জগলুল আসাদের কলাম ‘জায়নবাদের কূটাভাস’
প্রকাশিত : নভেম্বর ০৯, ২০২৩
এন্টি-সেমিটিজম শব্দটার অর্থ সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়েছে ইহুদি-বিদ্বেষ বা ইহুদি-ঘৃণা। এই শব্দটা আমরা সবাই জানলেও philosemitism কনসেপ্টটা অনেকেরই অজানা। জায়োনিজমের জন্ম ইউরোপীয় এন্টিসেমিটিজমের প্রতিক্রিয়ায়, এটাই আমাদের প্রচলিত জানা কথা। কিন্তু মজাটা হলো, জায়োনিজম নিজেও যে এন্টিসেমিটিক, এটা বোঝা একটু কষ্টসাধ্য। ইজরায়েল শাহাক Israel Shahak দেখান যে, জায়োনবাদ একই সাথে এন্টি-সেমিটিজমের প্রতিক্রিয়া ও মিরর-ইমেজ। ইহুদি জায়নবাদ ও খ্রিস্টিয় জায়নবাদ,আসলে, এন্টিসেমিটিজম ও ফিলোসেমিটিজমের এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
জায়নবাদীদেরকে মনে হবে ফিলোসেমাইট। মানে, ইহুদিপ্রেমী। যেহেতু তারা ইহুদিদের রাজনৈতিক মুক্তির জন্যে কাজ করে, ইহুদিদের ধর্মীয় ঐতিহাসিক একটা স্মৃতি ও আধ্যাত্মিক বাসনাকে বাস্তবায়িত করতে চায়। তাই সহজ যুক্তিতে মনে হবে, জায়নবাদে ইহুদিপ্রেম বা ফিলোসেমিটিজম আছে। কিন্তু অন্যদিকে, এন্টিসেমাইটরা যে যুক্তি ব্যবহার করেছে, জায়নবাদীরাও সেই একই যুক্তি ব্যবহার করে । এন্টিসেমাইটারা চেয়েছে ইহুদিরা চলে যাক ইউরোপ থেকে। জায়নবাদীরাও তা-ই চেয়েছে যে, ইহুদিরা ফিলিস্তিনে চলে যাক, ইউরোপে না থাকুক। সেই হিসেবে জায়নবাদীরা এন্টি-সেমাইট।
জোসেফ মাসাদ দাবি করেন, নাৎসি গণহত্যা শুধু ইউরোপের ৯০% ইহুদিকেই হত্যা করেনি, এই হত্যার মধ্য দিয়ে জায়নবাদের শত্রুদেরও হত্যা করেছে। কারণ জায়নবাদীদের আহ্বানে ইহুদিরা নিজ নিজ দেশ ও আবাস ছেড়ে বের হয়ে যায়নি। ইহুদিদেরকে ইউরোপ ছাড়া করবার অভিন্ন লক্ষ্যে নাৎসিবাদী আর জায়নবাদীরা একাকার। আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলো নাৎসিবাদী পলিসিই বাস্তবায়ন করছে। এক অর্থে যা-ই নাৎসিবাদী, তাহাই জায়নবাদী।
হার্জল নিজেও ইহুদিবিদ্বেষের জন্যে ইহুদিদেরকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ইহুদিরা যেখানে যায় সাথে করে ইহুদি বিদ্বেষও নিয়ে যায়। ইহুদি বিদ্বেষের জায়নবাদী বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ইজরায়েল রাষ্ট্র। হার্জল তার ডায়েরীতে লিখেছিলেন, এন্টি-সেমাইট দেশগুলো হবে আমাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু। এন্টি-সেমাইট দেশগুলো হবে আমাদের মিত্র। The anti-Semites will become our most dependable friends, the anti-Semitic countries our allies.
তা-ই হয়েছে শেষ পর্যন্ত। আর, জায়নবাদ সত্যিকার অর্থে একটা এন্টি-জুইশ মুভমেন্ট। এ অর্থে, জায়োনবাদীদের চেয়ে বড় নাৎসিবাদী ও এন্টি-সেমাইট আর নাই। অন্যদিকে, খ্রিস্টান জায়নবাদীতার ভেতরেও রয়েছে একই সাথে ইহুদিপ্রেম ও ইহুদিবিদ্বেষ। ইভানজেলিকাল খ্রিস্টনরা মনে করে, ইহুদিরা খোদার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট। আবার একই সাথে, তাদের একটা অংশ এও মনে করে যে, জেসাস ক্রাইস্টকে হত্যা করেছে ইহুদিরা। খ্রিস্টান জায়োনিস্ট তথা ইভানজেলিকাল খ্রিস্টানরা মনে করে, যিশু খ্রিষ্টের দ্বিতীয় আগমনকে ত্বরান্বিত করতে ইহুদিদেরকে প্যালেস্টাইনে জড়ো করা উচিত। তাই একদিকে তাদের একটা অংশ হিটলারের ইহুদি নিধনে খুশি হয় এই জন্যে যে, এর ফলে ইউরোপ ছেড়ে যাবার এবং প্যালেস্টাইনে ‘ফিরে’ যাবার উদ্যোগ-আয়োজন সম্পন্ন হয়।
ইভানজেলিকাল খ্রিস্টনরা ইহুদিবাদকে ধর্ম হিসেবে প্রত্যাক্ষ্যান করে। ইহুদিদেরকে তারা রেইস বা নেশন বা জাতি হিসেবে গণ্য করে। ইহুদিদেরকে এইভাবে জাতি হিসেবে গণ্য করার ব্যাপারটাকে ইহুদি বুদ্ধিজীবীদেরও প্রভাবিত করে। এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই জাতি বা রেইস এর ধারণা বিশুদ্ধ জাতির ধারণার আবির্ভাবকে সম্ভব করে তোলে। ফলে জাতিগত নিধনের ধারণাও জন্ম নেয়। এই জাতির ধারণা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের দ্বারা ইহুদি নিধনের মতাদর্শিক ন্যায্যতা দেয়।
ইভাঞ্জেলিকাল খ্রিস্টানরা মনে করতো, ইউরোপকে ইহুদি মুক্ত করতে প্যালেস্টাইনকে ইহুদি-আবাস করতে হবে। এবং এর ফলে সম্ভব হবে জেসাস ক্রাইস্টের ত্রাণকর্তা হিসেবে পুনরাভির্বাব। ইভানজেলিকাল খ্রিস্টান তথা খ্রিস্টান জায়নবাদীদের চিন্তার সাথে ব্রিটিশ শাসকদের ফরেন পলিসির মিলনের ফলে তাদের ভেতর যে মৈত্রী ঘটে, তা প্যালেস্টাইনে জায়নকরণের সূত্রপাত ঘটায়। ইলান পাপে সিদ্ধান্ত টানেন যে, ইহুদি জায়নবাদী ও খ্রিস্টান জায়বাদীদের ভেতরে এইভাবে এন্টিসেমিটিজম ও ফিলোসেমিটিজম মিলেমিশে থাকে।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক