জগলুল আসাদের কলাম ‘মুখস্তবিদ্যা’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৭, ২০২৩

মুখস্ত করাকে আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশ নেতিবাচক ঠাওরানো হয়। কিন্তু মনে রাখা বা মনে করতে পারা,যাকে মুখস্ত বলছি, অত্যন্ত দরকারি অভ্যাস। যারা চিন্তা করতে চায়, তাদেরও অনেক কিছু স্মৃতিতে রাখতে হয়। স্মৃতিতে রাখা তথ্য বা বুঝটুকুর কাঁচামাল দিয়ে কোনো তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা বা বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করার কাজটুকুও করা সম্ভব।

যেকোনো চিন্তা বা কনসেপ্টকে ভাষার প্রতীকী  আশ্রয়ে ধরে রাখা হয়। তাই, ভাষা স্মরণে রাখার পাশাপাশি বুঝটুকুও স্মরণে রাখতে হয়। এককালে একটা বিষয় বুঝেছিলেন, এখন ভুলে গেছেন, এমনও হয়, এমনও আছে। বোঝাটাকেও স্মরণে রাখতে হয়। বিজ্ঞান পাঠের ক্ষেত্রেও এটা অপ্রযোজ্য নয়।

না বুঝে মূখস্তও ক্ষেত্রবিশেষে উপকারী। যেমন: ছোটবেলায় না বুঝেই নামতা মুখস্ত করা হয়। এটা উপকারে দেয়। ঠিকমতো নামতা মুখস্ত থাকলে বাচ্চারা বেশ বড়সড় গাণিতিক সমস্যা অল্প সময়েই সমাধান করতে পারে। মুখস্ত জিনিসের ওপর পরবর্তীকালে আরও জানা ও বোঝার ভিত তৈরি হয়।

হাওয়ার ওপরে কোনো সৌধ গড়া যায় না। যা বোঝা যায়নি তাও যদি মুখস্ত থাকে, তবে পরে সেটা বুঝে নেওয়া কঠিন হয় না। মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে একসময় বোঝা হয়ে যায়। মুখস্ত ক্ষমতা আল্লাহপ্রদত্ত বিরাট শক্তি। এর বদৌলতে মনের ভেতরে একটা শব্দ বা ধ্বনির গুঞ্জরণে জেগে ওঠে পাশাপাশি থাকা আরও আরও শব্দরাশি। একবাক্য টেনে আনে একের পর এক অপরাপর বাক্যসমূহকে, কখনো-বা চোখে ভেসে ওঠে লিখিত শব্দরাজি, কখনো-বা কানের মধ্যে নীরবে শুনতে পাওয়া যায় মুখস্ত করা বা স্মৃতিতে গেঁথে রাখা কথামালা। মনোযোগী চর্চার মাধ্যমে  স্মৃতির প্রাখর্য বাড়ানো সম্ভব।

আমরা আধুনিক মানুষেরা ক্রমাগত হারিয়ে ফেলছি স্মৃতির শক্তি। এই লেখ্যসভ্যতায় স্মৃতি ও শ্রুতির সংস্কৃতির অনেক সপ্রাণতা ও আস্বাদন আমরা খুইয়ে ফেলেছি। ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা লিখেছিলেন, ‘মানুষের জীবন বিস্মৃতির বিরূদ্ধে স্মরণের সংগ্রাম।’ এ যুগে ডকুমেন্টেশনের নানা উপায় থাকায় আমাদের স্মৃতিনির্ভরতা  কমে গেছে। আমরা আর নিজের স্মৃতির ওপর নির্ভর করি না। আমরা লিখে রাখি বা ডিজিটালি সংরক্ষণ করি তথ্য ও উপাত্ত।

প্রয়োজনীয় কিছু মনে রাখার জন্যে আমরা নির্ভর করি স্ক্রীনশটের ওপর,আর  কপি কপিপেস্ট করে সংরক্ষণ করি। ফলে স্মরণে রাখবার চেষ্টাটুকুও তিরোহিত হচ্ছে দিন দিন। অনভ্যস্ততা হেতু, কোরানের কোনো আয়াত বা সুরা, কবিতার লাইন, কোনো লেখার কোনো অনুচ্ছেদ মনে রাখতে গেলে মনে রাখা কষ্টকর হয়ে যায়। আমাদের স্মরণ রাখবার শক্তি অনাদরে ও অযত্নে চর্চার অভাবে মরিচাবৃত। সভ্যতা নির্মাণে কলম বা লেখনির ভূমিকা অপরিসীম, কিন্তু এর জন্যে স্মৃতিচর্চা নিরুৎসাহিত করা জরুরি নয়।

এখনও যারা নিরক্ষর, শুনেছি, তাদের অনেকেরই শ’খানেক মোবাইল নাম্বার মুখস্ত আছে। যেহেতু, তথ্য অন্য কোথাও সংরক্ষণের উপায় তাদের নাই, তাই অগত্যা তারা স্মৃতিতেই তথ্য সংগ্রহে রাখে। এখনো অন্ধব্যক্তিদের স্মরণশক্তি ও স্মৃতি অসামান্য। অন্ধ হাফেজ চক্ষুষ্মান যেকোনো ব্যক্তির তুলনায় অধিক মুখস্ত করার শক্তিসম্পন্ন। অন্ধত্ব বোধ হয় মানুষের অপরাপর ইন্দ্রিয়গুলোর শক্তি বাড়িয়ে দেয়। আমাদের স্মৃতি ও স্মরণশক্তির সেই ‘আদিম ঊর্বতা’ হারানোর পেছনে হয়তো দায়ী চক্ষু নামক ইন্দ্রিয়ের সর্বগ্রাসী ব্যবহার।

চারদিকেই দেখার অজস্র উপাচার। সব ইন্দ্রিয়ের মধ্যে চক্ষুর ব্যবহারই অধিক আমাদের। seeing is believing আধুনিক মানুষের জ্ঞানতত্ত্ব। চক্ষুর ব্যবহার কমে এলে হয়তো জেগে উঠবে অপরাপর ইন্দ্রিয়। আমাদের যেসব বাচ্চারা মোবাইলে প্রচুর গেইমস খেলে, অজস্র কার্টুন-টিভি দেখে, তাদের বই পড়ে মনে রাখার শক্তি কমে যায়, তারা মনকে বইয়ে কেন্দ্রীভূত রাখতে প্রায়ই অক্ষম হয়। বাচ্চাদেরকে বইমুখি করতে হবে। বাচ্চাদের সাথে স্মৃতি-শ্রুতির চর্চা দরকার।

আরব্য সংস্কৃতিতে স্মরণ রাখার সংস্কৃতি চালু ছিল খুব। কোনো হাদিস কেউ লিখে রাখলে তার মেধার স্বল্পতা আছে বলে লোকে ভাবতো। মুখস্ত বলতে পারা, মুখস্ত রাখতে পারা সুস্থ ও পূর্ণ সাবালকত্বের লক্ষ্মণ ছিল। তাদের বংশ গৌরব প্রদর্শনের জন্য বা পুর্বপুরুষের স্মৃতি ধরে রাখতে মনে রাখতে হতো বংশলতিকা বা ফ্যামিলি ট্রি, জিনিওলজি। আমাদের পূর্ববর্তী জ্ঞানসাধক যারা ছিলেন তাদের অনেকের কাছে কোনো কিছু পড়ার অর্থ সেটিকে মুখস্ত করাও বোঝাতো।

বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারির জন্যে যে এত এত আজিনিস-কুজিনিস মুখস্ত করতে হয়, এটার অন্যতম কারণ এটাও যে, স্মৃতিশক্তি আমরা খুইয়ে ফেলেছি কিনা সেটা পরীক্ষা করা। মুখস্ত করার চেষ্টা করলেই সম্ভব। আজকাল চেষ্টার তাড়ানাও আমরা বোধ করি না। খালি জ্ঞান ও বুঝবার ক্ষমতা  থাকলেই চলে না, মুখস্ত রাখবার শক্তি ও চর্চাও দরকার। মনে রাখবার ক্ষমতা একজনকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।

‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইতে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ছিল, কোনো কিছু পড়ার পর বই বা এপস বন্ধ করে স্মরণ করবার চেষ্টা করা উচিত। যদি স্মরণ করা যায় বা বাক্যগুলোকে রিপ্রোডিউস করা যায় তাহলে বুঝতে হবে, পড়া হয়েছে। আর তা না পারলে বুঝতে হবে, পড়া হয় নাই। পড়ার পর ভাবা উচিত কী পড়লাম। হুবুহু স্মরণ করার চেষ্টা করা উচিত কিছু বাক্য বা পদসমষ্টি।

আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্যে এই নসিহত খুব দরকারি। তবে এখানে আমি পরীক্ষায় বমি করবার মুখস্তচর্চার কথা বলছি না। চাচ্ছি, বুঝশক্তি ও মুখস্থক্ষমতার যুগ্মতা। আসলে আমি নিজে মুখস্ত করতে পারি না বলে মুখস্ত করা ও মুখস্ত রাখার গুরুত্বটা খুব ভালোভাবে বুঝি। তাই বোঝাতে চাইলাম। মুখস্ত ক্ষমতার ঘাটতির জন্যে জীবনে ভুগতেও  হয়!

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক