জগলুল আসাদের কলাম ‘ইসলামে সুফিধারা’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৩, ২০২২
বাংলার সেক্যুলার ও প্রগতিশীল মহলে ‘সুফি ধারা’র ইসলামকে পছন্দ ও প্রশংসা করতে শোনা যায়। এটিকে তারা ইসলামের একটি অনন্য জ্ঞানতাত্ত্বিক ও দার্শনিক ধারা বলেও মনে করেন। এই চাওয়াটিও রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ও নির্দোষ নয়। ইসলামের এই রূপটির বিকাশ তারা চান, বিশেষ করে এ অঞ্চলে কৃষির বিকাশে সুফি-দরবেশ-পির-আওলিয়াদের অবদান, ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা ও জনমানুষের রোগ নিরাময়ের বিশেষ কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি প্রবর্তনের কারণে।
একটি মজার ব্যাপার উল্লেখযোগ্য, পির-আউলিয়াদের ঝাড়ফুঁক-তাবিজ-তাগা প্রভৃতিকে আমাদের সমাজের বিজ্ঞানমনস্ক অংশ অবৈজ্ঞানিক ও কুসংস্কার মনে করেন। অপরদিকে, প্রগতিশীলদের আরেকটি অংশ ‘লোকায়ত ইসলাম’ এর নমুনা হিসেবে এগুলোকে গ্লোরিফাই করেন এবং ইসলাম চর্চার বৈচিত্র্য হিসেবে এগুলোকে ভাবতে পছন্দ করেন। যা হোক, বাংলার পিরালি ঘরানা এই ধারাকে কিছুটা ধরে রেখেছে। পাশাপাশি এ ধারাকে ঘিরে ভণ্ডামি ও প্রতারণাও আছে।
তাবলিগ জামায়াতও সুফি ইসলামের আবহে গঠিত। মাওলানা ইলিয়াস প্রবর্তিত সংস্কারপন্থী এই জামায়াতের লক্ষ্য, মুসলিমদের ‘ঈমান ও আমল’ অর্থাৎ মৌলিক বিশ্বাস ও চর্চার ধারাবাহিকতা ও পরিশুদ্ধি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালের অধ্যাপক ড. মো. ইয়াহিয়া আখতার তাবলিগ জামায়াতের ধর্মীয় ও সামাজিক ভূমিকা নিয়ে একটি গবেষণামূলক বই লিখেছেন। ইসলাম প্রচারে তাবলিগ জামায়াতের বিশেষ ভোকাবুলারি ও মেথডোলজি আছে।
বিশ্বময় এ জামায়াতের কার্যক্রম বিস্তৃত। বাংলাদেশের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে তাবলিগ জামাতের সুবিশাল ইজতেমা বা দ্বীনি জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিশেষ সরকারি সহায়তা ও ব্যবস্থাপনা থাকে। সুফিবাদী ধারাও একশিলা monolithic নয়, তারও আছে নানা বৈচিত্র্যময় অভিব্যক্তি। সুফিবাদের নানা তরিকা, যেমন: কাদেরিয়া, নকশবন্দিয়া, চিশতিয়া ইত্যাদি, বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়। বাংলা অঞ্চলে ইসলামের প্রসারের পেছনে এই পির-আউলিয়া বা সুফিদের ভূমিকা ছিল বলে রিচার্ড ইটন দেখিয়েছেন।
হযরত আলী (রা.), হাসান বসরি, রাবেয়া বসরি, মনসুর হাল্লাজ, জালালুদ্দীন রুমি, বায়েজিদ বোস্তামী, ফরিদুদ্দীন আত্তার প্রমুখ ক্লাসিক সুফিবাদী ধারার অন্তর্ভুক্ত। ভারতবর্ষে সাইয়েদ আহমেদ বেরেলভী, ইসমাইল শহীদ, মইনুদ্দিন চিশতি, মুজাদ্দিদে আলফে সানি, খাজা ফরীদুদ্দীন গঞ্জেশকর প্রমুখ এ ধারার অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। পির ও সুফিদের জীবনচরিতে দরিদ্র ও বুভুক্ষু মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে হাক্কুল ইবাদের (মানবসেবা) দায়িত্ব পালনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমরা হাসান আলী নদভীর ‘সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস’ গ্রন্থে ভারতবর্ষের অজস্র খানকায় নিরন্ন মানুষকে নিয়মিত ভোজন করানোর অনন্য ইতিহাস দেখতে পাই। তিনি দেখাচ্ছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলয়ের ধারেকাছেও তারা ঘেঁষতেন না। বরং তাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রভাবে রাজা-বাদশাহরাই তাদের দরবারে হাজিরা দিতেন।
সুফিরা শুধু ‘পরম সত্যে’র অনুসন্ধানী নন, সাধনার মধ্য দিয়ে পরম সত্যে বিরাজ করাই তাদের লক্ষ্য। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়র ভেদমোচন করে তারা স্রষ্টা ও বস্তুর আন্তর রূপ অবলোকন করে সেখানে অবস্থান করতে চান। ধ্রুপদী সুফিবাদী ধারায় দৈহিক ও অন্তরবৃত্তিক কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে তারা ‘স্ব-ভাব’ এর ঐশ্বরিকতা অর্জন করতে চান, লীন হতে চান সত্যের স্বরূপে। হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে তারা কোনো মধ্যস্থতা ছাড়াই পেতে চান খোদায়ী নির্দেশনা। সত্য অর্জনের চেয়ে নিজেরাই ‘সত্য’ হয়ে উঠতে চান।
এখন যে ধারাটি নিয়ে আলোচনা করবো তা সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়। এই ধারার অনুসারীদের সংখ্যাধিক্য, ইসলামি চিন্তায় এই ধারার প্রতাপকে নির্দেশ করে না। এ ধারাটি আমাদের সমাজে ইসলামের কোনো Idea generator ও propagator না হওয়ায় তারা receiving end এ অবস্থান করে। যদিও বিশেষ সময় ও পরিস্থিতিতে তাদের সক্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা সর্বদাই থাকে। এ ধারার একটা অংশ বিশ্বাসে মুসলিম, যদিও আচারনিষ্ঠ নন। ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা পেলে নিজ ধর্মের ব্যাপারে আস্থাবান হয়ে ওঠেন, আর ‘অবমাননা’ দেখলে ভেতরে ভেতরে আহত হন।
ইসলাম নিয়ে আলোচনা ও তৎপরতায় তাদের কোনো বিশেষ আগ্রহ নাই। সহজ-স্বাভাবিকতায় যতটুকু পারেন ইসলাম চর্চা করেন। এ ধারার বেশিরভাগই প্রাত্যহিক জীবনে কোনটা ইসলামসিদ্ধ আর কোনটা নয়, এমন কঠোর watertight শ্রেণিবিভাগ করেন না। অনেকে থার্টি ফার্স্ট নাইটের প্রোগ্রামেও যান, আবার যান তারাবির নামাজও পড়েন। রোজার দিনে ইসলামি প্রোগ্রামও দেখেন, আবার প্রাত্যহিক জীবনের একটু অবসরে বিনোদনের সব মাধ্যমই গ্রহণ করেন। ইসলাম-অনৈসলাম এমন ভাগে জীবনের বৃহৎ পরিসরকে তারা ভাগ করেন না। ধর্মে আস্থা ও বিশ্বাসটুকু অক্ষুণ্ন রেখেই জীবনের স্বচ্ছন্দ গতিতে তারা আবাহন করেন। ধর্মের কেতাবি রূপ নিয়ে তাদের আগ্রহ নাই। মসজিদের খুৎবা অথবা ‘বেহেশতি জেওর’ ‘মকছুদুল মমেনিন’ ‘আমলে নাজাত’ ইত্যাদি বইয়ের মাধ্যমে তারা ইসলাম বোঝেন বা শেখেন। চর্চার বিশুদ্ধতা নিয়ে তারা ভাবিত নন। তারা নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বে আস্থাশীল। অন্য ধর্মাবলম্বীদের পরিসরেও তাদের সহজ বিচরণ রয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ