মেরই সম্প্রসারণ। যখন রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিজেকে ধর্ম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করারা ঘোষণা দেয়, তখন তারা তাদের নিজেদেরই ধর্ম হয়ে ওঠার বাসনাটুকু লুকিয়ে নিজেকে জাগতিক ছদ্মাবরণে হাজির করে। রাষ্ট্র ইহলোকের ধর্ম হতে চায় যাকে সে ধর্মনিরপেক্ষতার ছ্দ্মাবরণে হাজির করে। তাই রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম নাই যারা কন, তারা সঠিক বলেন না। সেকুলার রাষ্ট্র নিজেই ধর্ম হয়ে উঠতে চায়। তাই সে ধর্মের সীমা টেনে দিতে ইচ্ছুক হয়, ধর্মের ব্যাপারে নানা সিদ্ধান্ত সে হাজির করে। তাই সে মাদ্রাসাকে সেকুলারাইজ করে নিজের অস্তিত্বের প্রতি হুমকিকে ব্যবস্থাপনার অধীনে নিয়ে আসতে চায়। সেকুলার রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের অম্ল-মধুর সম্পর্কের গোড়া পাওয়া যাবে রাষ্ট্র বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধর্মবাসনার ভেতরে।
রাষ্ট্রের এই ধর্মবাসনার কথা বলছি W.T Cavanaugh এর Migration of the Holy (২০১১) বলে আলোচনাটির সূত্র ধরে। Cavanaugh দেখাচ্ছেন, যদিও ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার কথা বলা হয়, তবে আসল কথা হলো, পবিত্রতার ধারণা চার্চের বদলে জাতিরাষ্ট্রের দিকে স্থানান্তরিত হয়। চার্চের ভূমিকা দখল করে নেয় জাতিরাষ্ট্র। এটাকে তিনি migration of the holy বলে অভিহিত করেন। জাতিরাষ্ট্রই হয়ে ওঠে আধুনিক চার্চ। তিনি তাঁর Myth of religious Violence (২০০৯) বইয়ে দেখান, ধর্মসাপেক্ষতা-ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্ম-রাজনীতি এই যে যুগ্মবৈপরীত্ব বা বাইনারিসমূহ এগুলো পশ্চিমা আবিষ্কার। তিনি এই বইটিতে প্রায় চল্লিশটি উদাহরণ দিয়ে দেখান যে, ‘ধর্ম সমস্যা আর রাষ্ট্র সমাধান’ এটি ভুয়া কথা। সেকুলার নেশন স্টেটকে সবকিছুর দাওয়াই ভাবাই একটা সমস্যা, সমাধান তো নয়ই। হোসে কাসানাভোর ফ্রেইজ ব্যবহার করে তিনি ধর্মের (ক্যাথলিক বনাম প্রোটেস্টান্ট) নামে পরিচালিত যুদ্ধ যে আসলে wars of early modern European state formation বা প্রাক-আধুনিক ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র গঠনের যুদ্ধ, সেটিকে সামনে আনেন।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে ছোট ছোট তিনটি বেতার-কথিকা প্রচার করেন। The false God of Science, The false God of Nationalism, The false God of Money এ শিরোনামত্রয়ীতে। ‘জাতীয়তাবাদের মিথ্যা খোদা’ কথিকায় তিনি দেখান, একালে জাতীয়তাবাদ ধর্ম হয়ে উঠেছে, আর এই জাতীয়তাবাদের আকীদা-বাক্য: My country—right or Wrong। তিনি তুলে ধরেন সেই ১৯৫৩ তেই যে, বিজ্ঞানও একালে ধর্মের জায়গা নিয়ে নিয়েছে, মানি নিয়েছে খোদার জায়গা, সবাই যেন পুজো করছে রাষ্ট্রের, বিজ্ঞানের আর অর্থের। আর কার্ল স্মিত তাঁর Political Theology বা রাজনীতির ধর্মতত্ত্ব বইয়ে দেখাচ্ছেন: রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো Secularized theological concept। থিওলোজি থেকে রাষ্ট্রতত্ত্বে স্থানান্তরিত হয়েছে অনেক ধারণা। ধর্মের Omnipotent God হয়ে যায় সেকুলার রাষ্ট্রের Omnipotent Law-giver। তাঁর মতে, কর্তৃত্ব, আইনের প্রাধান্য, পবিত্রতা, মুক্তি, পরিশুদ্ধি ইত্যাদি অনেক ধারণাই ধর্মগত। প্রকৃত প্রস্তাবেই তো `সুনীতি`র বহু ধারণা মানুষের যুগ যুগান্তরব্যাপী ধর্মচর্চার ফল। সম্ভবত The Jewish Question বইয়ে কার্ল মার্ক্সও বলেন, রাষ্ট্র ইহলোকের ধর্ম হতে চায়,আর ধর্মকে রাখতে চায় পারলৌকিক রাষ্ট্র করে।
আসলে ধর্ম ও রাষ্ট্রকে এখানে একাকার বা অভিন্ন ভাবছি না। বরঞ্চ রাষ্ট্র নিজেকে ধর্ম থেকে বিযুক্তির কথা বলে নিজেই কীভাবে নিজেকে ‘ধর্মভাবে’ হাজির করে ও হাজির রাখে তা দেখানো উদ্দেশ্য। টি এন মদনের Secularism in its place প্রবন্ধটির এই উক্তিটি The secular is encompassed by the sacred মজার। উক্তিটির সহজ মানে হচ্ছে, যেটাকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলা হয়, সেটাও ধর্মভাব (The sacred) মুক্ত নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা নিজেও নিজেকে ধর্মের মতোই অনুসরণীয় মনে করে। ধর্ম বলতে যা বুঝি, সেটার আছর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেও থাকে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্ম নিরপেক্ষ হইতে যাইয়া নিজেই ধর্ম হয়ে বসে। তালাল আসাদ দেখান সেকুলারিজম ধর্মের সীমাপরিসীমাও ঠিক করে দেয়, ধর্মকে সংজ্ঞায়িত করে, পাবলিক-প্রাইভেট বিভক্তি সামনে আনে। তাই সেকুলার রাষ্ট্র প্রয়োজনে ধর্মকে ছাড় দেয়, আবার প্রয়োজনে ধর্মকে সে রিপ্রেসও করে। ধর্মনিরপেক্ষতার অনেক প্রকার ও প্রকরণ আছে। যখন ধর্মের রেফারেন্স ছাড়াই মানুষ নিজের মগজ ও বুদ্ধি, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, সমসাময়িক প্রয়োজন ইত্যাদিকে নিরিখ করে কোনও কিছুকে বিবেচনায় আনে তখন তাকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলি। এটি চিন্তার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা, যার বিখ্যাত নাম এনলাইটেনমেন্ট। আর ধর্মসাপেক্ষতাকে যদি ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীত পদ ধরি, তবে এর অর্থ হচ্ছে, ধর্ম থেকে প্রাপ্ত দিকনির্দেশনা বা ধর্মীয় অনুভবের সাপেক্ষে কোনও কিছুকে বিচার করা বা চালিত করা। ধর্মসাপেক্ষতার ক্ষেত্রে ঐশী গ্রন্থ, ধর্ম প্রচারকের বাণী ও কর্ম ও তৎজাত অনুভব ও চিন্তা বিবেচ্য। মজার ব্যপার হচ্ছে, কারো ধর্মীয় অনুভবজাত কর্ম বা সিদ্ধান্ত অন্যের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ হিশেবেও হাজির হতে পারে। যেমন, ন্যায়বিচারের খাতিরে কারো ধর্মীয় পরিচয়কে বিবেচনা না করা ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু কেউ কেউ এই শিক্ষার বাস্তবায়ন দেখলে এটাকে সে মানব-অভিজ্ঞতা হিশেবে দেখে। প্রকৃতপ্রস্তাবে, ইসলামে যা মুয়ামেলাত তা-ও ইসলানের গণ্ডীভুক্ত। চিন্তা, কর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র সব পরিসরেই ইসলাম নিজেকে হাজির রাখতে চায়।
জগতের বহু কিছুর জন্য ইসলামের স্পেস আছে; ইসলামে ইসলামের বরাত ছাড়াও স্বাধীনভাবে দুনিয়াবি বিষয় নিয়ে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভাবা ও রায় দেয়ার স্কোপ আছে। ইসলামের ভেতর জাগতিক পরিসর আছে। তবে মজা হচ্ছে, এই পরিসরটার অনুমতি ইসলামই দেয়। তাই এই পরিসরও ইসলামবহির্ভূত নয়। ইসলামে ধর্মসাপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই বাইনারি ভাবে চিন্তার সুযোগ নাই।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক