জগলুল আসাদের কলাম ‘বানান নিয়ে নানান কথা’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩

বানানের ব্যাপারে বেশ কয়েকটা ঘরানা আছে। একটা ঘরানাকে বলা যায়  প্রসঙ্গবাদী ঘরানা, যারা বিভিন্ন বিষয়কে বোঝাতে একই বানানে লেখা শব্দের পার্থক্যকরণ করতে চান প্রসঙ্গ দেখে। যেমন, বর্ণ অর্থ অক্ষর, আর বর্ণ অর্থ  গায়ের রঙ; কোনটা কখন কোন অর্থে বসবে, এটা সবাই কনটেক্সট দেখেই বুঝি। এই ঘরানা মানুষের সহজাত ভাষাবোধের Competence ওপর গুরুত্ব দেয়।

আরেকটা ঘরানা, উচ্চারণবাদী ঘরানা। এ ঘরানা বেশিরভাগ বানানকেই উচ্চারণ অনুযায়ী লিখতে চায়। বিশেষত বিদেশি শব্দগুলোকে। লোন ওয়ার্ডগুলো যদি কোনো দেশজ রূপ না পেয়ে থাকে তবে মূলভাষার উচ্চারণ অনুযায়ীই এ ঘরানার তাত্ত্বিকরা বানান লিখতে চান,বা বলতে চান। তবে এরা এটাও অবগত যে, সব বানানকে উচ্চারণ অনুযায়ী লেখা যায় না বা দরকার পড়ে না। লেখা গেলেও চোখের অনভ্যস্ততাহেতু তাতে বিরাগ তৈরি হয়।

নির্দেশবাদী ঘরানা, যেমন বাংলা একাডেমি। এদের ভেতরে প্রথম দুই ঘরানার কিছুটা যুগ্মতা দেখা যাবে। এরা বানানকে শৃঙখলায় আনতে চান ও সবাই অভিন্ন বানানে লিখুক, এই ইচ্ছে পোষণ করেন। জাতিবোধ ও রাষ্ট্রসংহতি নির্মাণের ব্যাপারকে তারা গুরুত্ব দেন। একাডেমিক লেখালেখির বেশির ভাগই এই ঘরানার বানান ও ভাষাপদ্ধতি অনুযায়ী চলে।

ঐতিহ্যপ্রেমী ঘরানাও আছে। আমরা জানি, বানান  ধ্বনির দৃষ্টিগ্রাহ্যরূপ। এও জানি, প্রতিটি শব্দই সিম্বোলিক ও আর্বিট্রারি। তাই বৌ বানান আমাদের বধুদের ঘোমটার সদৃশতা প্রকাশ করে বলে এই বানানে অনেকের আগ্রহ। আবার, দুঃখ বানানে বিসর্গ অশ্রুর মতো পড়ন্ত থাকে বলে বিসর্গ বাদ দিতে মন চায় না। দীর্ঘদিন ধরে যে বানানে অভ্যস্ত, যেটার মধ্যে লিখন-জটিলতাও তেমন নাই, সেটাকে পুরোনো বানানেই অনেকে রাখতে চান। এই ঘরানাকে আইডিওলোজিকাল ঘরানাও বলা যাবে।

নিজের একটা বিশেষ ব্যাখ্যা হাজির করে তারা কোনো কোনো বানান লিখতে ইচ্ছুক। যেমন, হুঁশ শব্দটার ইশারা বোঝাতে কেউ লিখতে পারে মানুশ, আবার কেউ উষ বা উষা শব্দটার ব্যঞ্জনা টিকিয়ে রাখতে মানুষ লিখতে পারে। আর কেউ হয়তো স্রেফ অভ্যাসবশতই লেখে। বানান বিষয়ক বাদ-বিসম্বাদ তারা এড়িয়ে চলেন এবং বলতে চান, আমাদের চিন্তাশীলতার চর্চা বাড়ানো উচিত। বানান নিয়ে চিন্তা কোনো উল্লেখযোগ্য  চিন্তা নয়। বানান বিষয়ক তর্কাতর্কিতে শ্রমের অহেতু অপচয়, তাদের কাছে, নিন্দার্হ।

আরেকটাকে কইতে পারেন নৈরাজ্যবাদী ঘরানা, যারা প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত সব বানানকেই প্রশ্নবোধক করে ও নিজের মতো করে বানান লেখে। এটা বেশ শক্তিশালী ঘরানা। তবে এই ঘরানাও কোনো একশীলা বা মনোলিথিক ঘরানা নয়। কেউ মজা করে বলতে পারেন, অনেকে বানানের নিয়মকানুন শেখা ও মনে রাখার জটিলতা এড়াতে নৈরাজ্যবাদী হন ৷ আসলে ধ্বনি, দৃশ্য, অর্থ ও কর্তৃত্বের নানা অনুষঙ্গ কাউকে কাউকে বানান-নৈরাজ্যে আস্থাশীল করতে পারে ৷সাধু-চলিত, প্রমিত-অপ্রমিত নানা কিছুর মিশ্রণ তাদের গদ্যে দৃশ্যমান, নানা বানানও।

তবে নির্দেশবাদী বা হুকুমদার প্রতিষ্ঠান প্রবর্তিত বানান যদি পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহার করা হয়, তাহলে ওই প্রজন্মের ছেলেমেয়েগুলো পাঠ্যপুস্তকের বানানেই অভ্যস্ত হবে। সেক্ষেত্রে,যেকোনো যুক্তির চেয়ে অভ্যস্ততাই প্রধান্য পেয়ে যায়। যেমন,আমরা যারা কিছুটা আগের যুগের মানুষ তারা আরবী, নবী এভাবেই লিখতাম। কিন্তু এখন  আরবি, নবি এভাবেই বেশিরভাগ মানুষ লেখে, আমরাও লিখি। এর মানে, বানানের ক্ষেত্রে শেষবিচারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, পাঠ্যপুস্তকসহ ভাষা একাডেমি বা দাপুটে প্রতিষ্ঠানের পৌরাহিত্যে প্রবর্তিত বানান ও তাতে অভ্যস্ততা।

কিন্তু একটা ধারা সবসময়ই থাকবে যারা এই প্রবলধারার বিরোধী থাকবে। এটা স্বাভাবিক ও উপকারী। এই  বিভাজন আবার জল-অচল বিভাজন নয়, জল-অচল বিভাজন সম্ভবও নয়, বাস্তবও নয় । কেউ এক ক্ষেত্রে উচ্চারণবাদী, অন্যক্ষেত্রে হতে পারে প্রসঙ্গবাদী, কোন কোন ক্ষেত্রে প্রথাবাদী, মাঝে মাঝে নৈরাজ্যবাদী।

আরেকটা ব্যাপার, পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই সম্ভবত পুরোপুরি উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লেখা হয় না। তবে, উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লেখার বাসনা মরে যায় না। আর, প্রায় সব ভাষাতেই বানানকে সহজতর করবার প্রচেষ্টা থাকে। ইংরেজি বানানের পরিবর্তনের ইতিহাসেও আমরা এমন দেখি। ষোড়শ শতকের বানান, আর বিংশ শতকের বানান এক নয়।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক