জগলুল আসাদের কলাম ‘বুদ্ধিজীবীতার ডিস্কোর্স’
প্রকাশিত : জুলাই ০৫, ২০২১
খুব গাঢ় একটা বিষয় খেয়াল করার আছে। অবশ্য এটা দীর্ঘ দিনেরই। একটা অপরিচয়ের দেয়াল বা জানাশোনার ঘাটতি বা ইচ্ছেকৃতভাবেই অদৃশ্য করে রাখার প্রবণতা দেখবেন সেকুলার মহলে। এমনকি যারা গুড সেকুলার অথবা যারা সেকুলারিজমকে প্রশ্নকারী, তাদের মধ্যেও এই প্রবণতাটা লক্ষ্যণীয়। সেটি হচ্ছে, ইসলামকে যারা ইন্টারপ্রেটিভ টুল বা বিচারের পাটাতন হিসেবে ব্যবহার কোরে সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস ও সভ্যতাকে বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে চায়, তাদের চিন্তাশীলতাকে সচেতন বা অসচেতনভাবে রিকগনাইজ না করার প্রবণতা। এই প্রবণতা এতই গভীর যে, ধরিয়ে না দিলে বোঝাই দায়। এই প্রবণতা চায়, ইসলামকে বিচারের পাটাতন হিশেবে গ্রহণকারীদেরকে অদৃশ্য করে রাখতে এবং এরা এই ধারণারই ফেরিঅলা যে, ধর্ম সর্বদা বিচারের ‘বিষয়’ থাকবে , ধর্মকে বিচারের কর্তা বা কাঠামো বানানো যাবে না বা যায় না।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বা মিডিয়া হাউজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে এই প্রবণতার উৎপাদন ঘটে ও টিকে থাকার শর্তও তৈরি হয়। এইটা মূলগতভাবে প্রাচ্যবাদী ডিস্কোর্সের সমতুল্য। এটি ‘ওয়ার অন টেরর’ যে চিন্তাকাঠামোর জন্ম দিয়েছে, সেটিরও বাইরে নয়। পাশ্চাত্য যেভাবে প্রাচ্যকে অনড়,পশ্চাৎপদ, যুক্তিহীন, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে অক্ষম বা যেকোনো ক্রিটিকাল ডিস্কোর্সে অপারগ বলে চিহ্নিত করে, এই সফট বা হার্ডকোর সেকুলাররাও অনেকটা প্রাচ্যবাদী এই ফ্রেইমওয়ার্ক ব্যবহার করে ইসলামিক ইন্টিলেজেনশিয়াদের ক্ষেত্রেও। প্রথমত তারা একটা ডিনায়ালের মধ্য দিয়ে যায়। অর্থাৎ, ইসলামের নাম নিয়ে কোনো বুদ্ধিজীবীতাই সম্ভব নয়, এরূপ ধারণা করে ও ছড়ায়। ইসলাম ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়, এটা তো চিন্তার কোনো পাটাতন হইতে পারে না। দ্বিতীয়ত তাদের এই অবস্থান প্রশ্নের মুখোমুখি হলে তারা একটা সংস্কৃতিবাদী অবস্থান নেয়। যারা মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে সেকুলার ফ্রেইমওয়ার্কে কাজ করে, তাদেরকে কিছুটা একনলেজ কোরে তাদের চিন্তার এনলাইটেনমেন্ট মডেলকে ঢেকে রাখে।
এইসব কিছুই এই ধারণারই ফল যে, ইসলামকে এজ এ ক্রিটিক বা ফ্রেইমওয়ার্ক অব ক্রিটিক হিসেবে দেখা যায় না। তাই দেখবেন, সমাজের ভেতরে যারা আলেম-উলামা হিসেবে পরিচিত তাদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য করা হয় না। এমনকি শিল্প, সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে তাদের লিখিত ভাষ্য থাকলেও। রাজক্ষমতার সামনে সত্য বলা বা বিব্রতকর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেও, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে সমস্যায়িত বা প্রশ্নবোধক কোরে তুললেও বা ইনসাফের কথা বললেও।
মার্ক্সিস্ট অধ্যাপক বা একটিভিস্ট, লিবারেল সাংবাদিক, জাতীয়তাবাদী ভাবুক, ফেমিনিস্ট চিন্তক, নাস্তিক লেখক, উদ্ধত সাহিত্যিক যেভাবে আমাদের বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোয় বুদ্ধিজীবি হিসেবে স্বীকৃত হবে, সেভাবে কোনো আলিম বা ইসলামকে চিন্তাকাঠামো হিসেবে মান্যকারী ও ব্যবহারকারী কেউ স্বীকৃত হবে না। মুসা আল হাফিজ, আসিফ আদনান, আসিফ সিবগাত, ইফতেখার জামিল, হুজায়ফা মাহমুদ, ইমরান রাইহান প্রমুখেরা বুদ্ধিজীবী পদবাচ্য হবেন না। এমনকি, তাদের নাম না জানা ও তাদেরকে না পড়াও নিজেদের জন্যে গর্বের বোলেই মনে করা ও প্রচার করা হবে। তাই লক্ষণীয় যে, আমাদের বিদ্যমান সমাজে একটা গভীর বিভাজন এখনও বিদ্যমান। মুসলিম পরিচয়, ইসলামি চিন্তক প্রভৃতি একটা গভীর অপরীকরণের কাঠামোর ভেতরেই আছে। বুদ্ধিবৃত্তির যে ধারা বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল সেখানে সেকুলার বা লিবারেল চিন্তার সাথে ইসলামি চিন্তার অন্টোলজিকাল ও এপিস্টেমোলজিকাল যে পার্থক্য, তা প্রায় অমোচনীয়। কেননা, এখানে ক্ষমতা সম্পর্কের আধিপত্যশীলতায় আসীন আছে প্রথম পক্ষ। ফলে দ্বিতীয় পক্ষ স্বীকৃতি দেয়ার পর্যায়ে নাই, আছে স্বীকৃত হওয়ার পর্যায়ে; সংজ্ঞায়িত করার পর্যায়ে নাই, আছে সংজ্ঞায়িত হওয়ার পর্যায়ে। বর্তমান এই হায়ারার্কিকাল কাঠামো চেইঞ্জ বা সমন্বয় সম্ভব?
লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক